Tvista Bangla

Tvista Bangla Visit our website: tvista.org
(5)

05/02/2025

ফ্যাসিবাদের 'আইকন' ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি ভেঙে ফেলছে শিক্ষার্থীরা

19/12/2024

কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের জিঞ্জিরা শাখায় রূপালী ব্যাংক ডাকাতি, ব্যাংকের ভেতরে অবরুদ্ধ ডাকাতরা

"মুহসীন হলে ছাত্রলীগের নির্যাতনের ইতিহাস।"“আমি অসহায়ভাবে শুধু আল্লাহকে ডাকতে থাকি, চোখের পানি আর থামছিল না। চারপাশের সব...
05/12/2024

"মুহসীন হলে ছাত্রলীগের নির্যাতনের ইতিহাস।"

“আমি অসহায়ভাবে শুধু আল্লাহকে ডাকতে থাকি, চোখের পানি আর থামছিল না। চারপাশের সবকিছু ধোঁয়াটে হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের ভয়ঙ্কর কথাগুলো ঠিকই আমার কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল। হঠাৎ জহির বলে উঠলো, ‘ছুরিটা বের কর, ওর রগ কাটা হবে।’ সেই মুহূর্তে আমার পুরো শরীর স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হলো, এখানেই সব শেষ— হয় আমাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলবে, নয়তো রক্তাক্ত করে ফেলে রাখবে। কিন্তু বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশা নিয়ে আমি আরও দৃঢ়ভাবে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম, তিনিই তখন আমার একমাত্র ভরসা!”

২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার পর আমার জায়গা হয়েছিল হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের 'গণরুমে'। সেই রুমটিকে আমি প্রথমে স্বাভাবিক মনে করেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে তা যেন এক অন্ধকার কারাগারে পরিণত হলো। প্রথমদিকে ১০ থেকে ১২ জন ছাত্র টিনশেডের এক রুমে একসাথে থাকতাম, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০ জনে। আমরা সবাই যেন কোনো অদৃশ্য শৃঙ্খলে বন্দি, নতুন পরিবেশে একাকীত্বে হারিয়ে যাওয়া কিছু ছাত্র।

কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের পরিচয় হয় ‘গেস্ট রুম’-এর সঙ্গে। গেস্ট রুম জিনিসটা ছিল এক শালিস-নালিশ-বিচার বা তথাকথিত কঠোর শৃঙ্খলা শিক্ষার কেন্দ্র । ছাত্রলীগ পুরো হল নিয়ন্ত্রণ করত। সময়ে অসময়ে তারা ফোন দিয়ে বলত ‘ভাইটাল প্রোগ্রামে’ মধুতে ‘ভাইয়ের প্রোটকল’ দিতে যেতে হবে। এমনকি ক্লাসের মাঝেও তারা ফোন দিয়ে ডাকত। দেরী হলেই রাতের গেস্টরুমে পানিশমেন্ট। ছাত্রলীগের নেতারা ফোন দিয়ে দোকান থেকে রুমে সিগারেট নিয়ে দিতে বলত। কখনো টাকা দিত, কখনো দিতনা। রাতে আবার থাকতো ক্যাম্পাস চেনার প্রোগ্রাম। যেখানে বিনা কারনে সারারাত ক্যাম্পাস দিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে অমুক-তমুক ভাইয়ের নামে মিছিল দিয়ে শেষরাতে হলে ফেরা হত আমাদের। শীতের দিনেও এমনকি নিস্তার ছিলনা। কখনোবা জায়গা না পেয়ে ঘুমাতে হত ছাদে। সকালেই আবার ঝিমাতে ঝিমাতে যেতে হত ক্লাসে। প্রতিটি ছাত্র ছিল এক নিষ্ঠুর নিয়তির শিকার।

কে কোন ঘরে থাকবে, কার উপর নির্যাতন হবে, এসবের সকল সিদ্ধান্ত ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে ছিল। গেস্টরুম আমাদের কাছে ভীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে প্রায়শই শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো। সময়মতো প্রোগ্রামে না গেলে বা সিনিয়রদের সালাম করতে ভুল হলে আমাদের নির্দয় শাস্তি দেওয়া হতো।

