21/09/2025
আমরিন বেগম মারা গেছেন আজ সন্ধ্যেবেলা। সেন্ট্রাল হসপিটালের পাশের গলি থেকে তখন মাগরিবের আজান ভেসে আসছিল। গত কয়েকদিন ধরে উনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। বড়ো ছেলে রাশেদ তখন হাসপাতালেই ছিল। ডাক্তার আগেই বলে দিয়েছিলেন, বাঁচবে না।
সুমি যখন আমরিন বেগমের মৃত্যু সংবাদ পায় তখন সবে ওজু করে নামাজে দাঁড়াবে। রাশেদের ফোন দেখেই বুক ধক করে উঠেছিল। রাশেদ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের মৃত্যু সংবাদ দেয়। সুমির যেন কেমন দিশেহারা লাগে। শাশুড়ি মা শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন! নামাজটা পড়বে নাকি এখুনি হাসপাতালে দৌড়ুবে?
অবশ্য রাশেদ নিজে থেকেই 'না' করে। হাসপাতাল থেকে লাশ বাসায় আনবে। শুধু শুধু যাবার দরকার নেই। ছেলে রিফাত এসে পাশে দাঁড়ায়। খবরটা শুনেই কেঁদে ফেলে। রিফাতের সঙ্গে তার দাদুর বেশ খাতির ছিল। কলেজের সব গল্প দাদুর সঙ্গে করত।
রিফাত ভাঙা গলায় বলে, 'মা, আমি হাসপাতালে যাব।'
সুমি চোখ মুছে বলে, 'হ্যাঁ, যা। তোর বাবা ওখানেই আছে।'
রিফাত চলে যেতেই সুমি কেমন একলা হয়ে পড়ে। একবার আমরিন বেগমের রুমে উঁকি দেয়। পরিপাটি করে গুছানো একটা রুম। এবার হাসপাতালে যাবার আগেও বার বার করে বলে গেছেন, ওনার রুম যেন ঠিকঠাক পরিষ্কার করে রাখা হয়। একটু পরিষ্কারের বাতিক ছিল। আহারে, সেই মানুষটা আর ফিরে আসবে না।
সুমি নামাজ শেষ করে আজ সময় নিয়ে মোনাজাত করে। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পঁচিশ বছর আগে এই বাসায় এসেছিল। এতটা বছর একসঙ্গে থাকা। আজ হুট করে মানুষটা চলে গেল।
আমরিন বেগমের সঙ্গে সুমির সম্পর্কটা প্রথম থেকেই সহজ ছিল না। মনে পড়ে, বিয়ের পর বাবার বাড়ি থেকে একটা স্টিলের আলমারি দিয়েছিল। সেটা নিয়ে আমরিন বেগম কত কথা শুনিয়েছিল। আলমারিটা এই বাসার সিঁড়ি কোঠায় তিনদিন পড়ে ছিল। কেন সেগুন কাঠের আলমিরা দেওয়া হয়নি তাই নিয়ে রাশেদের মা, দুই বোন অনেক কথা শুনিয়েছিল। এরপর প্রায়ই পিছে পড়ে থাকত। সুমি তখন সবে অনার্স পাস করে চাকরির চেষ্টা করছে। রান্নাটা ঠিক জানত না। তাই নিয়ে প্রতি বেলায় খোঁটা শুনতে হতো। একটা সময় চাকরি হলো। সেটা নিয়েও কম যন্ত্রণা হয়নি। রাশেদও শেষ পর্যন্ত মায়ের পক্ষ নিয়েছিল। বলেছিল চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু সুমি ততদিনে একটা কথা বুঝে গিয়েছিল, ও চাকরি ছেড়ে দিলে একদম তলিয়ে যাবে। সারাজীবন শুধু কথাই শুনে যেতে হবে। চাকরি সামলে, বাসার রান্নাটাও ঠিকঠাক করে রাখত তখন। ভীষণ কষ্ট হতো। কিন্তু আমরিন বেগম সব বুঝেও যেন না বোঝার ভান করে থাকত। বরং বেশি বেশি করে রান্নার খুঁত ধরত, কাজের খুঁত ধরত।
