03/09/2025
বেদে 'রাধাপতি'
ঈশ্বরের 'রাধাপতি' নামটি কোনো নবীন শব্দ নয়, শব্দটি বৈদিকযুগ থেকেই প্রচলিত। ঋগ্বেদ সংহিতাসহ বেদের বিভিন্ন স্থানে পরমেশ্বরকে রাধাপতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। বৈদিক ইন্দ্রসূক্তে ইন্দ্রকে রাধাপতি বা সকল ঐশ্বর্যের পতি বলে স্তোত্র করা হয়েছে।
স্তোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহো বীর যস্য তে।
বিভূতিরস্তু সূনৃতা ॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ০১.৩০.০৫)
(সামবেদ সংহিতা: উত্তরার্চিক,১৬.০৩/ সাম-১৬০০)
"হে রাধাপতি (ঐশ্বর্যের পতি), হে বীর! প্রশস্তি দ্বারা স্তুত, যে তোমার স্তুতি করে সে সমৃদ্ধি ও আনন্দ লাভ করে।অর্থাৎ তাঁর সত্য রূপা প্রিয় সমৃদ্ধি লাভ হয়।"
ইদং হ্যন্বোজসা সুতং রাধানাং পতে৷
পিবা ত্বাস্য গিৰ্বণঃ ॥
(সামবেদ সংহিতা: উত্তরার্চিক, ০২.০৩/ সাম-৭৩৭)
"হে রাধাপতি (ঐশ্বর্যের পতি), হে স্তুতিপ্রিয়! তেজ দ্বারা সম্পন্ন এই মধুর সোমরস তোমার পানের জন্য, তুমি এসে পান কর ৷"
বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে রাধাপতি বলতে শুধু ইন্দ্র নয় বিষ্ণুকেও বোঝায়। বেদের অনেক মন্ত্রে ইন্দ্র এবং বিষ্ণুকে অভেদ বলা হয়েছে। মৈত্রায়ণী আরণ্যকের মৈত্রায়ণী উপনিষদে কুৎস নামক মুনি একটি পরমেশ্বরের স্তুতি করেন, সে স্তুতির নাম 'কৌৎসায়নী স্তুতি'। সে কৌৎসায়নী স্তুতিতে বিষ্ণু, ইন্দ্রসহ সকল দেবতাই যে অভেদ এ তত্ত্বটি প্রকাশিত হয়েছে।
ত্বং ব্রহ্মা ত্বং চ বৈ বিষ্ণুস্ত্বং রুদ্রস্ত্বং প্রজাপতিঃ ৷৷
ত্বমগ্নির্বরুণো বায়ুত্ত্বমিদ্ৰস্ত্বং নিশাকরঃ ।।
(মৈত্রায়ণী উপনিষদ: ০৫.০১)
" তুমি ব্রহ্মা, তুমি সর্বব্যাপক বিষ্ণু, তুমি রুদ্র, তুমি স্রষ্টা প্রজাপতি, তুমি অগ্নি, বরুণ, বায়ু, তুমি দেবরাজ ইন্দ্র ও তুমিই নিশাকর চন্দ্র ৷"
অথর্ববেদ সংহিতার সপ্তমকাণ্ডের একটি মন্ত্রে ইন্দ্র এবং বিষ্ণুর অভেদত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত। মন্ত্রে দেবী সিনিবালীকে ঐশ্বর্যশালী ইন্দ্রের অভিগামিনী দেবী বলা হয়েছে, আবার বিষ্ণুপত্নীও বলে অবিহিত করা হয়েছে। মন্ত্রটির শেষ পাদে "দেবি রাধসে চোদয়স্ব" বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
যা বিশ্ পত্নীন্দ্রমসি প্রতীচী সহস্ৰস্তুকাভিয়ন্তী দেবী । বিষ্ণোঃ পত্নি তুভ্যং রাতা হবীংষি পতিং দেবি রাধসে চোদয়স্ব ৷৷
(অথর্ববেদ সংহিতা:০৭.০৪.০৮.০৩/০৭.৪৮.০৩)