এরপর এল সেই কালো রাত—২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট।

ঢাবিতে আমার দ্বিতীয় বর্ষ তখন। ২০১৭ সালের ১৭ আগস্টের সেই রাতটি ছিল নরকযন্ত্রণা সহ্য করার এক অন্ধকার অধ্যায়। আগস্ট মাস আসলেই ছাত্রলীগের মাথার ঠিক থাকে না। যদিও তারা এই মাসকে শোকের মাস হিসেবে দাবি করে, কিন্তু কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় এটি তাদের উল্লাসের মাস। সেই বছর আগস্ট মাসে তাদের ‘শিবির ধরার উৎসব’ চলছিল। তখন ঢাবির হলগুলোতে ছাত্রলীগের জাকির-সোহাগ/প্রিন্স-আবিদ কমিটির সেন্ট্রাল কমান্ডে চলত “শিবির ধরা” এই অভিযান, যার নির্মম বলি হয়েছে শতশত ছাত্র। ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পেতে তাদের একমাত্র উপায় ছিল ‘শিবির’ ধরো, পিটাও আর পদ-পদবী নাও। যে যত বেশি ‘শিবির’ ধরে পিটাতে পারবে–পুলিশে দিতে পারবে–সে তত বেশি বিশ্বস্ত এবং সে তত বড় পদ-পদবী পাবে।

১৭ আগস্টের ঘটনা শুরু হয় যখন এস এম খালেদ (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ২০১৪-১৫ সেশন) আমাকে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে আমার ফোন ও ফেসবুক চেক করতে থাকে। সেদিনের পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিল এস.এম. খালেদ, মেহেদী হাসান মিজান (ইতিহাস, ২০১৪-১৫ সেশন) এবং শাহাদাত হোসেন সোহেল (একাউন্টিং, ২০১৪-১৫ সেশন)। খালেদের মেইন গেস্টরুমে পায়ের উপর পা তুলে মহাবিচারকের ভঙ্গিতে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের চিত্র এখনো স্পষ্টভাবে চোখে ভেসে ওঠে। ফেসবুক এক্টিভিটি লগ চেক করার এক পর্যায়ে খালেদ আমাকে গালি দিয়ে বলে ওঠে, "তুই শিবির, ফেসবুকে এসব কী লিখছিস?"

যখন শুনি তারা বলছে শিবির ধরছি, তখন ভয়ে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। আমি তাদের কাছে হাত পা জড়িয়ে ধরি এবং বলি, "ভাই, আমি কখনো শিবির করি নাই, শিবির কী জানি না, আমাকে মাফ করে দিন।" তারা আমার ফেসবুকের কিছু ইসলামিক পেইজে লাইক দেওয়ার কথা উল্লেখ করে, বললো, "যদি তুই শিবির না হোস, তাহলে ইসলামিক পেইজে কেন লাইক দিস? পত্রিকায় কী লিখেছিস"। আমি তখন কোনো যুক্তি দিতে পারিনি, কারণ কে কোথায় লাইক দিবে, পেপারে কি লিখবে এটুকু নাগরিক স্বাধীনতা একজন ঢাবি ছাত্রের থাকবেনা? তাছাড়া একজন মুসলিম হিসেবে ইসলামিক পেইজে লাইক দেওয়াকে আমি অন্যায়ও মনে করিনি।

তারপর আমাকে টেনে হিচড়ে মারতে মারতে তিন তলায় মুহসীন হলের ছাত্রলীগ সভাপতি জহিরুল ইসলামের (আরবি বিভাগ, ২০০৯-১০ সেশন) রুমে নিয়ে যায়। তাদের সাথে আরও অনেকেই ছিল তবে খালেদ, মিজান, সোহেল, ইমতিয়াজ (শুভ্র) (হেলথ ইকোনোমিক্স, ২০১২-১৩ সেশন), আরিফ (ফিন্যান্স, ২০১৪-১৫ সেশন), আশিক (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ২০১২-১৩ সেশন) এবং ইমরানের (দর্শন, ২০১৪-১৫ সেশন) কথা বিশেষভাবে মনে আছে। চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুসি আর গালিগালাজে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলো খালেদ, মিজান আর সোহেল। জহিরের সামনে আমাকে রেখে খালেদ আমার ফোনটা জহিরের কাছে দেয়। সে ফেসবুক দেখিয়ে দেখিয়ে নালিশ দেয় যেন আমি বিশাল কোনো অপরাধ করেছি, আর তারা সেটির প্রমাণ হাজির করছে আদালতে।