তারপর বিয়ের বয়স যত বাড়ল আমরিন বেগমের কথার ধার কমলেও রয়ে গেল। ছেলে বড়ো সরকারি চাকুরে সেই নিয়ে সব সময় একটা নাকউঁচু ভাব নিয়ে থাকতেন। রাশেদ মাতৃভক্ত ছেলে। মায়ের এমন খোঁচানো স্বভাব দেখেও না দেখার ভান করে থাকত।
একটা সময় সুমি রান্নার লোক রেখে নিল। তারপর থেকে বাসায় একটু কথা কম হতো। উনি ওনার রুমে থাকতেন, সুমি এদিকটায়। খাবারের টেবিলে শুধু দেখা হতো।
সুমির আজ কেন যেন আফসোস হয়। মানুষটার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা ভালো হয়নি। সুমির মনে অনেক অভিযোগ ছিল, কষ্ট ছিল। একটা সময় অভিমান করেই দূরে দূরে থাকত। আজ সেই চিরকাল কথা শোনানো মানুষটা চলে গেলেন। আর কেউ অমন করে ফোড়ন কাটবে না। পঁচিশ বছর পর আজ যেন মুক্তি হলো। কিন্তু এই মুক্তিতে কোনো আনন্দ নেই। উলটো মন খারাপ হচ্ছে। মানুষটা এতদিন ছিল। কথা কম হতো, তবুও তো ছিল!
সুমি তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। একটু পরেই রাশেদের দুই বোন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ঢুকে। খানিকক্ষণ পর রাশেদ। সবাই জড়াজড়ি করে কান্না করে। এলাকার মুরুব্বিরা উপদেশ দেন রাতেই দাফন করে ফেলতে।
সেদিন রাতেই আমরিন বেগমের দাফন হয়ে যায়। সুমি সেদিন সারাক্ষণ রাশেদের পাশেই জড়িয়ে থাকে। মা চলে গেলে একটা মানুষ যে অনেক একা হয়ে যায়।
পরের দুটো দিন সুমি, রাশেদ কেউই অফিসে যায় না। রাশেদ চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝে চোখ ভিজে ওঠে। সুমি যতদূর পারে সান্ত্বনা দেয়।
কয়েকদিন পর যখন শোক কমে আসে তখন এক ছুটির দিনে রাশেদের দুই বোন, তাদের হাসব্যান্ড, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এই বাসায় আসে। তিন ভাইবোন মায়ের পুরনো অনেক স্মৃতি নিয়ে গল্প করে। সুমি অবশ্য রান্নাঘরে ব্যস্ত। রান্নার খালা একা পেরে উঠছে না। সবাই আজ রাতে এই বাসাতেই খাবে।
রাতের খাওয়া শেষে রাশেদের বড়ো বোন নার্গিস কথায় কথায় বলে, 'রাশেদ, আম্মার আলমারিতে যে কাঠের বাক্স আছে সেইটা খোল। আম্মা আমারে বলে গিয়েছে ওই বাক্সে নাকি গহনা আছে। আর সেগুলো ভাগ করে রেখে গেছে।'
সুমি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আমরিন বেগমের রুমে সেই স্টিলের আলমারিটা ছিল যেটা উনি প্রথম প্রথম বাসায় ওঠাতে দেননি। পরে এটাতেই উনি তার সবকিছু রাখতেন। নিজের টুকটাক কিছু গহনা ছিল সেগুলো এই আলমারিতে রেখেছেন এটা সুমির অজানা। ভেবেছিল মেয়েদের কাছে আছে।
রাশেদের ছোট বোন সাবরিনাও তার বড়ো বোনের সঙ্গে সুর মেলায়। তাদের হাসব্যান্ড দুজন এখন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। মনে হচ্ছে এসব কথা কানে যায়নি।
রাশেদ একবার অসহায় চোখে সুমির দিকে তাকায়। তারপর আমতাআমতা করে বলে, 'সুমি, আলমারির চাবি তোমার কাছে?'