" হে প্রজাপালিনী, বহুজনের দ্বারা স্তুতা, পরম ঐশ্বর্যশালী ইন্দ্রের অভিগামিনী দেবী; হে বিষ্ণুপত্নী! তোমার উদ্দেশে হবি প্রদত্ত হয়েছে, হে দেবী! তুমি আমাদের ধন প্রেরণ কর ৷"
শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের দ্বিতীয় স্কন্ধে বলা হয়েছে, ইন্দ্ররূপে ত্রিলোকের দুঃখ হরণ করেছিলেন বলে স্বায়ম্ভুব মনু তাঁকে 'হরি’ নামে অভিহিত করেন।
জাতো রুচেরজনয়ৎ সূয়মান্ সুযজ্ঞ আকৃতিসূনুরমরানথ দক্ষিণায়াম্।
লোকত্রয়স্য মহতীমহরদ্ যদার্তিং
স্বায়ম্ভুবেন মনুনা হরিরিত্যনূক্তঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ:০২.০৭.০২)
" এরপর এককল্পে প্রজাপতি রুচির পত্নী আকুতির গর্ভে সুযজ্ঞ নামে অবতার গ্রহণ করেন। সেই অবতারে তিনি নিজ পত্নী দক্ষিণার গর্ভে সুযজ্ঞ দেবতাগণকে সৃষ্টি করেছিলেন। তিনিই ইন্দ্র হয়ে ত্রিলোকের দুঃখ হরণ করেছিলেন বলে, স্বায়ম্ভুব মনু তাঁকে ‘হরি’ নামে অভিহিত করেন। "
শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের দশম স্কন্ধে রাসপঞ্চাধ্যায়ে 'অনয়ারাধিতো' অর্থাৎ অন্য কোনো গোপীকর্তৃক আরাধিতা শব্দের মধ্যেই বৈষ্ণবশাস্ত্রকারগণ শ্রীমতী রাধারাণীকে খুঁজে পেয়েছেন। সনাতন গোস্বামী এবং জীব গোস্বামীকে অনুসরণ করে শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের আদিলীলায় বলেছেন,
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন বলেই তাঁর নাম রাধা।
“কৃষ্ণময়ী কৃষ্ণ যাঁর ভিতরে বাহিরে ।
যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে।
কিম্বা প্রেমরসময় কৃষ্ণের স্বরূপ।
তাঁর শক্তি তাঁর সহ হয় একরূপ ॥
কৃষ্ণবাঞ্ছা-পূর্ত্তি-রূপ করে আরাধনে ।
অতএব রাধিকা নাম পুরাণে বাখানে।।”
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: আদিলীলা,০ ৪)
(শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও শ্রীসুবোধচন্দ্র মজুমদার (সম্পাদিত), 'কৃষ্ণদাস গোস্বামী বিরচিত শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত', দেবসাহিত্য কুটীর,কোলকাতা : মে ২০২২, পৃ. ৩৭)
বৈষ্ণবীয় আরাধনা অর্থে রাধা শব্দটি শৌনকাচার্যকৃত 'বৃহদ্দেবতা' গ্রন্থেও পাওয়া যায়।
মহানাম্ন্য ঋচো গুহ্যাস্ তা ঐন্দ্রশ্চৈব যো বদেৎ।
সহস্রযুগপর্যন্তম্ অহর্ব্রাহ্মং স রাধ্যতে।।
(বৃহদ্দেবতা: ০৮. ৯৮)
"মহানাম্নী ঋক্ হলো গুহ্য এটি ইন্দ্রকে সমর্পিত। যাঁরা এর আরাধনা করেন, তাঁরা সহস্র বর্ষের ব্রহ্মার একদিন প্রাপ্ত হন।"
ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
#এই #ও #ও