26/05/2025
নিজের জনপ্রিয়তা বুঝতে পেরে কাজী নজরুল ইসলাম ভাবলেন, এবার তিনি নির্বাচনে অংশ নিবেন!
নির্বাচনটি ছিলো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচন। এর আগে তিনি বিভিন্ন প্রার্থীর হয়ে নির্বাচনী জনসভায় অংশ নেন। জনসভায় গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে প্রার্থীর পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।
নজরুল লক্ষ্য করেন, তিনি যখন স্টেজে উঠেন, তখন সবাই তার জন্য তালি দেয়, উচ্ছ্বসিত হয়। প্রার্থীর জন্যও মানুষ এতোটা আগ্রহ দেখায় না, যতোটা দেখায় তার জন্য।
এটা ভেবে তার মনে হলো তিনি তো প্রার্থীদের চেয়েও জনপ্রিয়! আর কতো এভাবে অন্যের হয়ে ভোট চাইবেন? তিনি নিজেই দাঁড়িয়ে গেলেন।
সমগ্র ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিলো দুটো। দুই আসনে মোট প্রার্থী ছিলেন পাঁচজন। পাঁচজনের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুজন হবেন নির্বাচিত।
পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে তিনজনই ছিলেন বড়ো বড়ো জমিদার। বরিশালের জমিদার ইসলাইল হোসেন চৌধুরী, ময়মনসিংহের জমিদার আব্দুল হালিম গজনভি এবং ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা আবদুল করিম। বাকি দুজন হলেন- মফিজউদ্দিন আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম।
নির্বাচনে লড়াই করার জন্য নজরুলের পকেটে ছিলো বিধানচন্দ্র রায়ের দেয়া মাত্র ৩০০ টাকা। অন্যদিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাকি তিনজন জমিদার!
এখানে, নজরুলের সেই সময়কার আর্থিক অবস্থা উল্লেখ করলে 'দুখু মিয়ার' তৎকালীন পকেটের অবস্থা বুঝতে সুবিধা হবে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কয়েক মাস পূর্বে তার দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম হয়। পুত্রের জন্ম সংবাদ পেয়ে নজরুল তার প্রকাশক বজ্রবিহারী বর্মণকে চিঠি লিখে ২৫ টাকা পাঠাতে বলেন। তিনি জানিয়ে দেন, টাকাটা তার খুব দরকার, ধার করে হলেও যেনো টাকা পাঠানো হয়।
অভাব-অনটনের সেই সময় লিখেন তার বিখ্যাত কবিতা 'দারিদ্র্য'। কবিতার শেষাংশে কবি উল্লেখ করেন তার অভুক্ত পুত্রের ক্ষুধার জ্বালা। কবির ভাষায়:
"সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!
পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?"
এর ঠিক কয়েক মাস পর কবি নির্বাচনের ক্যান্ডিডেট! তৎকালীন সময়ে সবাই ভোটার হতে পারতো না। মোটামুটি স্বচ্ছল ব্যক্তিরাই ভোটার হতে পারতেন। কারণ, ভোটার হবার জন্য নূন্যতম বাৎসরিক কর দিতে হতো। নজরুল সেই সময়ে যাদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ভোটার ছিলেন না।
সমগ্র ঢাকা বিভাগে মোট ভোটার ছিলো মাত্র ১৮,১১৬ (আঠারো হাজার একশো ষোলো) জন।
কাজী নজরুল ইসলামের দরকার ভোট। স্পেসিফিকলি বললে মুসলিমদের ভোট। অথচ 'বিদ্রোহী' কবিতা সহ আরো কয়েকটি কবিতা, গানের জন্য তিনি মুসলিম সমাজে সমালোচিত। অনেকেই তাকে 'কাফের' ফতোয়া দিয়েছেন।
'লেখক নজরুল' পাবলিক সেন্টিমেন্টকে তোয়াক্কা না করলেও এবার 'প্রার্থী নজরুল' পাবলিক সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দেন। তিনি চলে যান ফরিদপুরের নামকরা পীর বাদশাহ মিয়ার কাছে। বাদশাহ মিয়াকে অনুরোধ করেন তার পক্ষে যেনো একটি ফতোয়া লিখে দেন, যাতে মানুষ তাকে ভোট দেয়।
পহেলা নভেম্বর বাদশাহ মিয়া একটি কাগজে কাজী নজরুল ইসলামের পক্ষে ফতোয়া লিখে দেন- ভোটাররা যেনো কাজী নজরুল ইসলামকে ভোট দেয়!
কাজী নজরুল ইসলামের নির্বাচনী প্রচারণায় সঙ্গ দেন পল্লীকবি জসীমউদদীন। বাংলা সাহিত্যের দুই শ্রেষ্ঠ কবি নামলেন নির্বাচনী প্রচারণায়। কাজী নজরুল ইসলাম জসীমউদদীনকে বুঝালেন, "ঢাকায় আমি শতকরা ৯৯ ভাগ ভোট পাবো, ফরিদপুরে তোমার এলাকায় কয়েকটা ভোট পেলেই কেল্লা ফতে; আমি জিতে যাবো!"
