04/07/2025
#ছোটগল্প
#বালিশ
এক
সকাল থেকেই চুলার পাড়ে বসে খুন্তি নাড়ছে হনুফা বিবি। মন মেজাজ জায়গামত নাই। তাই খুন্তি নাড়ানাড়িতে অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই শব্দ হচ্ছে।
একটু আগে ছেলের বউ মরিয়ম এসে রান্নাবান্নার জিনিসপাতি এগিয়ে দিয়েছে। শাশুড়ির মেজাজ বুঝে একটু কাটাকুটিও করে দিতে চেয়েছিল। হনুফা বিবির মেজাজ তাতে আরো চড়ে গেছে। মুখ বাঁকিয়ে বলেছে, ‘অন্যদিন তো হাজার ডাকলেও সহজে এই মুখা আসো না! আইজ এক্কেরে তরকারি কুইটা দিবার আইছ? মাথায় এত বুদ্ধি গিজগিজ করে তুমার!’
এই অভিযোগ সত্য না। বরং অন্যদিন বেশিরভাগ রান্না মরিয়মই করে। শাশুড়ি এসে মন চাইলে একটু কুটাবাছা করে দেয়। মন চাইলে কখনো রান্না করে। কোনোদিন কিছুই করে না। অল্পবয়সী আনাড়ি মরিয়ম একা একা বাড়ির সবার জন্য তিন চার পদের রান্না করে।
তার শ্বশুর সাদাসিধা মানুষ। কিছু একটা পাতে পড়লেই তিনি খুশি। একমাত্র দেবরেরও খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনো বাই নাই। সে সারাদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। ক্ষুধা লাগলে বাসায় এসে চারটা মুখে গুঁজেই আবার বের হয়ে যায়। আর মরিয়মের স্বামী তো বাড়িতেই থাকে না!
শাশুড়ির খাওয়াদাওয়ায় অনেক বাছবিচার। দেশি ডিম ছাড়া খেতে পারে না। তরকারিতে বেগুন দিলে নিজেও তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। যা যা খেলে চুলকানি হয়, কিছুই তার তরকারিতে দেওয়া যাবে না। ভাত বেশি নরম হলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, শক্ত হলে সেদিন ভাতই খায় না। হাজার বায়নাক্কা।
সেগুলো মাথায় রেখে মরিয়ম শাশুড়ির জন্য আলাদা সালুন রান্না করে। ভিন্ন পাতিলে যত্ন নিয়ে ভাত বসায়। কিন্তু এতকিছু করেও শাশুড়ির মন পাওয়া হয় না মরিয়মের। পান থেকে চুন খসলেই তিনি বাতাসে কথা ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ‘কপাল কইরা আইছিলাম গো! এত্ত বড় কপাল আমার! বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি কুনোখানেই কুনোদিন ঠেকন লাগেনি। খালি বউয়ের হাতের রান্ধন খাওনের কপাল হয়নি আমার! দুইটা সালুন রান্ধতে গিয়া কত কী ব্যাড়াছারা করছে! বলি ও গো বউ! বাপের বাড়িত থিকা কি কিছুই শিইখা আসো নাই?’
আজ সকাল থেকেই শাশুড়ির রান্নাঘরে আসার প্রধান কারণ হচ্ছে, তার বড় পুত্র সুজন আজ বাড়িতে এসেছে। সুজন শহরে চাকরি করে। গার্মেন্টসের ম্যানেজার। দুই মাসে একবার বাড়িতে আসতে পারে। তিন চারদিনের বেশি থাকতে পারে না। ঘরে তার আটমাসের বিয়ে করা বউ। শহরে মন টেকে না। কিন্তু গার্মেন্টসের চাকরিতে এত ঘন ঘন ছুটিছাঁটা পাওয়া যায় না।
সুজন বাড়িতে এলেই মরিয়মের শাশুড়ির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বউ যাতে খুব বেশিসময় স্বামীকে একা না পায়, সেই চেষ্টায় তার কমতি থাকে না। বেশি একা পেলেই বিপদ! আড়ালে বসিয়ে কী না কী কানপট্টি দিতে থাকবে তার কোনো ঠিক আছে?
