20/07/2022
শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থান
প্রেসিডেন্টের পলায়ন
বিক্ষোভকারীদের দখলে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। রয়টার্স থেকে নেওয়া
॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে একটি শান্তিপূর্ণ গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এতে পতন হয় ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে প্রবেশ করলেও কোনো ভাঙচুর চালায়নি, লুটপাট করেনি। তারা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে পাওয়া লাখ লাখ টাকা যথাযথ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে পুলিশের হাতে দিয়েছেন। নিজের পকেটস্থ করেননি। বিক্ষোভ সফল হওয়ার পর আন্দোলকারীরা সড়কে বিক্ষোভ করলেও সরকারি বা বেসরকারি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাননি। লুটপাট করেননি। জাতীয় সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ সরকারের প্রেসিডেন্ট বিক্ষোভের মুখে পালাতে নৌপথে চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। স্থলপথে পারেননি, আকাশপথে বাধার সম্মুখীন হয়ে দেশটির সামরিক ঘাঁটিতে আশ্রয় নেন, পরে সামরিক বিমানে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া’র ইচ্ছা ছিল আরব আমিরাতে যাওয়ার, সেই ইচ্ছাও তার পূরণ হয়নি। জনতার তোপে পড়ে তিনি সামরিক আশ্রয়ে দেশ ছেড়েছেন। তার এই পতন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, ৭৩ বছর বয়সী গোটাবায়া গত ১৩ জুলাই বুধবার প্রথম প্রহরে দেশ ছাড়েন, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বলেছে ১২ জুলাই মধ্যরাতে তিনি দেশ ছেড়েছেন। চরম অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কার মানুষ গত কয়েক মাস ধরে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। দেশ ছেড়ে পালানোর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ দেশে মহাপ্রতাপশালী রাজাপাকসে পরিবারের কয়েক দশকের কর্তৃত্বের লজ্জাজনক অবসান ঘটল। এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৩ জুলাই দেশটির কর্তৃপক্ষ জরুরি অবস্থা জারি করেছে। একইসঙ্গে কারফিউ জারি করা হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে। সূত্র: বিসিসি, আল-জাজিরা, রয়টর্স, এএফপি, এনডিটিভি।
যে কারণে বিক্ষোভ শুরু
শ্রীলঙ্কায় রিজার্ভ সংকট দেখা দেয়ার পর শুরু হয় জ্বালানি-সংকট। এর পরপরই ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের সংকটও দেখা দেয় দেশটিতে। এর জেরে শ্রীলঙ্কাজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ থেকে দাবি জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। এরপর মাহিন্দা রাজাপাকসে গত মে মাসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকেন। মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটি। এ পরিস্থিতি দেশটির রাজনীতিতেও উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে পারছে না দেশটি। এ কারণে ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে খাবার, ওষুধ ও জ্বালানির মতো অতি জরুরি আমদানিপণ্যের প্রয়োজন মেটাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। এ দুরবস্থার জন্য শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ মানুষ প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দায়ী করছেন। গত মার্চ থেকেই তাঁর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলছে রাজধানী কলম্বোসহ বিভিন্ন শহরে। গত ১০ জুলাই শুক্রবার কলম্বোজুড়ে তুমুল বিক্ষোভ হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১১ জুলাই শনিবারের বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে পড়েন। আর পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট। সেই থেকে বিক্ষোভকারীরা সেখানেই অবস্থান করছেন। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগপত্রে সই করার পর একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দেশটির বিরোধী দলগুলো। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা কোনো সর্বদলীয় সরকার চায় না। তারা চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যারা সংবিধান সংস্কার করবে এবং নতুন নির্বাচনের আয়োজন করবে। কে প্রেসিডেন্ট হবেন আর কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার চাইতে লঙ্কানরা একটি নতুন নির্বাচনের প্রত্যাশায় রয়েছেন। যে অভ্যুত্থান বিপ্লব উপহার দিতে পারছে না, তাকে অন্তত একটা নির্বাচন করে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখতেই হবে। সম্ভাব্য সেই নির্বাচনে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপরীতে সংস্কারপন্থী শক্তিগুলো ভালো করবে- এই প্রত্যাশাটুকুই কেবল চলতি গণঅভ্যুত্থানের প্রাপ্তি।
পালিয়ে মালদ্বীপে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট
পদত্যাগের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়েছেন। ১২ জুলাই দিবাগত রাতে একটি সামরিক বিমানে তিনি মালদ্বীপ গেছেন। অভিবাসন কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার ৭৩ বছর বয়সী নেতা গোটাবায়া, তাঁর স্ত্রী ও একজন দেহরক্ষীসহ চার যাত্রী নিয়ে সামরিক বিমানটি মধ্যরাতে বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালদ্বীপের উদ্দেশে রওনা করে। গত মার্চ থেকে শ্রীলঙ্কায় চলছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। গত ৯ জুলাই শনিবার শত শত বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার বাসভবনে ঢোকে। এরপর এদিন রাতে পদত্যাগের ঘোষণা দেন গোটাবায়া। ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার তাঁর পদত্যাগের কথা ছিল। এর আগে তিনি দেশ ছাড়লেন। তবে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া তার পদত্যাগপত্রে ১২ জুলাই মঙ্গলবার সই করেছেন। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর শ্রীলংকা পার্লামেন্টের স্পিকার তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে থাকেন। এটাই নিয়ম। জানা গেছে, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগপত্রে সই করা হয়েছে এবং তা এক সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তার কাছে হস্তাস্তর করা হয়েছে। স্পিকার মহিন্দা ইয়াবা আবেবর্ধনেকে পদত্যাগপত্রটির বিষয় অবগত করা হয়েছে।
যা চাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা
শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ বিক্ষোভকারী সর্বদলীয় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তারা চান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। যারা আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করবে। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণে সরকার গঠনে তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে এরপরও বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসবভনে অবস্থান করছেন। বিক্ষোভকারীদের ভাষ্য, এই দুই নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে সরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত দুই বাসভবন ছাড়বেন না তাঁরা। এমন পরিস্থিতিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। সাবির মোহাম্মদ নামে ২২ বছরের এক তরুণ আন্তর্জাতিক এ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা অনতিবিলম্বে গোটাবায়া রাজাপাকসে ও রনিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগ চাই। এরপর অন্তত ছয় মাস একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করবে। আমরা কোনো সর্বদলীয় সরকার চাই না।’ অধিকাংশ বিক্ষোভকারীই শ্রীলঙ্কান পদুজানা পার্টির (এসএলপিপি) বিরোধী। এই দলটির নিয়ন্ত্রণ রাজাপাকসের পরিবারের হাতে। সর্বদলীয় সরকার গঠিত হলে ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন বিক্ষোভকারীরা। মেলানি গুনাথিলাকে নামে ৩৫ বছরের এক নারী বলেন, বিক্ষোভকারী নেতারা সর্বদলীয় সরকারের কঠোর বিরোধী। তিনি বলেন, সর্বদলীয় সরকার গঠিত হলে রাজাপাকসে পরিবার পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তে পারে। গত ৫ জুলাই একটি কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেন বিক্ষোভকারীরা। সেখানে জনতা আরাগালয় (জনগণের সংগ্রাম) এর সদস্যদের মধ্য থেকে একটি গণপরিষদ গঠন করতে হবে, যা দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের বিষয়টি দেখভাল করবে এমন দাবি জানানো হয়। এছাড়া ছয় দফা দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা।
বিক্ষোভকারীদের অন্যতম আরেকটি দাবি হলো অন্তর্র্বর্তী সরকারের অধীন একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে, যা মানুষের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। আন্দোলনকারীদের আপাতত ৬টি দাবি। এক. প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দ্রুত পদত্যাগ করতে হবে। ইতোমধ্যে তিনি দেশ ছেড়েছেন। দুই. প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ও তাঁর সরকারকে অতিসত্বর ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তিন. একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। যার মেয়াদ হবে ন্যূনতম ১ বছর। চার. গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় এমন নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে এবং আগামী ১ বছরের মধ্যে এটা নিশ্চিত করতে হবে। পাঁচ. নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করা পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা কমাতে হবে, পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং ছয়. উল্লেখিত দাবিগুলো বাস্তবায়ন করা হবে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের মূল নীতি। বর্তমানে বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্বের কোনো কাঠামো বা একক কোনো সংগঠন নেই। তবে ইন্টার ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন যা বামপন্থী ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠন এবং জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) ছাত্র সংগঠন সোশ্যালিস্ট ইয়ুথ ইউনিয়ন বিক্ষোভে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সোশ্যালিস্ট ইয়ুথ ইউনিয়ন ইরাঙ্গা গুনাসেকারা আল-জাজিরাকে বলেন, সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে যাতে নিজেদের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি বেছে নিতে পারে, সেই পথ তৈরি করে দিতে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন করবেন পার্লামেন্টের স্পিকার। কিন্তু বর্তমান স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে রাজাপাকসে পরিবারের আত্মীয়। এ কারণে বিক্ষোভকারীদের আশঙ্কা তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলে অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হবে না।
