28/05/2025
কাবাঘরের ছায়ায়, যেখানে লক্ষ প্রার্থনা উড়ে বেড়ায়, সেখানে তিনটি সাদা কাফনের মাঝেরটি ছিল একজন বাঙালির—যার গল্পে জড়িয়ে আছে ঈমান, ত্যাগ আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি অটুট ভালোবাসা।
মক্কার গলিতে গলিতে তাঁর হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল বারো বছর ধরে। পেশায় ফার্মাসিস্ট, কিন্তু হৃদয়ে একজন হাফেজ। বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি নিয়ে এলেন কোনো স্যুভেনির নয়, বরং একটি স্বপ্ন: চার ছেলেকেই যেন কুরআন হিফজ করতে দেখেন। ছোট ছেলে আব্দুর রহমান ২০ পারার পর আর আগচ্ছিল না। "আল্লাহ, আমাকে বাঁচিয়ে রাখো, যতক্ষণ না সে শেষ করে," তিনি তাসবিহ চেপে প্রার্থনা করতেন।
তারপরই ধরা পড়ল কোলন ক্যান্সার। ডাক্তাররা ভারতের কেমোথেরাপির পরামর্শ দিলেন। তিনি রাজি নন। "সেখানে মারা গেলে বিদেশের বিধর্মীর মত মাটিতে কবর দেবে," কাঁপা কণ্ঠে বললেন। কিমোতে দাড়ি পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অরাজি হওয়ার আরেকটি কারন। "আল্লাহই আমার সময় ঠিক করবেন, ক্যান্সার নয়।”
সপ্তাহগুলো তাঁর চামড়াকে ফ্যাকাশে, হাড়গুলো ভঙ্গুর করে দিল। তবুও যখন এক বন্ধু উমরাহর একটি গ্রুপের কথা বলল, তাঁর চোখে জ্বলে উঠল দৃঢ়তা। "আমি যাব," তিনি ঘোষণা দিলেন।
স্ত্রী আতঙ্কে বললেন, "কিভাবে?" পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ।
ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। কিন্তু ঈমান পাহাড়ও সরায়—দুই দিনেই পাসপোর্ট রিনিউ হলো। ভিসা মিলে গেল। তিনি পরলেন ইহরামের সাদা কাপড়, যেন এক সাদা পোশাকের যোদ্ধা।
তিনি উমরাহ শেষ করলেন। পরের এক দিন তিনি হাসলেন, স্মৃতিচারণ করলেন, আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর আসরের আজান যখন পবিত্র নগরীতে ভেসে বেড়াল, তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল।
শেষ দৃষ্টি: কাবা। শেষ নিঃশ্বাস: শাহাদাতের একটি ফিসফিসানি।
বাড়িতে শোকাহতরা অবাক হয়ে বলল, "মক্কায় মৃত্যু?" যে বিদেশে মরতে ভয় পেতেন, তিনি এখন ইসলামের পবিত্র মাটিতে শায়িত। তাঁর ছোট ছেলে আব্দুর রহমান সপ্তাহখানেক আগেই হিফজ শেষ করেছিল—সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়ে এক উত্তরিত প্রার্থনা।
আপনি ভাবেন, শুধু কালিমা পড়লেই 'সুন্দর মৃত্যু'? না।
নবী ﷺ বলেছেন, 'যার শেষ আমল ভালো, সে জান্নাতে যাবে।'
এই ব্যক্তির শেষ আমল ছিল উমরাহ। তাঁর মৃত্যু? এক রহমত।
বেদনা রয়ে গেল, কিন্তু রয়ে গেল বিস্ময়ও। দ্রুত পাসপোর্ট, আকস্মিক ভিসা, তাওয়াফের শক্তি—এগুলোই তো নিদর্শন, যার প্রিয় বান্দাকে আল্লাহ প্রিয় করেই নিয়েছেন।
ফজরের নামাজের নীরবতায় পরিবারটা সান্ত্বনা খুঁজে পায়। তারা কল্পনা করে, তিনি এখন ব্যথামুক্ত, জান্নাতের বাগানে ঘুরছেন—হাফেজদের পিতা, এক বান্দা যে ঘরে ফিরেছে।
ইয়া আল্লাহ, ইয়া রব্বুল আরশিল আযিম, আমাদেরও এমনই একটি শেষ দিন দান করুন। আমাদের শেষ আমল যেন হয় সর্বোত্তম আমল। আমিন।