জহির গালি দিয়ে বললো, "এই শুয়োরের বাচ্চা শিবির, এসব কী লিখছিস? এইসব পেইজে লাইক দেওয়া কেন?"। এরপর উত্তরের আশা না করেই আমাকে নির্মমভাবে মারতে শুরু করে। একটা স্টাম্প দিয়ে পাগলের মতো আঘাত করতে থাকে—প্রথম আঘাতেই আমার শরীর কেঁপে উঠল। প্রতিটি আঘাতে মনে হচ্ছিল আমার হাড়গুলো যেন ভেঙে যাচ্ছে, ত্বক ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে বারবার আঘাত করতে লাগে, যেন আমি কোনো জড় বস্তু। একপর্যায়ে স্ট্যাম্প ভেঙ্গে যায়। আমি জহিরের পা জড়িয়ে ধরি। তখন সে আমাকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দেয়। এরপর জি আই পাইপ ও রড দিয়ে আমাকে আবার মারতে থাকে।

প্রথমদিকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হলেও কিছুক্ষণ পর আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে যাই। শরীরে আঘাতের পর আঘাত চলছে, কিন্তু আমি তাদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে ছিলাম। আঘাতে আঘাতে আমার হাতের আলনা-রেডিয়াস হাঁড়গুলো ভাঙতে থাকে, যেগুলোর এক্স-রে এখনো আমার কাছে রয়েছে।

আমি চিৎকার করতে থাকি, যেন কোনোভাবে কেউ এসে আমাকে রক্ষা করবে। কিন্তু তাদের সেই শয়তানি পরিকল্পনা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। তারা সাউন্ড সিস্টেম চালিয়ে আমার চিৎকার ঢেকে দিচ্ছিল, যেন বাইরের কেউ সেই নরকযন্ত্রণা শুনতে না পায়। একের পর এক আঘাতে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, আর তখনও জহির, সাইফুর (মনোবিজ্ঞান, ২০০৯-১০ সেশন) আর মেহেদী হাসান সানি (শিল্পকলার ইতিহাস, ২০১২-১৩ সেশন) হেসে বলে, "যত চিল্লাস, তোর চিৎকার এখানেই হারিয়ে যাবে।" আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয়, "তোদের কমিটিতে কে কে আছে?" তারা কাগজ আর কলম এগিয়ে দেয়, নাম লিখতে বলে। কিন্তু আমি কাঁপা কণ্ঠে শুধুই বলি, "ভাই, আমি সত্যিই জানি না কিসের কমিটি, কীভাবে বলব?"।
এরপর এস.এম. খালেদ আবার এগিয়ে এল। সে আমার মোবাইল তল্লাশি করে আরো কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকল, যেন আমার উপর তাদের প্রতিটি আঘাতের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারে। যেন কেউ শিবির করলে তাকে নির্যাতনের লাইসেন্স পাওয়া যায় (যদিও আমি কখনোই ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্ট ছিলাম না)।

নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমি বমি করি এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি । কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসলে আবার একই প্রশ্ন করা হয়। এই সময় সাইফুর (ঢাবি ছাত্রলীগের আইন সম্পাদক), জহির এবং অন্যান্যরা আমাকে পালাক্রমে মারতে থাকে। মা-বাবা তুলে জঘন্য সব গালি দিতে থাকে সাইফুর। খালি গায়ে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিয়ে কিছু একটা খেতে খেতে ২য় রাউন্ড, ৩য় রাউন্ড করে এভাবে আমাকে মারতে থাকে এই নরপিশাচ।

এরপর দৃশ্যপটে আসে সানি (মুহসীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক)। সানির চোখেমুখে ছিল হিংস্র এক দৃষ্টি, যেন সে এই অত্যাচারে অংশ নেওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে একটি জি আই পাইপ হাতে নিয়ে আমার পায়ে আঘাত করতে শুরু করল। প্রতিটি আঘাতে আমার শরীরের রগগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে আমাকে বারবার শিবির সদস্যদের নাম জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কিন্তু আমি কাউকে চিনতাম না। সানি আমার ব্যথা উপেক্ষা করে আঘাত করতে লাগল, যেন আমার যন্ত্রণা তার আনন্দের উৎস।