সুমি গম্ভীরমুখে বলে, 'আমার কাছে নেই। হাসপাতালে যাবার আগে আমাকে তো কিছু দিয়ে যাননি।'
নার্গিস তার হাতব্যাগ থেকে একটা চাবির গোছা বের করে রাশেদের হাতে দেয়। তারপর বলে, 'আমার কাছে দিয়ে রেখেছিল। এখানে সব চাবি আছে। এখন আলমারিটা খুল তো।'
সুমির ভীষণ কষ্ট হয়। সারাজীবন ওর সঙ্গে থেকেও মানুষটা ওকে আপন করে নিতে পারল না।
সুমি শুকনো গলায় বলে, 'তোমরা আলমারি খোল। আমি একটু রান্নাঘর গুছিয়ে আসি।'
সুমির এই কথায় কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না কিংবা থাকার জন্য জোর অনুরোধ করে না। মনে হচ্ছে তারা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
অবশ্য শেষ মুহূর্তে রাশেদ গম্ভীরমুখে বলে, 'তুমি এখানে থাকো। রান্নাঘর পরে গুছিও।'
সুমি একটা নিশ্বাস ফেলে খাটের এককোণে বসে।
রাশেদ উঠে গিয়ে আলমারি খুলে কারুকাজ করা একটা কাঠের বাক্স বের করে। সবাই নড়েচড়ে বসে। সবার চোখ এখন বাক্সের দিকে।
রাশেদ বাক্সটা ছোট্ট একটা চাবি দিয়ে খোলে। কয়েকটা ছোট ছোট মখমলের থলে। জুয়েলারি দোকান থেকে সাধারণত এমন থলে দেয়। প্রতিটি থলের গায়ে নাম লিখা। রাশেদ প্রথমে নার্গিস আপার থলেটা বের করে। আপার হাতে দিতেই সেটা লুফে নেয়। দ্রুত খুলে ভেতরের গহনা বের করে।
এক জোড়া ভারী কানের দুল, একটা টিকলি, একটা আঙটি।
এরপর সাবরিনার নাম লিখা থলেটা বের করে। এখানে একটা গলার চেইন, আঙটি, আর একটা পায়েল।
নার্গিস তেড়ছা চোখে ছোট বোনের গহনাগুলো দেখছিল। গলার চেইনটা এক ভরি হবে। পায়েলটাও এক ভরির কাছাকাছি হবে। আম্মা সাবরিনাকে গহনা বেশি দিয়ে গেল!
নার্গিস এবার খর চোখে তাকিয়ে বলে, 'আম্মার যে মোটা মোটা দুইটা বালা ছিল সেগুলো কই?'
কথাটা বলে একবার আড়চোখে সুমির দিকে তাকায়। সুমি কেমন সংকুচিত হয়ে যায়। আসলেই তো, বালা দুটো কই? বিয়ের পর আমরিন বেগমকে এগুলো পরে থাকতে দেখত। পুরনো আমলের ভারী দুটো বালা। একেকটা দুই ভরি করে।
রাশেদ এবার বড়ো একটা থলে বের করে। তারপর সেটা সুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, 'নাও, এটা খোলো।'
সুমি কপাল কোঁচকায়, 'আমি এটা নেব কেন? আমাকে তো উনি কিছু দিয়ে যাননি।'
রাশেদ বিষণ্ণ হাসে, 'এখানে তোমার নাম-ই লেখা।'
সুমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে নীল রঙের মখমলের থলেটার গায়ে যে সাদা কাগজটা জড়িয়ে আছে সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে ওর নামটা লেখা। আমরিন বেগমের হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল।
সুমি হাত বাড়িয়ে থলেটা নেয়। তারপর মুখটা খুলতেই ভেতর থেকে সেই বালা দুটো লাজুক উঁকি দেয়। সুমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। ধীরে ধীরে বালা দুটো বের করে সামনে রাখে। আর নার্গিস আর সাবরিনা বিস্ফারিত চোখে বালা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মা সুমিকে বালা দুটো দিয়ে গেল!
