04/08/2025
"আকাশছোঁয়া স্বপ্ন"
এক সময় ছিল, যখন রনিদের বাড়ির উঠোনে সব সময় হাসির কলতান শোনা যেত। বাবা ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তার চালের গুদামে সবসময় লোকজনের ভিড় লেগে থাকতো, আর মা পরম মমতায় তাদের চার ভাই-বোনকে আগলে রাখতেন। ছোটরা খেলাধুলা করতো, বড়রা পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, আর রনি—সবার বড় ছেলে—ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত। তাদের জীবনে অভাব বলে কিছু ছিল না।
কিন্তু সময়ের চাকা উল্টো ঘুরতে শুরু করলো। হঠাৎ করে বাবার ব্যবসায় বড় লোকসান হলো। একের পর এক লোকসানে তাদের সুখের সংসার যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। সবকিছু হারিয়ে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। সংসারে অভাবের কালো ছায়া নেমে এলো। মা অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন। রনি দেখতো, তার ছোট ভাই-বোনেরা ভালো জামা-কাপড় পায় না, ভালো খাবার খেতে পায় না। এমনকি তার নিজেরও পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
এই দুঃসহ অবস্থা দেখে রনির কিশোর মনে এক প্রচণ্ড জেদ চাপলো। সে সিদ্ধান্ত নিল, গ্রামে থাকলে এই দারিদ্র্যের গণ্ডি থেকে বের হতে পারবে না। একদিন মা-বাবাকে প্রণাম করে সে পাড়ি জমালো অচেনা এক শহরে, ঢাকায়। পকেটে ছিল সামান্য কিছু টাকা আর বুকে ছিল আকাশছোঁয়া স্বপ্ন।
ঢাকায় এসে রনি দিনরাত অনেক কষ্ট করে একটি ছোট চাকরি পেল। বেতন ছিল খুবই কম, কিন্তু সে কখনো হাল ছাড়েনি। নিজের জন্য সামান্য কিছু টাকা রেখে বাকি সবটুকুই বাড়িতে পাঠিয়ে দিতো। দিনের পর দিন দুপুরে না খেয়ে থেকেছে, সস্তা খাবার খেয়ে জীবন পার করেছে, কিন্তু কখনো তার ভাই-বোনদের কথা ভোলেনি। তার পাঠানো টাকায় ছোট ভাই-বোনেরা স্কুলে যেত, ভালো জামাকাপড় পরতো। রনি বিশেষ করে তার ছোট ভাইকে উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেছিল। তার পাঠানো টাকায় সেই ছোট ভাই মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে।
সময় গড়িয়ে চললো। এক সময় রনির জীবনে এলো আরও বড় ঝড়। মা-বাবার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে বাবা রনিকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন, যেন সে শহরে একটি নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারে। কিন্তু সেই টাকা হাতে আসার পর পরই জানা গেল মায়ের কঠিন অসুখ হয়েছে—ক্যান্সার। মায়ের চিকিৎসার জন্য সব টাকা খরচ হয়ে গেল। এক সময় রনি নিজের সব সঞ্চয়ও শেষ করে ফেলল, তবুও মায়ের চিকিৎসা চলতে থাকলো। এই কঠিন সময়ে তার পাশে কেউ ছিল না। সে একা হাতে সব সামাল দিয়েছিল।
তারপর রনি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সে একটি ভালো চাকরি পেল। তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হলো। সে গ্রামে গিয়ে বাবার বন্ধক রাখা সব জমি ছাড়িয়ে নিয়ে এলো, যা তার পরিবারের অস্তিত্বের প্রতীক ছিল। এমনকি সে কষ্ট করে গ্রামে এক বিঘা জমি কিনে বাবাকে উপহার দিল। তার মনে শান্তি ছিল, কারণ সে তার পরিবারের জন্য কিছু করতে পেরেছে।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এখানেই শেষ নয়। যে ভাই-বোনদের জন্য রনি তার জীবনের সোনালী সময় বিসর্জন দিল, আজ তারাই তার ত্যাগ ভুলে গেছে। তাদের স্ত্রীরাও আজ তাদের স্বামীর সুরে সুর মিলিয়ে বলে, রনি তাদের জন্য কিছুই করেনি। রনি আজ একা হয়ে গেছে। তার সমস্ত ত্যাগ, কষ্ট, আর ভালোবাসা যেন মিথ্যে হয়ে গেছে। রনির মনে শুধু একটাই প্রশ্ন, "তবে কি আমি ভুল করেছিলাম?"
এই গল্পটি আমাদের শেখায়, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং ত্যাগের মূল্য সব সময় সবাই বুঝতে পারে না। তবুও, একজন মানুষের নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকাটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
গল্পের চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব
এই গল্পের প্রধান চরিত্র রনি ছাড়াও আরও কিছু চরিত্র আছে, যাদের মানসিক অবস্থা নিয়ে ভাবলে গল্পটি আরও জীবন্ত হয়ে উঠবে।
• রনির বাবা: একজন সফল ব্যবসায়ী থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। তাঁর হতাশা, ব্যর্থতার গ্লানি এবং ছেলের ত্যাগের প্রতি তাঁর নীরব ভালোবাসা—এই বিষয়গুলো তুলে ধরা যায়।
• রনির মা: একজন মমতাময়ী মা, যিনি সব সময় তাঁর পরিবারের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁর কষ্ট, ধৈর্য এবং ছেলের প্রতি তাঁর বিশ্বাস—এগুলো গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
• রনির ভাই-বোনেরা: বড় ভাইয়ের ত্যাগ এবং কষ্টের মূল্য না বোঝা তাদের মানসিকতা তুলে ধরে। সময়ের সাথে তাদের বদলে যাওয়া, স্বার্থপরতা এবং ভুল বোঝাবুঝি গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
গল্পের মূল বার্তা এবং পরিণতি
গল্পের শেষে রনির একা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক। কিন্তু এর মধ্যে একটি গভীর বার্তা লুকিয়ে আছে।
• ত্যাগের গুরুত্ব: নিঃস্বার্থভাবে করা ত্যাগের মূল্য অনেক সময় চাওয়া হয় না, কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়।
• সম্পর্কের জটিলতা: পারিবারিক সম্পর্কগুলো কতটা fragile হতে পারে, তা এই গল্পে দেখা যায়। সময়ের সাথে সাথে মানুষের মন বদলে যায়, আর এই বদলে যাওয়া মন সম্পর্কগুলোকে জটিল করে তোলে।
• স্বার্থপরতা বনাম নিঃস্বার্থতা: রনির নিঃস্বার্থতা এবং তার ভাই-বোনদের স্বার্থপরতার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তা সমাজের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।