31/05/2025
#বকুল_গাছ_বকুল_ফুল
বকুল (বৈজ্ঞানিক নাম: Mimusops elengi) হচ্ছে মিনাসপ্স্ (Minasops) প্রজাতির একটি ফুল। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী এলাকার ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, বার্মা, ইন্দো-চীন, থাইল্যান্ড, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এলাকা জুড়ে এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তবে, মালয়েশিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, নিউ ক্যালিডোনিয়া (ফ্রান্স), ভানুয়াতু, এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়াতে এই গাছ চাষ করা হয়। [১]
বকুল
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ:
উদ্ভিদ
বিভাগ:
Magnoliophyta
শ্রেণী:
Magnoliopsida
বর্গ:
Ericales
পরিবার:
Sapotaceae
গণ:
Mimusops
প্রজাতি:
M. elengi L.
দ্বিপদী নাম
Mimusops elengi L.
বাংলায় বকুল ফুলের জন্যে পরিচিত এই গাছ। বকুলের অন্যান্য ব্যবহার বাংলায় তেমন নেই। এটি একটি অতি পরিচিত ফুল। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় এর গাছ পাওয়া যায়। বাগানে ছায়া পাওয়ার জন্য সাধারনত বকুল গাছ লাগানো হয়ে থাকে।
এটি মাঝারি আকারের গাছ এবং এর পাতাগুলি হয় ঢেউ খেলানো। ফুলগুলো খুব ছোট হয়। বড় জোড় ১ সে. মি.। ফুলগুলো দেখতে ছোট ছোট তারার মতো। বকুল ফুলের সুবাসে থাকে মিষ্টি গন্ধ। ফুল শুকিয়ে গেলেও এর সুবাস অনেক দিন পর্যন্ত থাকে।
বকুল ফুল, ফল, পাকা ফল, পাতা, গাছের ছাল, কাণ্ড, কাঠ সব কিছুই কাজে লাগে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে এর ব্যবহার রয়েছে।
নাম
বৈজ্ঞানিক নাম: Mimusops elengi পরিবারের নাম: Sapotaceae
প্রচলিত নাম : Bullet-wood Tree, Indian Medaller
এলাকা ভিত্তিক নাম:[২]
বাংলা ভাষায় - বকুল, বহুল, বুকাল, বাকুল, বাকাল। তবে বকুল নামেই বেশি পরিচিত।
ইংরেজি - Spanish cherry[৩], Medlar[৩], and Bullet wood[৪]
সংস্কৃত ভাষায় - আনাঙ্গাকা (Anangaka), বকুল (Bakul), বকুলা (Bakula), বকুলাহ (Bakulah), ছিড়াপুস্প (Chirapushpa), কিরাপুস্প (Cirapuspa), ধানভি (Dhanvi), দোহালা (Dohala), গুধাপুস্পকা (Gudhapushpaka), কন্ঠা (Kantha),কারুকা (Karuka), কেশারা (Kesara), কেশারাপা (Kesarapa), মধুগন্ধা (Madhugandha), মধুপাঞ্জারা (Madhupanjara), মধুপুস্প (Madhupushpa), মাকুলা (Mukula)
হিন্দি - বকুল, বলসারি,मौलसरी, মাউলসারাউ (Maulsarau), মাউলসের (Maulser), মাউলসিরি (Maulsiri), মোলসারি (Molsari), মুলসারি (Mulsari), তেন্ডু (Tendu), মাউলসারি (Maulsari), মোলসিরি (Molsiri), মোরসালি (Morsali).
তামিল ভাষায় - மகிழம்பூ Magizhamboo, আলাগু (Alagu), ইলাঞ্চি (Ilanci), ইলাঞ্জি (Ilanji), কেসারাম (Kesaram), কোসারাম (Kosaram), ম্যাগিল (Magil), ম্যাগিলাম (Magilam), ভাগুলাম (Vagulam), মগাদাম (Mogadam), ম্যাগিশ (Magish), মাকিলাম্পু (Makilampu), মাকিলাম ভিটটু (Makilam vittu), কেছারাম (Kecaram), মাকিলাম মারাম (Makilam maram), মাকুলাম্পু (Makulampu), ভাকুলাম্পু (Vakulampu), ম্যাগিঝ (Magizh), মাগাদাম (Magadam), ম্যাগিঝাম (Maghizham), মোগিদাম (Mogidam), ভাকুলাম (Vakulam), মাহিলা (Mahila), মাকিঝাম্পু (Makizampu).
