29/05/2025
কুরবানী : ইতিহাস, গুরুত্ব ও শিক্ষা
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান
কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও বিশেষ ইবাদত। হযরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে তা চলে আসছে। তবে সব নবীর শরীয়তে এর পদ্ধতি এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে এর যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূল সূত্র ‘মিল্লাতে ইবরাহীমী’তে বিদ্যমান ছিল। এজন্য কুরবানীকে ‘সুন্নতে ইবরাহীমী’ বলা হয়।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানীর কথা খোদ কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে এবং এর সঙ্গে জুড়ে আছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
বহু দিন ধরে ইবরাহীম আ.-এর কোনো সন্তান হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সন্তান জন্মের স্বাভাবিক বয়স পার হয়ে যায়। জীবনসন্ধ্যায় দাঁড়িয়েও তিনি আল্লাহ তাআলার কাছে নেক সন্তান প্রার্থনা করেন-
رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصّٰلِحِيْنَ.
হে আমার রব! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০০
যত দিন যাচ্ছিল ইবরাহীম আ.-এর হৃদয়ে সন্তানের আকাক্সক্ষা ততই তীব্র হচ্ছিল এবং আল্লাহর কাছে ততই দুআ-কাতর হচ্ছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর আকাক্সক্ষা পূরণ করে একজন সহনশীল পুত্রসন্তান দান করেন। এই সন্তানের নাম রাখেন ইসমাঈল।
একজন অশীতিপর বৃদ্ধ লোক সন্তানের মুখ দেখলে কত আনন্দিত হবে সহজেই অনুমেয়। ইবরাহীম আ. শুধু আনন্দিতই হননি; আল্লাহর শোকরে তাঁর হৃদয় ভরে যায়। তিনি শোকর আদায় করে বলেন-
الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ وَهَبَ لِيْ عَلَي الْكِبَرِ اِسْمٰعِيْلَ وَاِسْحٰقَ اِنَّ رَبِّيْ لَسَمِيْعُ الدُّعَآء.
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দুআ শ্রবণকারী। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৯
ইবরাহীম আ. শামে বসবাস করতেন। একসময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এল, পুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মা হা-জারকে যেন মক্কায় রেখে যান। মক্কায় তখন জনবসতি ও জীবনোপকরণ কিছুই ছিল না। তার পরও আল্লাহর নির্দেশমতো তিনি তাঁদেরকে সুদূর মক্কায় রেখে যান।
ইসমাঈল আ. ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে শুরু করেন। তিনি যত বড় হচ্ছিলেন, তাঁর প্রতি পিতার ভালবাসা তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যখন তিনি ছোটাছুটি করার বয়সে উপনীত হন তখন ইবরাহীম আ. এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তিনি স্বপ্নে দেখেন, একমাত্র কলিজার টুকরোকে যবেহ করছেন।
এটা যদিও স্বপ্ন ছিল; কিন্তু নবীগণের স্বপ্ন ওহীর মতো হয়ে থাকে। তাই এ স্বপ্নের অর্থ এই ছিল যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবরাহীম আ.-কে একমাত্র সন্তান ইসমাঈল আ.-কে যবেহ করার আদেশ করা হয়েছে।
ইসমাঈল আ. যদিও ইবরাহীম আ.-এর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও দুআর ফল; কিন্তু তাঁর কাছে আল্লাহর আদেশ ছিল সবার উপরে। তিনি খুশিমনে এ আদেশ পালন করতে রাজি হয়ে গেলেন। কেননা সন্তান আল্লাহ্ই দান করেছেন। এখন তিনিই তাকে যবেহ করার আদেশ করেছেন। তাঁর দেওয়া সম্পদ তাঁর জন্য কুরবান করতে দ্বিধা কীসের? বান্দার জন্য এটা বরং সৌভাগ্যের বিষয়।
ইবরাহীম আ. অতীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং সবগুলোতে চূড়ান্ত সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। এই আদেশ পালনেও নিজের দিক থেকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা যেহেতু দুইজনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল, তাই অপরজনের অভিমত জানা বা অন্তত অবহিত করা উচিত। এতে তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবেন অথবা তার কোনো দ্বিধা থাকলে বুঝানো-সমঝানো যাবে।
ইবরাহীম আ. নিজ স্বপ্নের কথা সন্তানকে জানিয়ে তাঁর অভিমত জানতে চাইলেন-
يٰبُنَيَّ اِنِّيْۤ اَرٰي فِي الْمَنَامِ اَنِّيْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰي.