ততক্ষণে আমার রক্তে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছিল। আমার বমি, রক্ত ও ওদের দেওয়া পানির ছিটা মিলে পুরো ফ্লোরকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল যেন।
এর পরে পাশের রুম থেকে কেউ একজন একটা ছুরি নিয়ে আসে। আমাকে ওরা মুহসিন হলের ছয় তলার ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার হুমকি দিতে থাকে। ব্যথায় আমার “আল্লাহ গো’’, “মাগো” বলে চিৎকার যেনো বাইরে না যায় সে জন্য ওরা আমার মুখে কিছু একটা গুজে দেয় ও সজোরে সাউন্ড বক্স চলতে থাকে। আমি আল্লাহকে ডাকতে থাকি, কান্না করতে থাকি। তাদের প্রশ্নগুলো আমার কানে আসে না। কেউ আমাকে পানি খেতে দেয়, কিন্তু সাইফুর বলে প্রসাব খেতে। তার উল্লাস আর বর্বরতা যেন সবকিছুকে হার মানায়। জহির হঠাৎ কাউকে বলে, "ছুরিটা বের কর, ওর রগ কাটা হবে।" আমি ধরে নিই, আমাকে হয় ওই রুমে মেরে ফেলবে অথবা ছাদ থেকে ফেলে দেবে। তখন রাত সাড়ে ১২টা বা ১ টা বাজে।

এর পর হাসিবুল আলম সৌরভের (ফিন্যান্স, ২০১৫-১৬ সেশন) সাথে মিলে তারা নিজেরা একটি সন্দেহভাজন শিবির লিস্ট তৈরি করে এবং দ্বিতীয় বর্ষের আরও তিনজন এবং তৃতীয় বর্ষের একজনকে ধরে আনে। আমাকে আধমরা করে ফেলে রেখে দ্বিতীয় বর্ষের মাসরুরকে (ভিক্টিম-২) আনে। সে মাদ্রাসার ছাত্র ছিল, মুখে ছিল কিছু দাঁড়ি। আর যায় কোথায়?
তারা যখন মাশরুরকে বলে উঠল, "এই শুয়োরের বাচ্চা তো খাঁটি শিবির," আমার মৃতপ্রায় শরীর যেন আবার কেঁপে উঠল। কীভাবে এত নৃশংস হতে পারে মানুষ? ওরা আমার মতোই মাশরুরকে কুকুরের মতো পেটাতে লাগল। একের পর এক আঘাত। আর আমি দেখছিলাম, নিজের আসন্ন ভাগ্য যেন আমার সামনে সিনেমার মতো চলে আসছিল। এরপর ইরফানকে (ভিক্টিম-৩) ধরে আনল। ইরফানও মার খাচ্ছে, একই প্রশ্ন—লিস্টে কে আছে? আর মানুষ কীভাবে এত নিষ্ঠুর হতে পারে, তা বুঝতে পারছি না। প্রতিটি আঘাত যেন জীবনের শেষ মুহূর্তের বেদনার ঢেউ তুলছিল।

এরপর আনা হল তৃতীয় বর্ষের গাফফার (ভিক্টিম-৪) ভাইকে । আমি জানতাম, এবার আরও খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। উনার বন্ধুরা, ব্যাচমেটরা সবাই ছিল ঘটনাস্থল জহিরের রুমের দরজায়, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। একা, নিঃসঙ্গ, ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা তার। কেউ তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করল না। আমার মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু নেই।

