21/06/2024
চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপারের কথা প্রথম জানতে পারি হুমায়ুন আহমেদের 'নি' উপন্যাসের মাধ্যমে। ২০০৪ সালে। তখন এই সাপ বিলুপ্তপ্রায় ছিলো। উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট মুবিনুর রহমান জরাজীর্ণ এক বাড়িতে থাকেন। বাড়ির মালিক কালিপদ এই চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রবে বাড়ি ছেড়েছিলো। তারপর অনেকদিন এই সাপের নাম শুনি নাই।
আমাদের দেশ বা বড় করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশে বিষধর সাপ মুটামুটি ৪টি। একসাথে 'বিগ ফোর স্ন্যাক অফ ইন্ডিয়া' বলা হয়। এরমধ্যে এতোদিন কালকেউটে বা তেলা গোখরা আর কিং কোবরা বা খৈয়া গোখরার উপদ্রব ছিলো বেশী। কিন্তু চন্দ্রবোড়ার আনাগোনা ইদানীং বেড়েছে কয়েকশ গুনে।
স্বভাব ও বাসস্থান :
চন্দ্রবোড়া সাধারণত শান্তশিষ্ট সরীসৃপ। তেড়ে এসে কামড় দেয় এই ধারনা মূলত একটি প্রচলিত মিথ। এটি শুষ্ক ঘাস, ঝোপঝাড়, নদী তীরবর্তী স্থানে থাকতে পছন্দ করে। ঘন বন বা পাহাড়ী অঞ্চল এড়িয়ে চলে। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে এদের আনাগোনা বেশী। বিহার আর পশ্চিম বাংলায়ও সিগনেফিকেন্ট পরিমাণে আছে। সেখান থেকেই গঙ্গা-পদ্মার অববাহিকায় বন্যার পানিতে ভেসে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরেছে। তাই পদ্মার তীরবর্তী জেলা সমূহ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
অন্য সাপ ডিমের মাধ্যমে বাচ্চা দিলেও এই সাপ সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। একসাথে ৮০টি বাচ্চা দিতেও সক্ষম। তাই এই সাপের প্রজনন রোধ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
সাপটি প্রচন্ড বিষধর। চলাফেরায় ধীরগতির হলেও, ছোবল দেয় প্রচন্ড গতিতে। আমাদের সমাজে একটি ধারনা আছে বিষধর সাপ মাত্রই ফণা তুলে। কিন্তু এই সাপ ফণা না তুলেই ছোবল দেয়। তাই চিনতে ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া গায়ের ডোড়া অনেকটা অজগরের মতো এবং স্বভাবেও অলস প্রকৃতির। সুতরাং চন্দ্রবোড়াকে অজগর ভেবেও ভুল হতে পারে।
বিষধর সাপের কামড়ে চেনার উপায়:
বিষধর সাপের কামড় সহজেই অন্য সাপের কামড় থেকে আলাদা করা যায়। পাশাপাশি দুটি কামড়ের দাগ থাকবে। বিষধর সাপের বিষদাঁতের গোড়ায় ভেনোম গ্লান্ড থাকে। সাপের বিষ মূলত একধরনের রুপান্তরিত লালা। অন্যদিকে সাপ বিষধর না হলে কামড়ের জায়গায় অনেকগুলো দাতের চিহ্ন থাকে। মাঝে মাঝে কামড়ের সাথে মাংস উঠে যেতেও পারে।
কামড়ের পর কি করবেন?
আমাদের দেশের জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এন্টি ভেনম রয়েছে। এছাড়াও যে সকল উপজেলায় সাপের উপদ্রব বেশী সে সকল উপজেলা হাসপাতালেও এন্টি ভেনম মজুত রয়েছে। তাই সাপ কামড় দেবার সাথে সাথেই নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসুন। আনার সময় হাতে বা পায়ে দড়ি দিয়ে বাধন দেবেন না।
মনে রাখবেন হাসপাতালে আসতে যত দেরী হবে রোগীর সারভাইভ করার সম্ভাবনা ততো কমবে। ওঝা বা কবিরাজ সাপের কামড়ের কোনো চিকিৎসা জানে না।
বিষক্রিয়ার উপসর্গ
ক্ষত স্থানে ব্যাথা হবে এবং ফুলে যাবে। ২০ মিনিটের মধ্যে প্রস্রাব, কাশি আর লালার সাথে রক্ত আসতে পারে। ক্ষত স্থানে ঠোসা পরে যেতে পারে এবং চিকিৎসা বিলম্ব হলে আক্রান্ত স্থানের মাংস মরে যেতে পারে, পচে যেতে পারে।আরো বিলম্ব হলে কিডনি বিকল হয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
আমাদের দেশের অন্য সব বিষধর সাপের বিষ নিউরোটক্সিক (Neurotoxic) হলেও চন্দ্রবোড়ার বিষ হেমোটক্সিক (Heamotoxic)। তাই বিষক্রিয়া শুরু হলে লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যেতে শুরু করে। তাতে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হয়। এছাড়াও অণুচক্রিকা ভেঙে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত শুরু হয়। এক্ষেত্রে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ কমতে থাকে।
প্রতিকার:
রাতের বেলায় টর্চ ছাড়া বাইরে বের হবেন না। বাড়ির উঠান-আঙিনা পরিস্কার রাখুন। কান সজাগ রাখুন। চন্দ্রবোড়া মূলত একটি হিস হিস শব্দ করে নিজের উপস্থিতির জানান দেয়।
চন্দ্রবোড়ার বাচ্চা দেখলে হেলফেলা করবেন না। বাচ্চা সাপের বিষ কম থাকলেও বাচ্চা সাপ মূলত কামড়ের পর নিজের সব বিষ ঢেলে যেয়। তাই বড় সাপের চেয়ে ছোট সাপের কামড় বেশী ক্ষতিকর।
বাড়ির ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যার পর উঠানে বের হতে দিবেন না। বাড়িতে বিড়াল বা কুকুর পুষুন। কুকুর বিড়াল বাড়িতে সাপ আসতে দেয় না। বাড়িতে কার্বলিক এসিড রাখুন অথবা গুড়ো সাবান বা সলিড সাবান টুকরো টুকরো করে কেটে উঠানে ছিটিয়ে রাখুন।
মনে রাখবেন চন্দ্রবোড়ার উপদ্রব মহামারীর পর্যায়ে চলে যাবার আগেই সমাজে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
সংগৃহীত পোস্ট....