
27/07/2025
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি ডিবেটিং ক্লাবের মোশন নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।
মোশনটি ছিলো— "এই সংসদ বিবাহ পরবর্তী অন্য নারী/পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকে সমর্থন করে।"
একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার আবরণে মোড়ানো এই বাক্যটি স্রেফ একটি বিতর্কের বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের এক নগ্ন চিত্রায়ন। এটি এমন এক প্রস্তাবনা, যা সরাসরি আমাদের পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ইসলামিক মূল্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত করে। চলুন, এর ব্যবচ্ছেদ করা যাক।
১। হাইপোথেটিক্যাল ডিবেট, নাকি ফিতরাতের বিকৃতি?
প্রথমেই যে যুক্তিটি সামনে আসে, তা হলো— "এটা তো নিছকই একটি হাইপোথেটিক্যাল বা অনুমাননির্ভর বিতর্ক।" এই কথাটি একটি ধোঁয়াশা তৈরির অপচেষ্টা মাত্র। যে কোনো ধারণা, তা যতই অনুমাননির্ভর হোক না কেন, তা মানুষের মনে রেখাপাত করে। বারবার একই বিষয় নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক একসময় সেই বিষয়টিকে স্বাভাবিক করে তোলে। আজ যা ‘হাইপোথেটিক্যাল’, কাল তা-ই ‘বাস্তবতা’ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় নিয়ে বিতর্কের আয়োজন করা হয় মূলত তরুণদের মন থেকে নৈতিকতার শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলার জন্য। এর মাধ্যমে তাদের বোঝানো হয়, পৃথিবীতে ভালো বা মন্দ বলে চূড়ান্ত কিছু নেই। সবই আপেক্ষিক এবং যুক্তির ওপর নির্ভরশীল।
অথচ একজন মুসলিমের কাছে চূড়ান্ত সত্য হলো ওহী, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। যুক্তি হবে ওহীর অনুগামী, ওহী কখনো যুক্তির অধীন নয়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, "তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ।" (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩২)
এখানে আল্লাহ শুধু ব্যভিচার করতে নিষেধ করেননি, বরং এর নিকটবর্তী হতেও বারণ করেছেন। যে কাজগুলো ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ করে, তার সবই নিষিদ্ধ। এমন একটি বিষয়কে বিতর্কের মোড়কে স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা কি আল্লাহর নির্দেশের সরাসরি লঙ্ঘন নয়?
২। পশ্চিমা দর্শন বনাম ইসলামি সমাজব্যবস্থা:
এই বিতর্কের পক্ষের যুক্তিগুলো সাধারণত পশ্চিমা ভোগবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শন থেকে ধার করা। সেখানে বলা হয়, মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, নিজের শরীর ও ইচ্ছার ওপর পূর্ণ অধিকার ইত্যাদি। এই দর্শন অনুযায়ী, দুটি ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ মানুষের সম্মতিতে যেকোনো সম্পর্কই বৈধ।
অন্যদিকে, ইসলামি সমাজব্যবস্থা পরিবারকেন্দ্রিক। এখানে ব্যক্তিগত ইচ্ছার চেয়ে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে বিবাহ শুধু দুটি ব্যক্তির শারীরিক চাহিদা পূরণের চুক্তি নয়, বরং এটি একটি পবিত্র বন্ধন, একটি ইবাদত এবং একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে দুজন মানুষ একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার করে এবং একটি সুস্থ প্রজন্মের ভিত্তি স্থাপন করে।
বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এই পারিবারিক দুর্গের দেয়ালে প্রথম আঘাত হানে। এটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস ও ভালোবাসার সম্পর্ককে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে জন্ম নেওয়া শিশুরা তাদের পিতৃপরিচয় নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে, যা একটি শিশুকে মানসিক ও সামাজিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। একটি সমাজ তখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়, যখন তার শিশুরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে।
৩। সভ্যতার শেষ স্তর: পরিবার:
ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনো সভ্যতা তার পারিবারিক কাঠামোকে অবহেলা করেছে, তখনই তার পতন হয়েছে। রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আজকের পশ্চিমা বিশ্বেও এর নজির স্পষ্ট। বিবাহবিচ্ছেদ, লিভ-ইন, স/ম-কা-মি-তা এবং পরকীয়ার মতো বিষয়গুলো পশ্চিমা সমাজকে ভেতর থেকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলেছে। তাদের জন্মহার ঋণাত্মক, এবং বৃদ্ধাশ্রমগুলো কানায় কানায় পূর্ণ।
এই ধরনের বিতর্ক আয়োজনের মাধ্যমে মূলত সেই পশ্চিমা মডেলকেই আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালানো হয়। তারা চায়, আমরাও যেন পরিবার নামক এই শক্তিশালী দুর্গটি ভেঙে ফেলি এবং লাগামহীন ভোগবাদে গা ভাসিয়ে দিই। কারণ একটি জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ তার পারিবারিক কাঠামো শক্তিশালী থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো জ্ঞানের চর্চা করা, সত্যকে উন্মোচন করা। কিন্তু যখন জ্ঞানের নামে এমন বিষয়কে উসকে দেওয়া হয়, যা সমাজ ও সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি, তখন তা জ্ঞান নয়, বরং অজ্ঞানতার নামান্তর।
এই ধরনের মোশন কোনোভাবেই একটি বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত অপরাধ, একটি সামাজিক ব্যাধি। খুনের পক্ষে বা চুরির সমর্থনে যেমন বিতর্ক হতে পারে না, ঠিক তেমনি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের পক্ষেও কোনো বিতর্ক হতে পারে না। এটিকে ‘ক্রাইম’ হিসেবেই দেখতে হবে, ‘হাইপোথেটিক্যাল ডিবেট’ হিসেবে নয়।
মুসলিম তরুণদের উচিত, এই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ফাঁদ থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং নিজেদের ফিতরাত বা স্বভাবজাত পবিত্রতাকে অক্ষুণ্ণ রাখা। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজের জন্য একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন পশ্চিমা দার্শনিকদের কোনো ‘যুক্তি’ আমাদের বাঁচাতে পারবে না, একমাত্র ওহীর জ্ঞানই হবে আমাদের মুক্তির উপায়।
— The DEEN