মেহেদীকে (ভিক্টিম-৫) যখন ধরে আনা হলো, তখনও একই চিত্র। সবাই মারছে, কেউ তার পাশে নেই। আর আমি? আমি তখন ভাঙা হাত-পা নিয়ে গড়াতে গড়াতে বিভিন্ন জনের পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো পরিচিত মুখগুলো আমাকে রক্ষা করবে। হেলথ ইকোনোমিক্সের সিনিয়র ইমতিয়াজ শুভ্র। স্কাউটিংয়ের সময় পরিচয়। ভেবেছিলাম, হয়তো সে আমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু না! ইমতিয়াজ শুভ্রও লাথি মেরে আমাকে ফেলে দিল, আর বলল, "আমি ওকে চিনি না”।
এই বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে আরও ভেঙে দিল। আমাকে আর বাকি সবাইকে পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হলো। আমার ডান হাতের কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙুলের গোড়া হতে ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, দুই হাঁটুর জয়েন্ট স্থানচ্যুত হয় ও পায়ের মধ্যভাগ ভেঙে যায়, মাথায়ও রডের আঘাত লেগে কেটে রক্ত ঝরতে থাকে । আমার হাত-পা ভাঙা, দাঁড়াতে পারছি না, পা ফুলে গেছে। কেউ বুঝল না, আমি শারীরিকভাবে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায়ও নেই। গালি দিতে দিতে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামালো তারা। তখন মনে হচ্ছিল, আমি আর কখনো নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারব না। নিচে ফেলে রাখা হলো আমাদের, রাত তখন আনুমানিক আড়াইটা।

আমাদের উপর অত্যাচারের সেই মুহূর্তগুলো যেন ক্রমেই লম্বা হতে থাকল, এবং একসময় নিচে কিছু সাংবাদিক চলে আসল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? হলে একটা ঘটনা ঘটেছে অথচ তাদের পাওয়াই গেলনা। আমাদের রক্ষা করতে কোনো উদ্যোগ কেউ নিল না। আমাদের তৎকালীন হল প্রভোস্ট ছিল নিজামুল হক ভুঁইয়া (পরবর্তীতে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি)। পরে জেনেছি কেউ কেউ তাকে ফোন করে জানিয়েছিল এই বর্বরতার কথা। তার বাসভবন হলের একদম পাশেই ছিল, হাত বাড়ালেই পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু তিনি আসেন নি। হলের হাউস টিউটরেরাও তো ছিলেন! হাউস টিউটরের মধ্যে ছিলেন আমদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই একজন শিক্ষক। তিনি ফেসবুকে অনেক নীতিকথা লেখেন কিন্তু তারই বিভাগের দুজন ছাত্র এভাবে নির্যাতিত হল। নাম নিচ্ছি না, কিন্তু তিনি কি অনুতপ্ত বোধ করেন? ভিসি মোঃ আখতারুজ্জামান ও প্রক্টর এ এম আমজাদও কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। তারা কেউ কিছু জানলেন না! নাকি জানতে চাইলেন না! আমাদের কষ্ট, আমাদের চিৎকার, আমাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাদের কাছে এতটাই মূল্যহীন? ক্ষমতার এই নির্মম চক্রের সামনে আমাদের জীবন সত্যিই এত তুচ্ছ? এমন নিস্তব্ধতা, এমন উদাসীনতা আমাকে শূন্য করে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, তারাই যেন সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক।

সকালে পুলিশ এসে যখন আমাদের নিয়ে যায়, তখন মনে হচ্ছিল, আসন্ন রাতটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ রাত। সাংবাদিকরা আমাদের নাম-পরিচয় লিখে নিচ্ছিল, কিন্তু সাইফুর, সানি আর জহির এসে তাদের শাসালো। গার্ড দিতে থাকল খালেদ-মিজান-সোহেল-আরিফরা। তাদের একটাই কথা—শিবির ধরা পড়েছে।

পুলিশ আমাদের ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে তখন ডাক্তাররা এক্স-রে করে জানাল যে আমার অবস্থা খুবই গুরুতর। আমার পায়ের অবস্থা এমন ছিল যে, প্যান্টও কাটতে হয়েছে (খোলার উপায় ছিল না)। আর সেদিন সকাল বেলায় শাহবাগ থানার ওসি এসে বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন যাতে আমাদের পরিবারের কেউ এসে আমাদেরকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়। তা না হলে ছাত্রলীগের ছেলেরা এসে আমাদেরকে আবার মারধর করবে। ওরা আমাদের নামে মামলা দিতে পুলিশের উপর জোরাজুরি করছে।

