02/08/2025
সাংবাদিকতা পেশার অবমাননা ও জনগণের আস্থার সংকট
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এর ওপর নির্ভর করে সমাজের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও জনগণের অধিকার রক্ষা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু **সাংবাদিক নেতার আচরণ** এই স্তম্ভের গোড়াকে দুর্বল করে দিচ্ছে। পেশার মর্যাদা ও নৈতিকতার সীমালঙ্ঘন করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের যে ধারা শুরু হয়েছে, তা কেবল **সাংবাদিকতার ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ন করছে না, বরং জনগণের আস্থাকেও তলানিতে নামিয়ে দিচ্ছে।**
গণমাধ্যমকর্মীদের একটি বড় অংশ এখনো নীতি ও আদর্শ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকেন। কিন্তু যখন কিছু অসাধু সাংবাদিক নেতা তাদের পেশার সম্মানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন, তখন সেই সৎ সাংবাদিকদের আত্মত্যাগ ম্লান হয়ে যায়। তাদের কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সুবিধাভোগী নেতার দৌরাত্ম্য
বর্তমানে আমরা প্রায়ই দেখি, কিছু সাংবাদিক নেতা সাংবাদিকতার পরিচয়কে ব্যবহার করে প্রশাসনিক সুবিধা নিচ্ছেন। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এবং সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটা। এর মধ্যে রয়েছে চাকরির **পোস্টিং বদলি করানো, বিভিন্ন দপ্তরের অনৈতিক সুবিধা আদায়, এবং রাজনৈতিক নেতাদের পাশে ছবি তুলে নিজেদের প্রভাব জাহির করা।** এই সুবিধাভোগী মানসিকতা পুরো পেশাকেই কলুষিত করছে।
যখন একজন সাধারণ মানুষ দেখেন যে, সাংবাদিকতার মতো একটি মহান পেশার পরিচয় ব্যবহার করে কেউ রাজনৈতিক নেতার আস্থাভাজন হয়ে উঠছেন এবং সেই সম্পর্ককে পেশার ‘প্রাপ্তি’ হিসেবে উপস্থাপন করছেন, তখন তাদের মনে এই পেশা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। তারা মনে করেন, সাংবাদিকতা এখন আর সত্য প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং ক্ষমতা ও অর্থের একটি সিঁড়ি মাত্র। এই ধারণা সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আস্থার সংকট ও পেশাগত অবক্ষয়
জনগণের আস্থাহীনতা একটি গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট। যখন জনগণ বিশ্বাস করা বন্ধ করে দেয় যে, একটি সংবাদ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ, তখন সেই গণমাধ্যমের প্রাসঙ্গিকতা হারাতে শুরু করে। কিছু সাংবাদিক নেতার ক্ষমতার দালালি এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব জনগণের মনে এই বিশ্বাস তৈরি করছে যে, সব খবরই হয়তো কোনো না কোনো স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত।
এই অবক্ষয়ের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের সততা ও নিষ্ঠা জনগণের কাছে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। যখন কোনো সাংবাদিক দুর্নীতি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তখন কিছু মানুষ তাকেও সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। তারা ভাবে, হয়তো এই সাংবাদিকও কোনো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এটি সৎ সাংবাদিকদের কাজের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
---
প্রতিরোধের উপায় ও পেশার মর্যাদা পুনরুদ্ধার
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে, **সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে** এই ধরনের অপেশাদার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। সংগঠনগুলোর উচিত, যারা সাংবাদিকতার পরিচয় ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। পেশাগত আচরণবিধির লঙ্ঘনকারীদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের চর্চা আরও বাড়াতে হবে। তরুণ সাংবাদিকদের পেশার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে, সাংবাদিকতা কোনো ক্ষমতার সিঁড়ি নয়, বরং এটি সমাজের প্রতি একটি বড় দায়িত্ব।
সবশেষে, গণমাধ্যমকে তার নিজের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে হলে জনগণের আস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। **নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং সাহসীকতার** মাধ্যমে জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে যে, এখনো অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা সত্য প্রকাশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। এই ধরনের পদক্ষেপই পারে সাংবাদিকতার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে এবং জনগণের আস্থাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে।