23/05/2025
শিরক: তাওহীদের পরিপন্থী এক মহাপাপ, যা আমাদের অজান্তেও বাসা বাঁধতে পারে!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ! 🙏
ইসলামের সবচেয়ে মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো তাওহীদ – অর্থাৎ এক আল্লাহ তা'আলার উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক না করা। এর বিপরীত হলো শিরক, যা সকল সৎ আমলকে ধ্বংস করে দেয় এবং আল্লাহ তা'আলা শিরকের গুনাহ ক্ষমা করেন না, যদি শিরককারী তাওবা না করে মারা যায়।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
"নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করে, সে চরমভাবে পথভ্রষ্ট হয়।"
– সূরা নিসা, আয়াত: ৪৮
"আর তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি যদি শিরক করো, তাহলে তোমার আমল অবশ্যই বরবাদ হয়ে যাবে এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।"
– সূরা আন'আম, আয়াত: ৮৮
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন:
আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি তা বলে দেব না?" আমরা বললাম, "অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল!" তিনি বললেন, "আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।"
– সহীহ বুখারী, হাদিস: ২৬৫৪
– সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৫
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিরকের সাধারণ রূপসমূহ:
সাধারণত, আমরা শিরক বলতে কেবল মূর্তি পূজাকে বুঝি। কিন্তু শিরকের ব্যাপকতা এর চেয়েও অনেক বেশি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন কিছু কাজ রয়েছে যা জেনে বা না জেনে শিরকের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এগুলো থেকে আমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে:
* মাজার পূজা ও মান্নত: বাংলাদেশের বিভিন্ন মাজারে গিয়ে মৃত পীর, ওলী বা কোনো ব্যক্তির কাছে সন্তান চাওয়া, রোগমুক্তি চাওয়া, বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া বা কোনো মান্নত করা। অনেকে পীর-ফকিরের কবরে সিজদা করে বা তাদের নামে পশু জবাই করে। এসবই সরাসরি বড় শিরক (শিরকে আকবর)। কারণ, এসব ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই।
* জীবিত বা মৃত পীর-আউলিয়ার কাছে অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনা: "অমুক পীর সাহেব দেখছেন," "অমুক পীর সাহেব আমার বিপদ দূর করে দেবেন" - এমন বিশ্বাস রেখে আল্লাহর বদলে অন্য কারো কাছে অলৌকিক সাহায্য চাওয়া।
* তাবিজ, মাদুলি, সুতা ইত্যাদির উপর ভরসা করা: রোগমুক্তি, বিপদ থেকে রক্ষা বা সৌভাগ্যের জন্য তাবিজ, মাদুলি, কালো সুতা ইত্যাদি ধারণ করা এবং সেগুলোকে কার্যকরী মনে করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "যে ব্যক্তি তাবিজ ঝোলালো সে শিরক করলো।" – সুনানে তিরমিযী, হাদিস: ২০৭২
* জ্যোতিষী, গণক বা যাদুকরের কাছে যাওয়া: ভবিষ্যৎ জানার জন্য বা সমস্যা সমাধানের জন্য জ্যোতিষী, গণক, হস্তরেখাবিদ বা যাদুকরের কাছে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "যে ব্যক্তি কোনো গণকের কাছে গেল এবং সে যা বলে তা বিশ্বাস করল, সে যেন মুহাম্মাদ (সা.) এর উপর যা নাযিল হয়েছে তা অস্বীকার করল।" – সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৯০৪
* লোক দেখানো ইবাদত (রিয়া): সালাত, সাওম, সদকা বা অন্যান্য ভালো কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে মানুষের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে করা। এটি ছোট শিরক (শিরকে আসগর)। যদিও এটি বড় শিরকের মতো ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না, তবে এটি আমলের বরকত নষ্ট করে দেয় এবং এর জন্য কঠিন জবাবদিহি করতে হবে।
* আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কসম করা: "তোমার কসম," "আমার বাবার কসম" – এমন করে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে কসম করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কসম করল, সে কুফরি বা শিরক করল।" – সুনানে তিরমিযী, হাদিস: ১৫৩৪
* আল্লাহর ক্ষমতাকে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত করা: যেমন, "আল্লাহ ও অমুক চাইলে এটা হবে" – এমন কথা বলা, যেখানে অন্যের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার সমতুল্য করা হয়। সঠিক বাক্য হলো: "আল্লাহ যা চান, তারপর অমুক যা চান।"
একজন মুসলিমের যে কাজগুলো থেকে বিরত থাকা উচিত:
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও, একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের শিরকের সকল প্রকার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। আমাদের যা করা উচিত:
* একমাত্র আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, ছোট-বড় সকল বিষয়ে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়া।
* সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদন করা: সালাত, সাওম, হজ, যাকাত, দু'আ, কুরবানী – সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা।
* কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করা: শিরকের প্রকারভেদ ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
* মাজার, কবর ও মূর্তির স্থান থেকে দূরে থাকা: শিরকপূর্ণ পরিবেশ থেকে নিজেদের দূরে রাখা এবং অন্যদেরও এসব থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো।
আসুন, আমরা সকলেই শিরকের সকল প্রকার থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখি এবং খালেস তাওহীদের উপর অটল থাকি। আমাদের সকল আমল যেন একমাত্র আল্লাহর জন্য হয় এবং এর বিনিময়ে আমরা যেন তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়েত দান করুন এবং শিরকের অন্ধকার থেকে রক্ষা করুন, আমিন!