এদিকে ছেলের কাছে নিজের ইমেজটাকেও তো মজবুত রাখতে হবে। ছেলে যাতে ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে, সব রান্নাবান্না তার বউই করে। বরং এই সুযোগে ছেলেকে বুঝিয়ে দিতে হবে, বৃদ্ধা মায়ের দেখাশুনার কাজটাও তার বউ ঠিকমত করে না! উল্টো রান্নাবান্নার দায়িত্ব থেকে এই বয়সেও তার নিষ্কৃতি মেলেনি।
সেই উদ্দেশ্যেই হনুফা বিবি আজ সকাল থেকেই রান্নাঘরে।
ছেলের বউ যতবার ঘরের ভেতরে ঢুকছে, হনুফা বিবির কড়াইখুন্তির ঝনঝনানিও ততই বেড়ে চলেছে। ছেলে মায়ের পাশে বসে কোথায় দু চারটা সুখ দুঃখের কথা বলবে, তা না! কিছুক্ষণ পরে পরেই ‘ও বউ কই গেলা?’ মনে মনে গজর গজর করে হনুফা বিবি, ‘অসভ্য পোলা, প্যাটে থুইলাম আমি, অখন বউই হইল সব! নিমকহারাম!’
দুই
হনুফা বিবি রান্নাবান্না শেষ করে সবে মোড়া থেকে গা টা তুলেছে, এমন সময় সদর দরজা থেকে হাঁক ভেসে এলো, ‘মা, ও মা... দরজা হাট কইরা খুইলা থুইছ ক্যান? ছিঁচকা চোরের অভাব পড়ছেনি গেরামে?’
হনুফা বিবির বুকটা ধড়াস করে উঠল। তার মেয়ে কুসুমের গলা না? হ্যাঁ তাই তো! এইভাবে খবরটবর না দিয়ে তো কুসুম আসে না! আজ হঠাৎ এভাবে আসার কারণ কী? খারাপ কিছু হয়নি তো? ধড়মড় করে সামনে এগুতে গিয়ে শাড়ির আঁচলে পা বেঁধে হনুফা বিবি রান্নাঘরের সিমেন্টের মেঝেতে একেবারে ধড়াম করে পড়ে গেলেন।
একে তো সকাল থেকেই তার মেজাজটা হয়ে আছে খারাপ। তার ওপরে এই বেআক্কেল আছাড় খেয়ে হনুফা বিবি গগনবিদারী চিৎকার জুড়ে দিলো, ‘ওরে আল্লাহ্ রে!...’
ঘর থেকে ছেলে ছেলের বউ ছুটে এলো। চিৎকার শুনে মেয়ে কুসুমও এক দৌড়ে ‘ও মা কী হইল তুমার’ বলে মায়ের পায়ের কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কুসুমের গোমড়ামুখো জামাই এই হুলুস্থুলের মধ্যে পিছন থেকে একটু উঁকি দিয়েই আবার মুখ নামিয়ে ফেলল। শাশুড়ির বেহাল দশা দেখে সম্ভবত লজ্জাতেই মুখ লুকালো সে।
হনুফা বিবি তখনো মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ‘ওহ মা গো ওহ বাবা গো’ বলে চেঁচিয়েই চলেছে। ব্যথা যত না তার শরীরে লেগেছে, মনে লেগেছে কয়েকগুণ।
বউ মরিয়মকে রান্নাবান্নার আশেপাশে ভিড়তে না দিয়ে লাভের লাভ কিছু হয়নি। বউ আর ছেলের এতে আরো পোয়াবারোই হয়েছে। দুজনে ঘরের দরজায় খিল মেরে দিয়ে মনের সুখে প্রেম করেছে। মা যে এদিকে রান্নাঘরে হেদিয়ে মরছে, সেটা নিয়ে ছেলের কোনো হেলদোলই নেই! মাঝে একবার শুধু ঘর থেকে একটু ফুচকি মেরে বলেছে, ‘ও মা, তুমার হাতের মাশকলাইয়ের ডাল ম্যালাদিন খাই না! আইজ এট্টু মাছের কাঁটাকুটা দিয়া রাইন্ধ! হাউশ মিটাইয়া খামু!’
বলেই আবার ঘরে ঢুকে পড়েছে। দুঃখে হনুফা বিবির জবানই বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। পোলার বউ নির্লজ্জ বেহায়ার মতো স্বামীর সাথে সোহাগ করছে, আর তাকে কী না এই গরমের মধ্যে সিদ্ধ হয়ে মাশকলাইয়ের ডাল রান্না করতে হচ্ছে!
কুসুম মায়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু ধাতস্থ করে বলল, ‘তুমি রান্নাঘরে কী করতাছ? ভাবি কই?