নার্গিস নীল মখমলের থলেটার গায়ে যে কাগজ লাগানো ছিল সেটা খামচে তুলে নিয়ে পরখ করে দেখে। নাহ, ঠিকই আছে। মায়ের হাতের লেখা। তারপরও সন্দেহের গলায় বলে, 'এটা কী করে সম্ভব! কোথাও গোলমাল হয়নি তো?'
সুমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমরিন বেগম তার সবচেয়ে দামি বালা জোড়া ওকে দিয়ে গিয়েছে।
রাশেদ ধমকে বলে, 'গোলমাল হবে কেন? চাবি তো তোর কাছেই ছিল।'
নার্গিসের মুখ কালো হয়ে যায়। সাবরিনার মন একটু আগেও ফুরফুরে ছিল। বড়ো আপার চেয়ে আম্মা ওকে বেশি গহনা দিয়েছে। কিন্তু এখন এই দৃশ্য দেখে মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
সুমি উঠে দাঁড়ায়। তারপর নার্গিসের দিকে তাকিয়ে বলে, 'আপা, এই বালা জোড়া আপনারা দুই বোন ভাগ করে নিন। আম্মা হয়তো ভুলে আমার নাম লিখেছেন।'
নার্গিসের চোখ চকচক করে ওঠে। সাবরিনাও কেমন একটা চোখে তাকায়।
রাশেদ বিরক্ত গলায় বলে, 'এই বালা জোড়া আম্মা তোমাকে দিয়ে গেছে। সেটা তুমি অন্য কাউকে দেবে কী করে? উনি যা করেছেন চিন্তাভাবনা করেই করেছেন। এই নিয়ে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।'
পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে। একটা সময় অসন্তুষ্টি নিয়ে বিদায় নেয়।
সুমি কেমন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। আমরিন বেগম তাহলে ওকে মনে মনে আদর করত? কই, কখনও তো মুখ ফুটে কিছু বলেনি?
সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে রাশেদ ওর কাছে এসে বসে। তারপর গভীর গলায় বলে, 'সুমি, আম্মা লাইফ সাপোর্টে যাবার আগে বালা জোড়ার কথা আমাকে বলে গিয়েছিল। আমিও তোমার মতো অবাক হয়েছিলাম। আম্মা বলল, সারাজীবন সুমি আমার যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সুখেদুঃখে তো এই বাসাতেই ছিলাম। তাই ওই বালা জোড়ার হক সুমির।'
সুমির কেন যেন কান্না পাচ্ছে। এই কয়েকটা দিন এই কথাটাই ঘুরেফিরে মনে হচ্ছে। এই এতটা বছর সুখেদুঃখে একসঙ্গেই তো ছিল। মাখোমাখো সম্পর্ক হয়তো ছিল না কিন্তু কোথায় যেন একটা টান ছিল। লাউয়ের তরকারি পছন্দ করতেন। সুমি প্রায়ই সেটা রান্না করে দিত। মনে মনে যে মানুষটা খুশি হতো আজ তা বোঝা গেল। একটা সম্পর্ক সবসময় ওপর থেকে দেখে হয়তো বোঝা যায় না যে ভেতরে ভেতরে একটা শক্ত বাঁধন তৈরি হয়ে গেছে।
রাশেদ এবার উঠে গিয়ে বালা জোড়া নিয়ে আসে। সুমিকে অনুরোধ করে পরার জন্য। সুমি ধীরে সুস্থে বালা জোড়া পরে। মনে হয় অদৃশ্য একটা হাত ওকে বালা জোড়া পরিয়ে দিচ্ছে। হাত দুটো চোখের সামনে মেলে ধরে৷ আলো পড়ে বালা দুটো কেমন ঝিকমিক করে ওঠে। আমরিন বেগম হয়তো এখন আশেপাশেই আছেন। আর মিটিমিটি হাসছেন যে শেষবেলাতেও ওকে দারুণ জব্দ করে গেলেন।
#অদৃশ্য_বাঁধন
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২০/০৯/২০২৫