আমার ফ্যামিলি ভেবেছিল আমি মারা গেছি। মরা কান্না শুরু হয়েছিল বাড়িতে। আর আমি তখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছি। আমার জীবনটা ঠিক এমন ছিল না, এমন হওয়ার কথা ছিল না। যারা আমাকে রক্ষা করতে পারত, তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর ঘটনার পরে যারা সাহায্য করতে এসেছিল, তাদেরও হাতে ছিল সীমাবদ্ধতা। ফ্যাসিবাদী আমলে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কোন সুযোগও তখন ছিলো না।

পরের দিন আমার পরিবার এসে যশোরে নিয়ে গেলো। আমার শরীরের ভেতরে সমস্যা বাড়ছিল, যন্ত্রণার তীব্রতা আমার অঙ্গহানির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। যশোরের কয়েকটি হাসপাতালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার শুনে আমার চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করল।

আমার পরিবারের জন্য তখন শুরু হলো আরেক দুঃস্বপ্ন। দিক-বিদিক ছুটে তারা শেষমেশ আমাকে যশোর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানেই আমি টানা এক মাসের বেশি সময় শয্যাশায়ী ছিলাম, ধীরে ধীরে জীবন থেকে যেন সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছিল। বারবার হাসপাতালে যাওয়া, রড লাগানো, রড খোলা—এই চিকিৎসা আমাকে ভেতর থেকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছিল। আমার জীবনটা যেন একটা জাহান্নাম হয়ে গেল। আমার বাবরি চুলগুলো পড়ে গেল, আমার দেহের শক্তি চলে গেল। আর মনের মধ্যে এক ভয়ানক শূন্যতা বাসা বাঁধল। আমি যেন সবকিছু থেকে দূরে সরে গেলাম—বিশ্বাস, ভরসা, বন্ধুত্ব—সবকিছু থেকে।

আমি নড়াইলের ছোট্ট এক গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে। আমার গ্রামের মানুষ অসংখ্য বাঁধা সত্ত্বেও স্বপ্ন দেখে। আমি প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যক্তি, যে আমাদের গ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। আমার এই সাফল্য শুধু আমার পরিবার নয়, পুরো গ্রামের জন্য ছিল এক বিশাল আনন্দের বিষয়। বাবা-মায়ের চোখে গর্বের ঝিলিক, গ্রামের মানুষের প্রশংসা—সবকিছু মিলিয়ে আমি নিজেকে বিশেষ কেউ ভাবতে শুরু করেছিলাম। দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে আমি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, নাগরিক দায়িত্ব ও রাজনীতি কীভাবে সমাজকে প্রভাবিত করে তা বুঝতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি যে, সেই রাজনীতি আমার জীবনকে এমনভাবে বিভীষিকাময় করে তুলবে।

সুস্থ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আমি শুধু ক্লাসে ঢুকতাম, চুপচাপ ক্লাস করতাম, আর তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতাম। আমি আর কারও মুখোমুখি হতে চাইতাম না। কোনো নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে সাহস পেতাম না। এমনকি ক্যাম্পাসে ঢুকতেও ভয় হতো। প্রতিটি মুহূর্ত মনে হতো, কেউ আমাকে দেখে ফেলবে, কেউ আবার আক্রমণ করবে। সেই আঘাতগুলো শুধু আমার শরীরে ছিল না, আমার আত্মায়ও ছিল।

চিকিৎসা খরচ চালাতে আমার পরিবার ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শারীরিক-মানসিক ট্রমায় ক্লাস পরীক্ষা মিস যাওয়ায় একাডেমিক রেজাল্ট প্রত্যাশিত হয়নি। এতে করে আজীবনের জন্য অনেক চাকুরীতে আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছি। এসব ক্ষতি অপরিসীম। আমার ও আমাদের ক্যাম্পাস লাইফের আনন্দ এরা শেষ করেছে। ব্যয়বহুল হলেও ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছি। ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়ত হুমকি ধামকীর সম্মুখীন হয়েছি। একাডেমিক কাজে হলে যেতে পারিনি। পরিস্থিতি একপর্যায়ে এমন দাড়ায় যে আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীগণ ‘শিবির ট্যাগের’ ভয়ে ক্যাম্পাসে আমাকে এড়িয়ে যেত। সামাজিক মাধ্যমে আমাকে আনফ্রেন্ড ও ব্লক করে দেয় অনেকে। এহেন সামাজিক বর্জনের ফলে আমি একাকীত্ব ও ডিপ্রেশনে ভেঙে পড়ি।
এখনো আমি মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে আতকে উঠি। ১৭ আগস্ট আসলে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ি।