মরিয়ম আজ সকাল থেকে কয়েকবার পাকের ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছে। শাশুড়ি তাকে আজ পাকের ঘরে ঢুকতেই দেয়নি! এই অল্পদিনের সংসারেই মরিয়ম সংসারের নাড়িনক্ষত্র বুঝে গিয়েছে। ছেলের চোখে ত্যাগী মায়ের তকমা পেতে শাশুড়ি আজ আদাজল খেয়ে লেগেছে। ওদিকে স্বামীর মনও উচাটন হয়ে আছে। পরশুদিন সকালবেলাতেই সে শহরে চলে যাবে। এই দুইদিনে বউকে সে ক্ষণে ক্ষণে চোখে হারাচ্ছে। এদিকে শাশুড়ির চোখের সামনে ঘরে খিল এঁটেও বসে থাকা যায় না। বারকয়েক আপত্তি করতেই স্বামী কপট রাগ দেখিয়ে বলেছে, ‘ওমুন করলে কইলাম কাইলই চইলা যামু! আর আসুম না!’
মরিয়ম পড়েছে মহা বিপদে। শেষমেশ লাজ শরমের মাথা খেয়ে তাকে ঘরে ঢুকে খিল দিতে হয়েছে। শাশুড়ির মেজাজ যে ওদিকে ফুটন্ত পানির মতো টগবগ করে ফুটছে, সেটা তাকে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না!
মেয়ের কথায় হনুফা বিবি ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় জামাইয়ের দিকে চোখ পড়তেই শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘ও মা জামাইও আইছে দেখি! ও কুসুম একটা খবর দিয়া আইবি না?’
কুসুম মুখ ভেটকিয়ে বলল, ‘ভাইজানরে তো ফোন দিছিলাম! কইছিলাম আমরা আইতাছি! ভাইজান যে তুমারে কয়নি, সেইডা আমি ক্যামনে জানুম?’
সুজন জিভ কেটে বলল, ‘এ্যাহ হে, তুই যে কাইল ফোন দিছিলি এক্কেরে ভুইলা গেছি!’
হনুফা বিবি খুব গোপনে ছোট করে একটা ভেংচি কেটে বলল, ‘হ তুমি অখন দুনিয়া ভুইলা বইসা আছ। তুমার কি আর কিছু মনে থাকব!’
তিন
হনুফা বিবির মেয়ের জামাই হাসান মোল্লা রাশভারী মানুষ। দশটা কথা বললে সে ভেবেচিন্তে একটার উত্তর দেয়। সে এবারে পৌরসভার ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। এই ভোটের ক্যাম্পেনিং করার জন্যই সে দীর্ঘদিন পরে শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েছে।
কুসুমের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। এখন অব্দি সে মা হতে পারেনি। দুজনের কারো সমস্যা আছে কী না জানতে চাইলে কুসুম মাথা নিচু করে ফেলে। তার মাথা নিচু করাতে হনুফা বিবির ধারণা হয়েছে, সমস্যাটা তার জামাইয়ের। নিজের বরের অক্ষমতার কথা বলতে কোন মেয়েরই বা ভালো লাগে?
জামাইকে দেখে তড়িঘড়ি মাথায় একটা ঘোমটা টেনে দিয়ে হনুফা বিবি কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। ছেলে আর ছেলেবউয়ের দিয়ে অপাঙ্গে একটা ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে মেয়েকে বলে, ‘ভাইয়ের কাছে ফোন না দিয়া আমারে ফোন দিবার পারস নাই? ওহন জামাইরে কী খাওয়াই!’
কুসুম টেনে টেনে বলে, ‘ক্যা, পোলার লাইগা রান্ধ নাই? তুমার জামাই কি বিরাট খাদক নাকি?’
কুসুমের বর হাসান মোল্লা হাঁড়ির মতো মুখে একটু ঝুঁকে পড়ে শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করার একটা ভঙ্গি করল। বলল, ‘আমরা কাইল সকালেই চইলা যামু আম্মা। ম্যালা কাম বাকি আছে। আপনাগো দোয়া লইতে আইছি। একটু দোয়া কইরা দিয়েন!’
হনুফা বিবি গদগদ হয়ে বলে, ‘দোয়া তো করুমই বাবা! তুমি চেয়ারম্যান হইলে গর্বে আমাগো বুকডা কত ফুইলা যাইব!’
সুজন একটু কথা বলার সুযোগ পেয়ে বলে, ‘দুলাভাই কাইলই যাইবেন গা এইডা কেমুন কথা? আমি আইছি... আরেকটা দিন থাকতে হইব!’