মনিপুরী - বোকুল লৈ (Bokul lei)
সাঁওতালি ভাষায় - ᱯᱤᱛᱟᱹᱡ (পিতাজ্)
মালয়েশিয়া - বিতিছ (Bitis), ইলেঙ্গি (Elengi), মেংকুলা (Mengkula), বাকুলাম (Bakulam), ইলাঙ্গি (Elangi), ইলান্নি(Elanni), এলেঙ্গি (Elengi), ইলান্নি (Ilanni), ইরান্নি (Iranni), মাকুরাম (Makuram), মুকুরা (Mukura), এলানি (Elani), এলেঙ্গি (Elengii), এলেঞ্জি (Elenjee), এরিনি (Erini), মাকিরা (Makira), মাকুরা (Makura)
ইন্দোনেশিয়া - তাঞ্জাং (Tanjung), কারিকিশ (karikis)
থাইল্যান্ড - কুন (Kun), কাইও (Kaeo)
মায়ানমার - কায়া
গাছের ধরন
এই গাছের ফল নানা কাজে ব্যবহার করা হয়
বকুল একটি চিরহরিৎ বৃক্ষ। এটি ১৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। মাঝারি আকারের এই গাছ দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও উত্তর অস্ট্রেলিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে জন্মে। এই বৃক্ষের পাতা গুলো মসৃন, গাড় সবুজ ও ঢেউ খেলানো, আকারে ৫ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২।৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার চওড়া হয়।
বকুল ফুল আকারে খুব ছোট ছোট হয়। আকারে বড় জোড় ১ সে. মি.। দেখতে ছোট ছোট তারার মতো ফুল গুলো যখন ফোটে তখন গাছের চেহারা হয় অন্যরকম। এবং মাটিতে যখন ঝড়ে পরে তার দৃশ্য নয়নাভিরাম। বকুল ছোট তারার মত হলুদাভ সাদা বা ক্রীম রঙের হয়। এই ফুল রাত্রে ফোটে এবং সারাদিন ধরে টুপটাপ ঝরতে থাকে। ভারি সুগন্ধী এই বকুল। শুকনো বকুল ফুলের সুগন্ধটা অনেকদিন থাকে তাই এই ফুলের মালা অনেকদিন ঘরে রেখে দেয়া যায়। ফুলে থাকে উদ্বায়ী তেল।
বকুল গাছের ছাল মোটা, আর রঙ গাঢ় কালচে বাদামী কিংম্বা কালচে ছাই রঙের হয়ে থাকে[৫]।
বকুল ফল বকুল গাছে ছোট ছোট কুলের মত ডিম্বাকৃতির ফল হয়। ফল গুলো কাঁচা অবস্থায় সবুজ,পাঁকলে লাল বর্ণ ধারণ করে। পাখিরা বকুল ফল খেয়ে থাকে। অনেক সময় বাচ্চাদের ও বকুল ফল খেতে দেখা যায়। ফলের স্বাদ কষ যুক্ত হালকা মিষ্টি। গাছে এই ফল আসে বর্ষাকালে [৬]।
বীজ - বকুল ফলে একটি করে ডিম্বাকৃতির, বাদামী বীজ থাকে। তবে কখনও কখনও দুটি বীজও থাকতে দেখা যায় [৭]। এই বীজ থেকে অনুদ্বায়ী তেল পাওয়া যায়। [২]
ভারি সুন্দর গাছ এই বকুল, ঘন সবুজ পাতায় ঠাসা, মাথাটা গোলগাল কিংম্বা লম্বাটে। বয়স্ক গাছ ৩০- ৪০ মিটার উঁচু হয়ে থাকে। কখনই পাতা ঝরিয়ে উদোম হয় না বলে আদর্শ ছায়াতরুও। শিক্ষাঙ্গন, মন্দির, রাস্তাপার্শ্ব, উদ্যান, বাড়ীতে বকুল গাছ লাগানো হয়।
আয়ুর্বেদিক ব্যবহার
বকুল ফুল, ফল, পাতা, কাণ্ড দিয়ে বিভিন্ন অসুখ নিরাময়ের নানারকম আয়ুর্বেদিক ব্যবহার রয়েছে।
ফুল - ফুলের রস হৃদযন্ত্রের অসুখ, লিকোরিয়া (leucorrhoea), menorrhagia নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়।