হে আমরা বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে যবেহ করছি। তাই তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমার অভিমত কী।
কিন্তু তিনি তো ছিলেন খলীলুল্লাহর পুত্র এবং ভাবী নবী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন-
يٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِيْنَ.
হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০২
এটা ইসমাঈল আ.-এর গভীর জ্ঞান ও বিনয়ের পরিচায়ক। ইবরাহীম আ. তাঁর কাছে একথা বলেননি যে, আল্লাহ তোমাকে যবেহ করার আদেশ করেছেন; তিনি একটি স্বপ্নের কথা বলেছেন মাত্র। কিন্তু ইসমাঈল আ. বুঝে ফেলেছেন, এ স্বপ্ন মূলত আল্লাহর একটি আদেশ।
দ্বিতীয়ত, তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে বিষয়টি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছেন এবং ‘আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ বলে এ ইঙ্গিত করেছেন যে, এই ধৈর্য একা আমারই কৃতিত্ব নয়; বরং দুনিয়াতে আরো বহু ধৈর্যশীল আছেন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে তাদের মধ্যে পাবেন। এভাবে তিনি অহংকার ও আত্মমুগ্ধতার নাম-গন্ধটুকু পর্যন্ত খতম করে চূড়ান্ত বিনয়ের প্রকাশ করলেন।
যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য রাজি হয়ে গেলেন তখন এল আসল পর্ব। ইবরাহীম আ. পুত্রকে যবেহ করার জন্য কাত করে শোয়ালেন।
যবেহের ক্ষেত্রে যদিও সাধারণ নিয়ম হল চিত করে শোয়ানো; কিন্তু ইবরাহীম আ. ইসমাঈল আ.-কে কাত করে শোয়ানোর উদ্দেশ্য সম্ভবত এই ছিল যে, আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন প্রসঙ্গে তাঁরা দুইজন নিজেদের পক্ষ থেকে তো এটাই ধরে নিয়েছিলেন যে, পিতা পুত্রকে কার্যত যবেহ করবেন। তাই ইবরাহীম আ. পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন, যাতে ছুরি চালানোর সময় চেহারা নজরে না পড়ে, পাছে পুত্রবাৎসল্য উঠলে মন টলে যায়। এ থেকে অনুমেয়, এই আদেশ পালনের জন্য তাঁরা কত আন্তরিক ছিলেন।
আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনের জন্য তাঁরা যেহেতু তাঁদের এখতিয়ারাধীন সবকিছুই করে ফেলেছিলেন, তাই তাঁদের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। অনন্তর আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরতের এক কারিশমা দেখালেন। তিনি নিজ কুদরতে সেখানে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন। ইবরাহীম আ. আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের স্থলে সেটি যবেহ করলেন। ইসমাঈল আ. জীবিত ও নিরাপদ থাকলেন।
কুরআনের ভাষায়-
فَلَمَّاۤ اَسْلَمَا وَتَلَّهٗ لِلْجَبِيْنِ وَنَادَيْنٰهُ اَنْ يّٰۤاِبْرٰهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَا اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِيْنُ، وَفَدَيْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ.
অতঃপর যখন তারা উভয়ে আদেশ মান্য করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি এক মহান কুরবানীর (পশুর) বিনিময়ে তাকে (ইসমাঈল) মুক্ত করলাম। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০৩-১০৭
ইবরাহীম আ.-এর এই দুম্বা কুরবানী হল, ইসলামী শরীয়তে নির্দেশিত কুরবানীর পদ্ধতির মূল সূত্র। (সামর্থ্যবান) মুসলমানদের কর্তব্য হল (নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট) পশু কুরবানী করা। এটা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ.
সুতরাং আপনার প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। -সূরা কাওসার (১০৮) : ২
এ আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মতকে নামায ও কুরবানীর আদেশ করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীন সম্পর্কে জানতে এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময় নবীজী তাকে ডেকে বললেন-
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ اللهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمَّةِ.