হাসান মোল্লা গম্ভীর মুখে বলে, ‘আচ্ছা দেখি... ম্যালা কাম।’
সুজনের বাবাও বাসায় ফিরে মেয়ে আর মেয়েজামাইকে আরেকটা দিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ করে। কুসুম বিয়ের পর বাপের বাড়িতে তেমন একটা আসার সুযোগ পায় না। এই নিয়ে তার মা হনুফা বিবির দুঃখের সীমা নাই। বিয়ের এত বছর পরেও সে তার স্বামীকে নিজের বশে আনতে পারেনি দেখে হনুফা বিবি দিনরাত আফসোস করে।
কুসুমের শ্বশুরবাড়ি পাশের গ্রামেই। কিন্তু তার শাশুড়ি বেজায় কড়া। কুসুমের বরও বউয়ের কথায় তাল দেয় না। মা যা বলে সেটাই শেষ কথা।
শ্বশুরবাড়ি আসার আগে হাসান মোল্লার মা পান চিবুতে চিবুতে ছেলেকে বলে দিয়েছে, ‘শ্বশুরবাড়ি যাইতাছ যাও! বেশি গড়াগড়ি দিবার যাইয়ো না! বেশি গড়াগড়ি দিলেই কইলাম ধরা খাইবা। দিন গিয়া দিন ফেরত আইতে পারলে বেশি ভালা। সেইডা না পারলে পরদিন বিয়ানবেলাই চইলা আইবা। বাড়ি আইসা বউ লইয়া নাস্তা করবা। বউরে আবার বাপরে বাড়ি থুইয়া আইসো না!’
সকলের মিলিত অনুরোধে হাসান মোল্লা জীবনে প্রথমবারের মতোই একটু দোটানায় পড়ে। তাছাড়া সে একটু অন্য হিসাবনিকাশও করছে। ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে। একটু মন রক্ষা করে না চললে যদি এদিকের সমর্থনটা না জোটে! সেই কারণেই যত টানাপোড়েন! নইলে মায়ের কথার এদিক ওদিক করার মতো ছেলে সে নয়। মায়ের কথার ওপরে আর কথা নাই।
তবু এবারে সে টলল। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে আম্মা। আপনারা যখন এত কইরা কইতাছেন তখন কালকের দিনটা থাইকাই যাই!’
হনুফা বিবির অসময়ে যেন দুই ঈদ লেগে গেল। জামাই পুরো দুইদিন থাকবে, এটা তো ভাবাই যায় না। তার ওপরে কুসুম তাকে এক ফাঁকে জানিয়েছে, শাশুড়ি একদিনের বেশি না থাকার ব্যাপারে কড়াভাবে বলে দিয়েছিল। জামাই এবারে তাদের কথাকে মায়ের কথার ওপরে স্থান দিয়েছে, এ তো রীতিমত অকল্পনীয় ব্যাপার!
দুপুরবেলা মেয়ে মেয়েজামাইকে ভালোমত খাইয়ে দাইয়ে হনুফা বিবি মেয়েকে নিজের ঘরে ডেকে আনল। ছেলে আর ছেলের বউয়ের নকরামি দেখেও না দেখার ভান করছে এখন। আগে তার মেয়ের সংসার ঠিক করে দিতে হবে। ছেলের বউকে কীভাবে টাইট দেওয়া যায় সেটা পরে ভাবলেও চলবে।
চার
‘মা তুমি কী সব কথা জিগাও। আমি পারুম না এত কিছু কইতে!’ কুসুম লজ্জায় লাল হয়ে মাকে বলল।
হনুফা বিবি মেয়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘ঐ ছেড়ি! যা জিগাইতাছি ঠিক ঠিক কইরা ক! বিয়ার এত বছর হইয়া গ্যালো! অহনো তর প্যাট ফুলল না। জামাই কি ডাকেডুকে না?’
কুসুম গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। মায়ের কথাগুলো শুনে তার খুব লজ্জা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে অন্যরকম ঝড়ও বইছে। তার স্বামী মানুষটা রাশভারী হলেও কুসুমের সমস্যা ছিল না। কিন্তু মানুষটা বড্ড বেশি মা পাগল। মাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করুক না, কে না করেছে? কিন্তু এই পাগলামি অন্যরকম। মায়ের কথার ওপর সে আর দ্বিতীয় কোনো কথাই শোনে না!