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের যে বাঙ্কার নিয়ে আগ্রহী বিক্ষোভকারীরা
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের গোপন একটি বাঙ্কার নিয়ে বিক্ষোভকারীদেরও আগ্রহের কমতি নেই। এনডিটিভির ভিডিওতে দেখা যায়, বাংকারটির প্রবেশমুখ একটি আলমারি দিয়ে আড়াল করা ছিল। এটিতে প্রবেশের জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। আরও রয়েছে লিফট। এটির প্রবেশমুখে ধাতুর তৈরি ভারী দরজা রয়েছে, যা সহজে ভাঙা যাবে না। কেউ চাইলেও জোর করে এটি খুলতে পারবে না। এর মধ্য দিয়ে মূলত গোপন বাঙ্কারটির নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, দরজার চারপাশে অসংখ্য দাগ রয়েছে। অর্থাৎ বিক্ষোভকারীদের অনেকেই হয়তো এটি খোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই বলছেন, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া এই বাঙ্কারে লুকিয়ে রয়েছেন। সেখানে তিনি (গোটাবায়া) দুর্নীতি করে আয় করা কোটি কোটি রুপি রেখেছেন। আবার অনেকের ধারণা, প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গোটাবায় গোপন ও সুরক্ষিত এ পথ ব্যবহার করেছেন। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে থাকা ১ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার শ্রীলঙ্কান রুপির সন্ধান পেয়েছেন। পরে তাঁরা সেই অর্থ পুলিশের হাতে তুলে দেন।
জরুরি অবস্থা জারি
শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরই দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ১৩ জুলাই বুধবার সকালে দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন বলে বিবিসি জানিয়েছে। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে জারি করা হয়েছে কারফিউ। ১২ জুলাই মঙ্গলবার দিবাগত রাতে একটি সামরিক বিমানে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে দেশটিতে। হাজারো বিক্ষোভকারী জড়ো হন রাজধানী কলম্বোয়। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনেও বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ দমনে টিয়ার শেল ছুড়েছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেরও পদত্যাগ চাইছেন বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পথে
সংকটে শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সামনে শ্রীলঙ্কানদের কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এখনই আন্দাজ করা মুশকিল। তবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা চীনের প্রভাব কমতে পারে দেশটিতে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কলম্বোয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা স্বল্প মেয়াদের জন্য হলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ‘বড় প্রভাব’ ফেলবে। তাঁরা এই পরিস্থিতিকে চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্যও বার্তা বলে মনে করছেন। শ্রীলঙ্কার যত বৈদেশিক ঋণ রয়েছে, তার ১০ শতাংশ বা তার কম চীন এবং জাপানের কাছ থেকে নেওয়া। আন্তর্জাতিক বন্ডহোল্ডারদের কাছ থেকে বেশিরভাগ ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে বিক্ষোভকারীদের হামলার পর তিনি বলেন, তিনি পদত্যাগ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলেছে, গত ১১ জুলাই সোমবার মন্ত্রিপরিষদ একমত হয়েছে যে সর্বদলীয় অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনে চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। চীনের সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেছেন, আর্থিক সংকট নিয়ে কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভের পর সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এটি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আঘাত হবে। প্রায় দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী রাজাপাকসে পরিবারকে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করা হতো। যখন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন, তখন চীনের অর্থায়নে বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তোলা হয় দেশটিতে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। বিতর্কিত ঋণের অংশ হিসেবে ৯৯ বছরের চুক্তির অধীনে একটি চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে সমুদ্রবন্দরটি ইজারা দেয়া হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লিন আরও বলেন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চঋণ এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট শ্রীলঙ্কার এ সংকট চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ‘সতর্কবার্তা’। এসব বিনিয়োগকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছেন, যেসব দেশ জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি, খাদ্যঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান মার্কিন সুদের জন্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে লিন আরও বলেন, ‘আমি একে উচিত শিক্ষা পাওয়া বলব না। তবে একে বলব সতর্কবার্তা। কারণ বিদেশে বিনিয়োগ করার সময় স্থানীয় প্রশাসনের দক্ষতা বিবেচনায় নেয়া উচিত। বিশেষ করে যখন সামগ্রিক আন্তর্জাতিক পরিবেশ অনূকূলে নয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ঋণের অনুপাত সাধারণত খুব বেশি।’ সাংহাইয়ের এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শ্রীলঙ্কায় চীনের যে বিনিয়োগ, তার জন্য কিছু লোকসান গুনতে হতে পারে।
যেভাবে উত্থান-পতন হলো গোটাবায়ার
চেয়েছিলেন পদত্যাগ করবেন না! আর জনতাও ছিল নাছোড়, চেয়েছিলেন কেবল তারই পতন। নাটকের শেষ অঙ্কে টানটান উত্তেজনার শেষ পরতে উত্তেজিত জনতা প্রেসিডেন্ট ভবনে, সুইমিংপুলে, রান্নাঘরে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে আগেই সরকারি বাসভবন ছেড়ে পালালেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। অবশেষে এলো সেই কাক্সিক্ষত ঘোষণা, জানা গেল ১৩ জুলাই পদত্যাগ করছেন গোটাবায়া। ইতোমধ্যে তিনি পদত্যাগপত্রে সই করেছেন। ১৩ জুলাই স্পিকার তার পদত্যাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার কথা, কিন্তু ১৩ জুলাই বেলা দেড়টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত এ ঘোষণা আসেনি।
ইতিহাস বলছে, তামিল বিদ্রোহীদের সমূলে নির্মূল করে একসময় সিংহলীদের কাছে নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন গোটাবায়া ও তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। তাদের নামে আর ভারে দুটিতেই কাটতো সমানে সমান। ভাই মাহিন্দা শ্রীলংকার রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন প্রায় ২০ বছর। ২১ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন গোটাবায়া, দুই দশক সেই বাহিনীতে কাজ করে হয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তার পর স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি কাজ করতেন তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে। ২০০৫ সালে মার্কিন জীবনের ইতি টেনে এবার রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন গোটাবায়া। ভাইয়ের অধীনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজে যোগ দেন তিনি। এ সময় লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল এলাম (এলটিটিই) দমনের ভার নিজের হাতে নেন গোটাবায়া। ২০০৯ সালে তামিলদের ২৬ বছরের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে গোটাবায়া বাহিনী। শেষ কয়েক মাসের সেই সংঘাতে ৪০ হাজার বেসামরিক তামিল নাগরিককে লংকার সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল, জাতিসংঘের প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা যায়। তামিলদের স্বপ্ন হত্যা করে সিংহলীদের কাছে বীর বনে যান গোটাবায়া। ২০১৫ সালে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন গোটাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। ফলে শ্রীলংকার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের প্রভাবও কমতে থাকে। ২০১৯ সাল ইস্টার সানডেতে শ্রীলংকার গির্জায় সন্ত্রাসী হামলা; ২৫০ জনের প্রাণ যায়। আবারও জোরালো হয়ে ওঠে জাতীয় নিরাপত্তার দাবি। আর সেই সূত্র কাজে লাগিয়েই শ্রীলংকার মসনদ ফের দখলে নেয় রাজাপাকসে পরিবার। এবারের নায়ক মাহিন্দা নয়, সেই গোটাবায়া; যার হাত ধরেই তামিল নির্মূল হয়েছিল। লঙ্কানরা ভাবল তার হাতেই নিরাপদ থাকবে তাদের দেশ। তবে এবার বিধিবাম, ৯ জানুয়ারি ২০২০ সালে প্রেসিডেন্টের আসনে বসা গোটাবায়াকে ২০২২ সালের জুলাইয়েই ক্ষমতার ইতি টানতে হয়েছে।
রনিল বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট : স্পিকার
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার।
শ্রীলঙ্কার স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে বলেন, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে তাকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিতে। সংবিধানের ৩৭ ধারার ১ অনুচ্ছেদের আওতায় এই নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
গত ১৩ জুলাই বুধবার বিবিসি অনলাইনে শ্রীলঙ্কার চলমান অস্থিরতা নিয়ে দেয়া লাইভ আপডেটে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
রনিল বিক্রমাসিংহকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি গোটাবায়া। এমনকি গোটাবায়ার সম্প্রতি দেয়া সব ঘোষণাই হয় পার্লামেন্টের স্পিকার, না হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে আসছে।
এদিকে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে গণআন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন দেশটির সাধারণ মানুষ। তাঁরা গোটাবায়া ও রনিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এখন দেখার বিষয়, স্পিকারের এ ঘোষণার পর বিক্ষোভকারীরা কী প্রতিক্রিয়া দেখান।