আমাকে ‘ইয়াওমুল আযহার’ আদেশ করা হয়েছে। এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৪
এ হাদীস থেকে জানা গেল, আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরবানীর দিন কুরবানী করার জন্য বিশেষভাবে আদেশ করা হয়েছে।
মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-
كُنّا وُقُوفًا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: يَا أَيّهَا النّاسُ، عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيّةٌ.
আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম। তখন তাঁকে বলতে শুনেছি, হে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রতি বছর কুরবানী আবশ্যক। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৭৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৮৮৯
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন-
هذا حديث حسن غريب.
তাছাড়া নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদানী-জীবনে প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন-
أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلَّ سَنَةٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫৫
ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন-
هذا حديث حسن
উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে বোঝা গেল, কুরবানী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। সামর্থ্যবানদের জন্য কুরবানী করা আবশ্যক।
কুরবানীর মধ্যে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এখানে কয়েকটি শিক্ষা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল :
১. কুরবানীর গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা হল, আল্লাহর প্রতি তাওহীদের বিশ্বাসকে দৃঢ়, পরিপূর্ণ ও নিখুঁত করা। কুরবানী আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে, ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ, আর কোনো কিছু ইবাদতের উপযুক্ত নয়। সুতরাং ইবাদত একমাত্র আল্লাহর করব। আল্লাহ ছাড়া আর কারো, আর কোনো কিছুর ইবাদত করব না। কোথাও উপাসনাধর্মী কোনো কাজ গায়রুল্লাহর জন্য হলে আমি তাতে শরীক হব না।
আল্লাহ তাআলা নবীজীকে বলেন-
قُلْ اِنَّنِيْ هَدٰىنِيْ رَبِّيْۤ اِلٰي صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ دِيْنًا قِيَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِيْمَ حَنِيْفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَبِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ.
আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে সরলপথ প্রদর্শন করেছেন, যা বিশুদ্ধ দ্বীন, ইবরাহীমের মিল্লাত, যিনি ছিলেন একনিষ্ঠ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। এরই আদেশ করা হয়েছে আমাকে এবং আমিই প্রথম আনুগত্যকারী। -সূরা আনআম (৬) : ১৬১-৬৩
এ আয়াতগুলোতে নবীজীকে নিখুঁত ও পরিপূর্ণ তাওহীদের ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় তাওহীদের এই ঘোষণা উচ্চারণ করতেন।
জাবির রা. থেকে বর্ণিত, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুটি দুম্বা জবাই করেছেন। তিনি যখন এগুলোকে কেবলামুখী করে শোয়ালেন তখন বললেন-
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ، عَلى مِلَّةِ إِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَا شَرِيْكَ لَهٗ، وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.
আমি আমার মুখ তাঁর অভিমুখী করলাম, যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। এরই আদেশ করা হয়েছে আমাকে এবং আমিই প্রথম আনুগত্যকারী। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫০২২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৮৯৯
২. কুরবানীর আরেকটি বড় শিক্ষা হল আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করা। তাঁর আদেশকে শিরোধার্য করা। তাঁর হুকুম-আহকাম পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কুরবানীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ইবরাহীম আ. আল্লাহর নির্দেশে বৃদ্ধ বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র সন্তান ইসমাঈল আ.-কে যবেহ করার জন্য খুশিমনে রাজি হয়েছিলেন।
৩. কুরবানীর আরেকটি বড় শিক্ষা হল যে কোনো নেক কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা। কুরবানীর এ শিক্ষা উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীস থেকেই আমরা পাই। অন্যত্র তা আরো পরিষ্কারভাবে এসেছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰي مِنْكُمْ.
আল্লাহর কাছে সেগুলোর গোশত পৌঁছে না এবং সেগুলোর রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭
হাঁ, কুরবানীর পশুর কিছুই তো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। গোশত আমরা খেয়ে নিই। রক্ত-ময়লা ফেলে দিই। তাহলে আল্লাহর কাছে কী পৌঁছে? তাঁর কাছে পৌঁছে অন্তরের নিয়ত। যদি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানী করা হয়, তাহলে এটাই তাঁর কাছে পৌঁছবে এবং তাঁর কাছে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে। আর যদি নামদাম, লৌকিকতা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে করা হয় তাহলে তাঁর কাছে কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না।
মানব ইতিহাসের প্রথম কুরবানীর ঘটনায়ও এ বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। যখন আদম আ.-এর দুই পুত্র কুরবানী পেশ করলেন তখন একজনের কুরবানী কবুল হল, অপরজনের কুরবানী কবুল হয়নি। এ অবস্থায় তার (যার কুরবানী কবুল হয়নি) উচিত ছিল সত্য মেনে নেওয়া, কিন্তু সে উল্টো ঈর্ষাকাতর হল এবং একপর্যায়ে অপর ভাইকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হল। তখন ওই ভাই (যার কুরবানী কবুল হল) বললেন-
اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ .
আল্লাহ তো মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন। -সূরা মায়েদা (৫) : ২৭
হাদীসেও এ বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ، مَنْ فَعَلَهُ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلُ، فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لِأَهْلِهِ، لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِي شَيْءٍ.
ঈদের দিন আমরা প্রথমে নামায আদায় করি। অতঃপর ফিরে এসে কুরবানী করি। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে, সে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে নামাযের আগেই পশু জবাই করল সেটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে, কুরবানী হবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬১
এ হাদীস থেকে বোঝা গেল, কুরবানী শরীয়তের বিধান মোতাবেক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করতে হবে। অন্যথায় তা কুরবানী হবে না; বরং নিছক গোশত খাওয়ার আয়োজন হবে।
৪. কুরবানীর আরেকটি শিক্ষা হল, কোনো কাজেই এমনকি যদি অনেক বড় কোনো নেক কাজেরও তাওফীক হয়ে যায়, তবু অহংকার না করা, আত্মমুগ্ধতার শিকার না হওয়া; বরং বিনয়ী হওয়া এবং অন্তরে এই অনুভূতি থাকা চাই যে, এটা একমাত্র আল্লাহর দয়াই আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় আমার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কুরবানীর ইতিহাসে আমরা লক্ষ করেছি, ইবরাহীম আ. যখন ইসমাঈল আ.-এর কাছে নিজ স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করে তাঁর অভিমত জানতে চেয়েছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি দুম্বা কুরবানী করেন- একটি নিজের পক্ষ থেকে, আরেকটি উম্মতের পক্ষ থেকে। দুম্বা দুটি জবাই করার সময় তিনি বলেন-
اَللّٰهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ.
হে আল্লাহ! এটা তোমার পক্ষ থেকেই এবং তোমার জন্যই। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫০২২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৮৯৯
নবীজীর বিনয় দেখুন, দুটি দুম্বা কুরবানী করা সত্ত্বেও তিনি অহংকার করেননি; বরং এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যে, এটা আল্লাহরই দান, তিনিই এর তাওফীক দান করেছেন।
৫. কুরবানীর আরেকটি শিক্ষা হল, সন্তানকে আল্লাহর অনুগত বানানোর চেষ্টা করা। কুরবানীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ইবরাহীম আ. মনে মনে এমন সন্তানের কথাই ভাবতেন এবং আল্লাহর কাছেও এমন সন্তানই প্রার্থনা করতেন, যে আল্লাহর পূর্ণ অনুগত হবে, আল্লাহর জন্য জীবন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। তিনি তা বাস্তবে প্রমাণ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুন্দরভাবে কুরবানী করা এবং এর শিক্ষা দ্বারা আলোকিত হওয়ার তাওফীক দান করুন।
প্রসঙ্গসমূহ:
দ্বীনিয়াত
কুরবানী
আদব-শিষ্টাচার
ইসলামের সৌন্দর্য-মাধুর্য
advertisement
প্রসঙ্গসমূহ »
ঈমান-আকাইদএকটি ভুল নামশিক্ষা/সিলেবাসআলকুদস সংখ্যানামায-সালাততাহারাতরমযান প্রসঙ্গহজ্জ্বযাকাতমুয়ামালাত-লেনদেনতাসাওউফ-আত্মশুদ্ধিইসলামী অর্থনীতিদাওয়াত ও তাবলীগশেয়ার ব্যবসাশবে বরাতশবে মিরাজঈদনারী অধিকারবিদআতসীরাত
আরও »
সাম্প্রতিক সংখ্যা »
মে ২০২৫
এপ্রিল ২০২৫
মার্চ ২০২৫
ফেব্রুয়ারি ২০২৫
জানুয়ারি ২০২৫
ডিসেম্বর ২০২৪
কপিরাইট © ২০২৪ মাসিক আলকাউসার।