আমাকে নির্যাতনে জড়িত যাদের কথা আমার পরিস্কার মনে আছে তারা হলো-

১। জহিরুল ইসলামের (আরবি বিভাগ, ২০০৯-১০ সেশন)
২। সাইফুর রহমান (মনোবিজ্ঞান, ২০০৯-১০ সেশন)
৩। মেহেদী হাসান সানি (শিল্পকলার ইতিহাস, ২০১২-১৩ সেশন)
৪। এস এম খালেদ (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ২০১৪-১৫ সেশন)
৫। মেহেদী হাসান মিজান (ইতিহাস, ২০১৪-১৫ সেশন)
৬। শাহাদাত হোসেন সোহেল (একাউন্টিং, ২০১৪-১৫ সেশন)
৭। হাসিবুল আলম সৌরভ (ফিন্যান্স, ১০১৫-১৬ সেশন)
৮। ইমতিয়াজ আহমেদ শুভ্র (হেলথ ইকোনোমিক্স, ২০১২-১৩ সেশন)
৯। শেখ আরিফুল ইসলাম (ফিন্যান্স, ২০১৪-১৫ সেশন)
১০। সৈয়দ আশিকুর রহমান (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ২০১২-১৩ সেশন)
১১। ইমরান হাসান (দর্শন, ২০১৪-১৫ সেশন)

আমার ক্ষতি কখনোই পূরণ হবেনা কিন্তু আমি চাই ফ্যাসিবাদ পরবর্তী আজকের ও আগামীর বাংলাদেশে আমার মত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এমন অপ্রত্যাশিত নির্মম পরিণতি আর কারো যেন দেখতে না হয়। আমি ন্যায়বিচার চাই যেন শিক্ষাঙ্গনে এমন নির্মমতার সাহস ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ও বিশ্বে আর কেউ না দেখায়। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ যেনো মরতে বা মারতে না আসে, পড়তে আসে।

বাপ্পী মিয়া
রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ১০ম ব্যাচ, ঢাবি, সেশন ২০১৫-১৬

নোটঃ হামলায় জড়িতদের পরিচয় কমেন্ট বক্সে দেওয়া হলো।

https://www.youtube.com/watch?v=-5P2wYHRd7g
27/10/2024

https://www.youtube.com/watch?v=-5P2wYHRd7g

ক্যাম্পাসে নির্যাতিত ছাত্রীদের জবানবন্দি ও বৈষম্যহীন শিক্ষাঙ্গন গড়ার দায় শীর্ষক আলোচনা ।। শিক্ষা অধিকার সংস....

16/10/2024

বিচারপতিদের নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন সুপ্রিমকোর্ট রেজিস্ট্রার

13/10/2024

SpaceX Starship IFT-Starbase










07/10/2024

আবরার ফাহাদের শাহাদাত দিবসে ক্যাম্পাস টর্চার নিয়ে অনলাইন ওয়েবিনার ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ

07/10/2024

🔴 সরাসরি-- শহীদ আবরার ফাহাদ স্মরণে কথা বলছেন সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ| Tvista

07/10/2024

Title
🔴 সরাসরি-- শহীদ আবরার ফাহাদ স্মরণে কথা বলছেন সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ| Tvista

সরাসরি দেখুন:
05/10/2024

সরাসরি দেখুন:

🔴Live- সীরাতুন্নবী সাঃ মাহফিল ২০২৪ | ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান Tvista

03/10/2024

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের নেতৃবৃন্দ । Tvista

01/10/2024

বিপজ্জনক বাস্তবতা এবং জনগণের করণীয়
আইনশৃংখলা, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা এবং ভূ-রাজনীতি
#আইনশৃংখলা #ভূরাজনীতি


Address

Lakshmipur

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Tvista Bangla posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Tvista Bangla:

Share