06/09/2025
একটি পাখির নীরব বিদায় — চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক রাতের নার্সের গল্প ...
গতরাতের সেই মুহূর্তগুলো আজও চোখের সামনে ভাসছে। আমি ছিলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ডিউটিতে। রাত গভীর হতেই হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে কয়েকজন এক রোগীকে ধরে নিয়ে এলো। আমরা, ডাক্তারের দল ও নার্সেরা ছুটে গেলাম সেই রোগীর দিকে। চোখে-মুখে সবার একটাই প্রশ্ন—সময় আছে তো? 😪
রোগী ছিলেন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। নয় মাসের গর্ভে সন্তান, অথচ তার নিজেরই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। রক্তের অভাব, হাইপোভোলেমিক শক, মাথায় ও ফুসফুসে আঘাত—সব মিলিয়ে অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। রক্তচাপ মাপার মতোও অবস্থা ছিল না। একের পর এক ডাক্তার এসে নিলেন দায়িত্ব—নিউরোসার্জন, গাইনোকলজিস্ট, অ্যানেস্থেসিস্ট—সবাই যার যার জায়গা থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন।
গাইনোকলজিস্ট বললেন—পেটের শিশুটি আর নেই। নিউরোসার্জনের চোখে কেবল হতাশা—“বাঁচানো যাবে না”—এই কথা বলতেও যেন তার গলা কেঁপে যাচ্ছিল। তবুও কেউ হাল ছাড়লেন না। প্রতিটা প্রাণের লড়াই যেন একটা যুদ্ধ—আমাদের পক্ষে হোক আর বিপক্ষে হোক।
রাত ৩:৩০-এ সেই নার্স, সেই গর্ভবতী নারী, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এক নিঃশব্দ প্রস্থান—যার গন্তব্য ওপারে।
সত্যি বলতে, মৃত্যুর দৃশ্য আমাদের নতুন নয়। কিন্তু এই মৃত্যু ছিল অন্যরকম। কারণ, উনি ছিলেন আমাদেরই একজন—একজন নার্স। যিনি প্রতিদিন অন্যকে বাঁচাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন, আজ নিজের প্রাণটিই রক্ষা করা গেল না।
বিকেলে উনি ও তার স্বামী একসাথে বের হয়েছিলেন। হঠাৎ একটি প্রাইভেটকার এসে তাদের দুজনকে চাপা দেয়। স্বামীর টিবিয়া ও ফিবুলা ভেঙে যায়, তাকে ভর্তি করা হয় অর্থোপেডিক্স বিভাগে। আর স্ত্রী—যার শরীরে আরেকটি জীবন বেড়ে উঠছিল—তিনিই হয়ে গেলেন আমাদের কাছে এক “কেস”, এক “ইমারজেন্সি”, এক শূন্যতা।
যখন স্বামী জানতে পারলেন তাঁর স্ত্রী আর নেই, তখন তিনি প্লাস্টারে মোড়া পা নিয়ে ছুটে আসতে চাইলেন আইসিইউতে। আমরা সবাই মিলে তাকে ট্রলিতে করে নিয়ে এলাম। সেই মুহূর্তটা… যেন সময় থমকে গেল।
আইসিইউর নিঃস্তব্ধতায় ছড়িয়ে পড়ল এক অসহায় স্বামীর বিলাপ—
> “পাখি… তুমি ওঠো, উঠো না পাখি…
দেখো, কে এসেছে…
তুমি এমন করে চলে যেতে পারো না…
তুমি আমাকে এত তাড়াতাড়ি ফেলে যেতে পারো না…
আমাদের মেয়েটার জন্য, একটা বার চোখ খুলো…
তুমি তো কথা দিয়েছিলে আমাদের বেবির জন্য সব করবো…
আমি তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না…”
আমরা, যারা প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যু দেখি, যারা মুখ শক্ত করে চলি, সেদিন আমাদের চোখেও জল এসেছিল। একজন নার্সের, একজন মায়ের, একজন স্ত্রীর এমনভাবে বিদায়—সহ্য করাটা সত্যিই কঠিন।
অনেকে ভাবে, ডাক্তার আর নার্সদের মন কঠিন। তারা না কাঁদে, না ভেঙে পড়ে। কিন্তু কাল রাতে আমরা সবাই বুঝেছি—আমরাও মানুষ। আমাদেরও ব্যথা লাগে। শুধু রোগীদের সামনে তা প্রকাশ করি না, সেটাই পেশাদারিত্ব। কিন্তু পেশাদারদের মনেও তো সমান রক্ত, সমান আবেগ, সমান ভালোবাসা।
আজও মনে পড়ছে সেই ট্রলির পাশের কান্না, সেই ডাক—
"পাখি, তুমি ওঠো…"
কিন্তু পাখি আর ওঠে না। সে তো আজ উড়াল দিয়েছে—এক অনন্ত আকাশে, যেখানে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই।
---
আল্লাহ উনাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আর তাঁর পরিবারকে এই দুঃসহ শোক সইবার শক্তি দিন।
আমরা যারা সেই রাতে ছিলাম, আজীবন ভুলতে পারব না এক পাখির নীরব বিদায়…
* সংগৃহীত