বিয়ের পরে সে যাতে ঘন ঘন বাপের বাড়ি না আসতে পারে, সেজন্য তার শাশুড়ি নানারকম কথাবার্তা বলে স্বামীর কান ভারি করে রেখেছে। কুসুমের কোনো কথাই চলে না ও বাড়িতে। স্বামীর কাছে মুখ বড় করে একটা কিছু বললে স্বামী ধমক দিয়ে বলে ওঠে, ‘আহ! তুমি থামো! বেবাক কথার মইধ্যে না সান্ধাইলে হয় না তুমার? দেহি মা কী কয়। মায়ে যেইডা কইব সেইডাই হইব!
বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না দেখে কুসুমের মনে কষ্ট থাকলেও স্বামীর তাতে কোনো চিন্তাভাবনা নাই। কারণ কুসুমের শাশুড়ি তাকে শুনিয়েই ছেলেকে বলেছে, ‘পুরুষ মাইনষের দুই তিনডা বিয়া হইলে সমস্যার কিছু নাই। এক বউ সন্তান দিবার না পারলে আরেকজন দিব। সন্তান হওনডাই হইল আসল কথা! কার কাছ থেইকা হইতাছে হেইডা বিষয় না!’
এই কথা শোনার পর থেকে কুসুম দিনরাত আড়ালে চোখের পানি ফেলে। স্বামী তাকে একটা মোবাইলও কিনে দেয়নি যে মাকে ফোন করে একটু মনের কথা বলে। একদিন মোবাইলের কথা বলতেই হাসান মোল্লা খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, ‘তুমি মোবাইল দিয়া করবাডা কী? দিনরাত ফেসবুক চালাইবা আর বেগানা পুরুষ মাইনষের লগে ইটিস পিটিস করবা! ঘরের বউরে নষ্ট করোনের লাইগাই ওইসব আইছে দুনিয়ায়!’
কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে হনুফা বিবি যা বোঝার সব বুঝে নিলো। মেয়ে যে তার স্বামীকে মোটেও হাত করতে পারেনি, সেটা তার অভিজ্ঞ চোখে ঠিকই বুঝে নিয়েছে। মনটা বিষাক্ত হয়ে গেল হনুফা বিবির। তার নিজের দুটো ছেলেমেয়েই ক্যাবলাকান্ত হয়েছে। পরের মেয়ে মরিয়ম এসে তার ছেলেটাকে একেবারে কুরবানি করে ফেলেছে। দিনরাত মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে। অথচ তার নিজের মেয়ে কুসুম স্বামীটাকে একটুও বশ করতে পারেনি। বোঝাই যাচ্ছে, হাসান মোল্লা কোনোভাবেই স্ত্রীর প্রতি আসক্ত নয়। হয়ত সেই কারণেই বাচ্চাকাচ্চা হতেও দেরি হচ্ছে।
মেয়েকে আরেকটু শক্তমতো চেপে ধরল হনুফা বিবি। মায়ের এত চাপাচাপিতে কুসুম আর পারল না। ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে আসল কথা খুলে বলল। শাশুড়ি যে তার ছেলের কানে আরেকটা বিয়ের বাজনা বাজিয়ে দিয়েছে, এটাও সে চেপে রাখতে পারল না।
সব শুনে হনুফা বিবির মাথায় বাজ পড়ল। তলে তলে এতদূর চলে গিয়েছে সবকিছু! অথচ তিনি মা হয়েও এসবের কিছুই জানেন না!
মেয়ে খুব একটা বাপের বাড়িতেও আসতে পারে না। এলে না হয় গাধি মেয়েটাকে একটু বুদ্ধিশুদ্ধি দিয়ে লাইনে আনা যেত! পুরুষ মানুষ হচ্ছে শিং মাছের মতো। ধরতে গেলেই হাতে কাঁটা ফুটায়ে দেয়। সহজে ধরা দিতে চায় না। কিন্তু একবার যদি সাইজমতো ধরা যায়, সোজা বটির নিচে ঘ্যাঁচাং! জীবনে আর মাথা তোলার সাধ্য নাই।
হনুফা বিবি কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় স্বামীর ডাক শুনে কুসুম পড়িমরি করে বাইরে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, ‘মা, বাড়িত কি নরম বালিশ নাই? তুমার জামাই তো শক্ত বালিশে শুইবার পারে না!’
‘থাকব না ক্যা? ম্যালা বালিশ তুইলা থুইছি।’
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই হনুফা বিবির মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘তুই জামাইয়ের লাইগা বিছানাটা ঝাইড়া দিয়া আয়। আমি বালিশ বাইর করতাছি!’
