01/12/2024
টুকরো গল্প:- এক_মানুষের_নানান_চরিত্র
নানাবাড়িতে যাবার কথা বললেই মা খুব রেগে যেত। আড়ালে আবডালে দু’ঘা দিয়ে বলত, “পড়াশোনার নাম নেই। সারাদিন শুধু বেড়ানো। কোথাও যাওয়া যাবে না।”
মা'য়ের এই ব্যবহারটা ভালো লাগত না। এদিক থেকে বাবা ভীষণ ভালো ছিলেন। নানাবাড়িতে যাবার কথা শুনলেই উৎফুল্ল গলায় বলতেন, “অফিসে ছুটি পড়লেই যাব। এই শুক্রবার যাওয়া যাক।”
মা বাবার মুখের ওপর না বলতে পারত না। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাতো। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতাম। প্রায়ই ছুটির দিনে বাবার সামনে নানাবাড়িতে যাবার কথা তুলতাম। মা রাগ করত, কড়া চোখে তাকাতো। তবে কিছু বলতে পারত না।
নানাবাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো। দুই মামাকে নিয়ে নানির ছোট সংসার। নানা ছোট মামার জন্মের দুমাস পর মা'রা গেছেন। মায়ের বয়স তখন সতেরো বছর। উনি সরকারি চাকরি করতেন। জীবন দশায় একতলা পাকা বাড়ি তুলেছেন। বাড়ির সামনে বিরাট পুকুর। পুকুরে নানান রকমের মাছ। মামাদের বয়স বেশি না। দুজনেই স্কুলে পড়ে। নানা মা'রা যাবার পরপরই আত্মীয় স্বজনরা দেখেশুনে মায়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। সত্যি বলতে মামাদের আদরের জন্যই নানাবাড়ি যাবার বায়না ধরতাম। তার সাথে ভালো-মন্দ খাবারের ছড়াছড়ি। ও বাড়িতে গেলে নানি অনেক রকমের পিঠা বানাতেন। পোলাও, গরুর গোশত, বিরিয়ানিসহ নানান পদের রান্না হতো। বাবা মামাদের সাথে নিয়ে পুকুরে মাছ ধরতেন। সেসব রান্না হতো, বাড়ি ফেরার সময় কিছু নিয়েও আসা হতো। মা'য়ের এই ব্যাপারটা ভালো লাগত না। কয়েকবার বাবার সাথে ঝগড়াও করেছে। লাভ হয়নি।
সেবার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। ডিসেম্বর মাস। দুপুরে খাবার সময় বাবাকে বললাম, “স্কুলে ছুটি পড়ে গেছে। নানাবাড়ি যাব।”
বরাবরের মতো মা কড়া চোখে তাকালো। সেদিকে খেয়াল না দিয়ে উৎসুক চোখে বাবার দিকে চেয়ে রইলাম। বাবা আমায় নিরাশ করলেন না। একগাল হেঁসে বললেন, “কালকেই যাওয়া যাক। কি বলো নিলু?”
মা চিকন গলায় বলল, “এখন কোথাও বেড়াতে যাবার দরকার নেই। আমার শরীর ভালো না। তাছাড়া রোহানের পরীক্ষা শেষ হয়নি। বেড়াতে গেলে ঝামেলা হবে।”
বাবা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “কি এমন বিদ্বান ভাই তোমার? যে আমরা বেড়াতে গেলে পড়ার ক্ষ’তি হবে। নাকি বাপের বাড়ি পয়সা খরচ করতে চাও না?”
“এখানে পয়সা খরচের কথা আসছে কোথা থেকে?”
“পয়সা খরচ নিয়েই যত সমস্যা। আমাকে কি বোকা মনে হয়? আমরা গেলে খরচ বেড়ে যাবে। সেই ভয়েই তো বাপের বাড়ি যেতে চাও না। একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। তোমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কম টাকা রেখে যাননি নিশ্চয়ই। বাড়িঘরও ভালো। মনটা এমন ছোট কেন?”
“তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি বেশি বেশি বলছ?”