দুই কবি মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতেন নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে। মানুষ চা অফার করতো। আর নজরুলের নীতি ছিলো- "চায়ে কোনো 'না' নেই।" নির্বাচনী প্রচারণায় কাজী নজরুল ইসলাম একদিন ৭২ কাপ চা খান!
জনসমর্থন আদায়ে দুজন ফরিদপুরের তমিজউদদীন খানের বাড়ি যান। সেখানে একজন বলে উঠলো, আপনি তো 'কাফের', আপনাকে ভোট দেবো কেনো? তখন নজরুল একটা একটা করে তার কবিতাগুলো আবৃত্তি করেন। যখনই 'মোহররম' কবিতাটি আবৃত্তি করেন, তখন সেই অভিযোগকারী কেঁদে দেয়!
নির্বাচনের দিন জসীমউদদীন নজরুলকে একটি কৌশল বলেন- "আপনি একটি ভোটকেন্দ্রে বসে থাকুন। মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবার সময় আপনাকে দেখতে পাবে। আপনার কথা মনে পড়বে, আপনাকে ভোট দেবে।"
নজরুল কবির কথামতো ঠিকই ভোটকেন্দ্রে বসে পড়লেন।
যেই কবি আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেছিলেন ঢাকায় ৯৯ ভাগ ভোট পাবেন, নির্বাচনের ফলাফল দেখে সেই কবির চোখ কপালে উঠে।
নির্বাচনের ফলাফল ছিলো:
১. ইসমাইল হোসেন খান চৌধুরী ৬০৬১ ভোট পেয়ে বিজয়ী।
২. আব্দুল হালিম গজনভি ৫৭৬৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী।
৩. আব্দুল করিম ২০৪৩ ভোট পেয়ে পরাজিত।
৪. কাজী নজরুল ইসলাম ১০৬২ ভোট পেয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত।
৫. মৌলভী মফিজউদ্দীন আহমদ ৫২০ ভোট পেয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত।
আকাশচুম্বী জনপ্রিয় কবির নির্বাচনে জয়ী হওয়া যে আকাশকুসুম চিন্তা ছিলো, সেটা বুঝতে কাজী নজরুল ইসলামকে একবার নির্বাচন করতে হয়। এরপর নজরুল দ্বিতীয়বার আর এই ভুল করেননি। তবে, নজরুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন বাংলার আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্মলেন্দু গুণ আওয়ামীলীগের মনোনয়ন চান। আওয়ামিলীগ থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিশেবে নেত্রকোণা-বারহাট্টা আসন থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তার নির্বাচনী প্রতীক ছিলো বেশ বিচিত্র- কুমির। সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কেনো কুমির প্রতীক নেন? এটার পেছনে কি কবির কোনো উদ্দেশ্য আছে?
নির্মলেন্দু গুণ জানান- "আমি নিজে অত্যন্ত নিরীহ মানুষ। তার উপর স্বতন্ত্র প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আমাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখুক এমন কোনো নিরীহ প্রতীক বেছে নেয়াটা বোকামী হবে ভেবেই আমি এই প্রতীক বেছে নিয়েছি। আপনারা সবাই জানেন যে কুমির সমীহ আদায় করার মতো প্রাণী। জলের রাজা এবং প্রয়োজনে স্থলেও উঠে আসতে পারে। সুতরাং...।"
কাজী নজরুল ইসলাম তার নির্বাচনের সময় পাশে পেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী কবি জসীমউদদীনকে। তেমনি নির্মলেন্দু গুণও নির্বাচনের সময় পাশে পান বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে। দুজনই ছিলেন একই এলাকার। নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচনের জামানতের টাকা দেন হুমায়ূন আহমেদ।
কাজী নজরুল ইসলামের মতো নির্মলেন্দু গুণও নির্বাচনে পরাজিত হোন, এমনকি জামানত হারান। নির্মলেন্দু গুণ ভোট পান ১২৪৯ টি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত কোনো বিখ্যাত কবি কোনো নির্বাচনে জিতেননি। তবে, রাষ্ট্রপ্রধান হবার পর কবি হবার ঘটনা আছে!
জেনারেল এরশাদ ৯ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। সেই সময় প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম পাতার তার লেখা কবিতা প্রকাশিত হতো। এমন কবিভাগ্য পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোনো কবির (!) ছিলো কি-না বলা মুশকিল!
------
|| রাজনীতির মাঠে কাজী নজরুল ||
- আরিফুল ইসলাম
১৮ ডিসেম্বর ২০২১
fans
বইপোকা - BookWorm
Jakaria Riimon