মাত্র কিছুদিন আগে কুসুমের কথা চিন্তা করেই একটা তাবিজ বানিয়ে এনেছিল হনুফা বিবি। স্বামী বশীকরণের তাবিজ। এতদিন মেয়েকে দেওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সেটার কথা মনে পড়তেই আর দেরি করল না হনুফা বিবি। হাতে সময় কম। চট করে তাবিজটা বালিশের মধ্যে ভরে সেলাই করে দিতে হবে।
দেরি না করে কাজে নেমে পড়ল সে।
পাঁচ
মায়ের ঘর থেকে বালিশ নিয়েই কুসুম ছুটল তার স্বামীকে দিতে।
একটু দেরি সহ্য করতে পারে না হাসান মোল্লা। সামান্য বালিশ পেতে এত দেরি হওয়ায় তার কপাল কুঁচকাতে শুরু করেছে।
ওদিকে তড়িঘড়ি কাজে ফাঁকফোকর থাকতে পারে ভেবে হনুফা বিবি একটু সময় নিয়ে বালিশটা ভালো করে সেলাই করে দিয়েছে। ভেতরে তাবিজটা ভরে দিয়ে কয়েকবার দোয়া দরুদ পড়ে ফুঁ দিতেও ভুল করেনি। তার দেরি দেখে কুসুম অধৈর্য হয়ে বলেছে, ‘ও মা, তুমি কি বালিশ সেলাই কইরা দিতাছ নাকি? এত দেরি করতাছ ক্যান?’
মাকে বালিশের ধার সেলাই করতে দেখে কুসুম অবাক গলায় প্রশ্ন করে। ভেতরে তাবিজ গুঁজে দেওয়ার বিষয়টা সে জানে না।
হনুফা বিবি শান্ত গলায় বলে, ‘বেবাক কিছুতে খালি হৈ হৈ করলেই চলে না বুঝলি? ভালা কইরা সেলাই কইরা না দিলে যদি তুলা বাইরাইয়া যায়!’
কুসুমের মাথায় কিছুই ঢোকে না। বালিশের তুলা কেন বের হয়ে যাবে এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারে না।
মেয়ের হাতে বালিশ তুলে দিয়ে হনুফা বিবি লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ভাবে, এইবার তার মেয়ের সংসার ভাঙে কার সাধ্যি!
কুসুমকে বালিশ হাতে ব্যস্তভাবে হাঁটতে দেখে সুজন জিজ্ঞেস করে, ‘কীরে, বালিশ লইয়া দৌড় লাগাইছিস ক্যা?’
কুসুম ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘তিনি বালিশ চাইছেন। নরম বালিশ। শক্ত বালিশে ঘুমাইবার পারেন না।’
সুজন বোনের হাত থেকে বালিশটা টেনে নিয়ে বলে, ‘এইডা তর নরম বালিশ? খাড়া আমার বালিশটা লইয়া যা। ঐডাও নতুন, আরো নরম। এইডা আমারে দে।’
কুসুম না করার সুযোগ পায় না। সুজন বালিশ হাতে নিয়ে ততক্ষণে নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। ঘর থেকে তার জন্য সদ্য বানানো নরম তুলতুলে বালিশটা এনে বোনের হাতে দিয়ে বলে, ‘দুলামিয়ার লাইগা সেরা বালিশ। দ্যাখ কেমুন নরম!’
কুসুম ভাইয়ের দেওয়া বালিশটা হাতে নিয়ে খুশি হয়। আসলেই তো! এটাই বেশি তুলতুলে। এই বালিশে মাথা দিলে স্বামীর গরম মেজাজ ঠাণ্ডা হতে সময় লাগবে না।
ওদিকে কুসুমের কাছ থেকে বালিশটা নিয়ে সুজন বিছানায় কাত হয়। মরিয়মকে খুঁজতে থাকে মনে মনে। বউ তার চড়ুইপাখির মতো ইচিং বিচিং করে নেচে বেড়ায়। কোথায় একটু পাশাপাশি শুয়ে গল্প করবে, তা না!
সুজন বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। আকাশে ঘন করে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে ঝমঝমিয়ে। সেই আকাশভরা মেঘের মধ্যে মরিয়ম দৌড়ে দৌড়ে তারে মেলে দেওয়া কাপড় তুলছে। মাথার আঁচল পড়ে গিয়ে একরাশ ঘন কালো চুল এলিয়ে পড়েছে পিঠের ওপরে।
সুজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
#ফাহ্মিদা_বারী