“না আমার একদমই এমন মনে হচ্ছে না। কারণ আমি সত্যি কথা বলছি। বিয়ের সময় তো কিছুই দেয়নি। বিনা খরচে মেয়ে পার করে দিয়েছে। এখন বেড়াতে গেলেও সমস্যা হচ্ছে। সবই বুঝি।”
মা খাবার ফেলে উঠে গেল। বাবা ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করলেন। শান্ত গলায় বললেন, “নানাবাড়ি যেতে হবে না মা। তোমাকে নিয়ে ফুফুর বাসায় ঘুরে আসব।”
কিছু বললাম না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখতে ভালো না। সারা বিকেল মা'য়ের থেকে দূরে দূরে থাকতাম। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঢুকতেই খেয়াল করলাম মা কাঁদছে। জায়নামাজে বসে কাঁদছে। আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কোমল গলায় বলল, “আল্লাহ আমার কপাল তোকে না দিক।”
মায়ের কথার মানে বুঝলাম না। সেবার আর নানাবাড়ি যাওয়া হয়নি। ফুফুর বাড়িতে গেছিলাম। আমাদের দেখে ফুফু খুব খুশি হলেও ফুফা খুশি হতে পারলেন না। মলিন গলায় বললেন, “এসে ভালোই করেছ। তবে কি বলতো! মাসের শেষ। পকেট খালি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করো। পরে না হয় এসে দু’দিন বেড়িয়ে যেও।”
বাবা একগাল হেঁসে বললেন, “সমস্যা নেই। খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বোন যা রাঁধবে তাতেই হবে।”
ফুফু বাড়িতে বেশিদিন থাকা হলো না। সকালে গিয়েছিলাম দুপুরের খাওয়া শেষ করেই ফিরে আসতে হলো। বাবা বললেন, তার কাজ আছে। পরে নিয়ে আসবে।
ফেরার সময় ফুফু মলিন মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবার তার হাতে হাজার টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন। তবে কিছু বললেন না। ফুফুর এ চেহারার সাথে আমি একজনের চেহারার মিল পাই। মিলটা খুব সূক্ষ্ণ। কেমন যেন অসহায়ত্বের ছাপ। ফুফার ব্যবহারটাও অপরিচিত নয়। মামারা আমাদের বাড়িতে আসলে বাবা বলেন- মাসের শেষ, হাতে টাকা পয়সা নেই। দু'দিন বাদেই মামারা বাড়ি ফিরে যায়। মা মলিন মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।
আমার বাবা খা’রা’প মানুষ না। রাত-দিন এক করে পরিশ্রম করেন। মায়ের গায়ে কখনও হাত তোলেন না। রান্নার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে স্বভাব নেই। মা যা রান্না করে তা-ই মুখ বন্ধ করে খেয়ে নেন। সংসারে অভাব নেই। আমি কিছু চাইবার আগেই পেয়ে যাই। বইখাতার অভাব হয় না। ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। দু'জন টিউশন মাস্টার দু'বেলা পড়াতে আসে। মা'য়ের কাপড়-চোপড়, গহনাপত্র কোন কিছুর অভাব নেই। তারপরও মা'য়ের মুখে হাসি দেখা যায় না। কেন যায় না সেও এক রহস্য! বহু বছর এই রহস্য ভেদ করতে পারিনি। সবকিছু চোখের সামনে অথচ কেমন যেন কুয়াশার আড়ালে ঢাকা।
সময় ও স্রোত কখনও অপেক্ষা করে না। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের চাদর ছেড়ে যৌবনে পদার্পণ করেছি। বাবা খুব খুঁজে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছেন। সরকারি চাকরিজীবী। সেই মানুষটাও ভালো। আমার খেয়াল রাখে, প্রয়োজন অপ্রয়োজন মাথায় রাখে। হঠাৎই একদিন বাবার বাড়িতে এলাম। সেদিন দুপুরের আয়োজন ভালো ছিল না। ডাল, সবজি আর ডিমভর্তা। মানুষটা বলল, “শশুরবাড়িতে জামাইয়ের যত্ন না হলে সম্মান কিছু অবশিষ্ট থাকে না।”
বাবা নিচু গলায় বললেন, “হঠাৎই চলে এসেছ। বাড়িতে কিছু নেই। দুপুরটা একটু কষ্ট করে চালিয়ে নাও। বিকেলে বাজার করব।”
“আপনার কি মনে হয় বাড়িতে না খেয়ে থাকি? কিংবা আপনার এখানে খেতে আসি?”
বাবা কিছু বললেন না। সেদিন হঠাৎই সবকিছু আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। কেন নানাবাড়িতে বেড়াতে যাবার নাম শুনলে মা রাগ করত, ফুফুর মলিন মুখের আড়ালের কষ্ট। সবকিছু পানির মতো স্বচ্ছ মনে হতে লাগল। নানির একার সংসার। সঞ্চয়ই শেষ সম্বল ছিল। মামারা ছোট। দেখাশোনার কেউ নেই। এর মাঝে রোজরোজ মেয়ের জামাই বেড়াতে গেলে তার আদর যত্ন করা সম্ভব হত না। মা ব্যাপারটা বুঝত। আজ আমিও বুঝতে পারছি। মানুষ অবস্থান ভেদে নানান চরিত্রে অভিনয় করে। আমার স্বামীও একদিন বাবা হবে। হয়তো তারও জামাই হবে। এমন পরিস্থিতি অনুভব করবে। প্রতিটা জীবনই যেন আলাদা। একের সাথে অন্যের মিল নেই। যে মেয়ে আজ বউ সে-ই কালের বিবর্তনে শাশুড়ি হয়। তবে তাদের সম্পর্ক মধুর হয় না। মেয়ের জামাইও এক সময় শশুর হয়, তবে সে পথ মসৃণ হয় না। কেন হয় না? বড্ড জানতে ইচ্ছে করে।
সেদিন রাতের শোবার সময় তাকে বললাম, “আমার বাপের বাড়ির যত্নে সন্তুষ্ট হতে পারেননি বুঝি?”
লোকটা একটু মিইয়ে গেল। চাপা গলায় বলল, “এ আর এমন কি! তবে আমি কিছু মনে করেনি।”
“মনে করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ আপনাকে এই দিন দেখার সৌভাগ্য দান করুক। যেখানে আপনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আর আজীবন ভালো-মন্দ ভোজন জামাই আপনার মুখের ওপর বলবে - শশুরবাড়িতে জামাইয়ের যত্ন না হলে মানসম্মান কিছু অবশিষ্ট থাকে না।”
সে কথার জবাব দিলো না। মুখ ভার করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে বাতি নিভিয়ে দিলাম। এই সমাজ বড্ড অদ্ভুত! যেখানে সমালোচনা হয়, সহানুভূতি থাকে। তবে সেসব মানুষের মনের দাগ দূর করতে পারে না। ছোট কথায়, সামান্য কষ্টে অথবা বিরাট আ’ঘা’তেও সংসার ভাঙে না। মনের মাঝে সূক্ষ্ণ দাগ পড়ে যায়। যার ব্যাথা কখনও দূর হয় না।
সমাপ্ত
ফারহানা_কবীর_মানাল