শুকনো ফুলের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ঔষধ "আহওয়া" নামক এক ধরনের কঠিন জ্বর, মাথা ব্যথা এবং ঘাড়, কাঁধ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে সৃষ্ট ব্যাথার নিরাময়ে ব্যবহার হয়।
শুকনো ফুলের গুঁড়ো মাথা ঠান্ডা রাখে ও মেধা বাড়াতে উপকারী।
শুকনো বকুল ফুলের গুঁড়ো নাক দিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিলে মাথা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
বকুল গাছের ছাল - গাছের ছাল দিয়ে কাটা ছেঁড়ার ক্ষত পরিষ্কার করা যায়। এছাড়াও বকুল গাছের ছাল ও তেঁতুল গাছের ছাল সিদ্ধ করে পাচনের মাধ্যমে তৈরি তরল ঔষধ ত্বকের নানারকম রোগ সারাতে ব্যবহৃত হয়। [৮]
বকুলের কাণ্ড - গাছের কাণ্ড থেকে পাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক ধরনের ঔষধ তৈরি করা হয় যা দাঁতের সমস্যা নিরাময়ে অনেক উপকারী। এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ফিলিপাইনে। এছাড়াও এই ঔষধ জ্বর ও ডায়রিয়া থেকে আরোগ্য লাভের জন্যে ব্যবহার করে ফিলিপাইনের অধিবাসীরা। স্থানীয় লোকেরা এই তরল পানি দিয়ে গার্গল করে গলার অসুখের নিরাময়ের জন্যে। মুখ ধোয়ার তরল প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে এই তরল ঔষধ যা মাড়ি শক্ত করে।[৮]
বকুলের পাতা সিদ্ধ করে মাথায় দিলে মাথা ব্যাথা কমে যায়। পাতার রস চোখের জন্যেও উপকারী।[৮]
কাঁচা বকুল ফল প্রতিদিন ২-৩ টি করে চিবিয়ে খেলে দাঁতের গোড়া শক্ত হয়।
অন্যান্য ব্যবহার
ফুল - ভারতে এই ফুল দিয়ে তৈরি তরল, সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহারে প্রচলন রয়েছে।
ফুল দিয়ে মালা গাঁথার প্রচলন অনেক পুরনো দিন থেকে চলে আসছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন এলাকার নারীরা এই ফুলের মালা চুলে পরে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যে।
ফল - পাকা ফল খাওয়া যায়। মালয়'রা বকুল ফল সংরক্ষণ করে রাখে এবং আচার তৈরি করে।[৮]
কাণ্ড - অনেক এলাকায় বকুল গাছের কাণ্ড বা নরম ডাল দাঁত মাজার জন্যে ব্যবহার করা হয়। [৯]
কাঠ - বকুল কাঠ অনেক দামি আর দুষ্প্রাপ্য কাঠ। এর কাঠ অনেক শক্ত, কঠিন হয় কিন্তু খুব সহজে কাটা যায় আর খুব সুন্দর পালিশ করা যায়। এই কাঠের রঙ গাঢ় লাল। এই কাঠ ঘর-বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
সাহিত্য ও গান
বাংলার কবিতা ও গানে বকুল ফুল বারবার এসেছে:
”তুমি যে গিয়েছ বকুল বিছানো পথে” – অজয় ভট্টাচার্য
"তুমি কার লাগিয়া গাঁথোগো সখী বকুল ফুলের মালা" - মনির খান
”ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল আঁচল আকাশে হতেছে আকুল” – রবীন্দ্রনাথ
"বকুল ফুল, বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি!" - জলের গান