10/01/2025
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিকেল ৪টা ২৫ মিনিট। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকার আদলে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন, তখন তিনি শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার দুই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। সেই কান্না সেদিন একটি জাতির আবেগের একমাত্র ভাষা হয়ে উঠেছিল।
বঙ্গবন্ধুর কান্নার সঙ্গে কেঁদেছিল লক্ষ লক্ষ বাঙালি। যুগে যুগে বাঙালির চোখের জল ঝরেছে, বুকের রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখেছে, কিন্তু সেদিন ছিল অন্যরকম। ৭ কোটি বাঙালির মমতার প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেয়ে সেদিনের আনন্দ-অশ্রু ছিল এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এই রেসকোর্স ময়দান থেকেই মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। সেদিন উত্তেজনায় ভরা মানুষের ঢল যেমন রেসকোর্সে জড়ো হয়েছিল, তেমনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিও ঢাকার পথে পথে মানুষের ঢল নেমেছিল। সেই উত্তেজনার সঙ্গে যোগ হয়েছিল স্বাধীনতার আনন্দ। সেদিন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, **“আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাংলার একজন মানুষও বেঁচে থাকতে এই স্বাধীনতা কেউ নষ্ট করতে পারবে না। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই।”**
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, **“আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও। আমি জানতাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।”**
তিনি আরও বলেন, **“বাংলার মানুষ মুক্ত বাতাসে বাস করবে। খেয়ে-পরে সুখে থাকবে—এটাই আমার সাধনা।”** কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতি টেনে বঙ্গবন্ধু বলেন, **“সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।”** তিনি বলেন, বাঙালি জাতি প্রমাণ করেছে যে তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন সংগ্রাম ইতিহাসে বিরল।
# # # জাতি পুনর্গঠনের ডাক
বঙ্গবন্ধু বলেন, **“আমি প্রেসিডেন্ট বা নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি—যদি দেশবাসী খাবার না পায়, বস্ত্র না পায়, যুবকরা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তোমাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।”** তিনি দুর্নীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কবার্তা দেন এবং সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
# # # অন্য ভাষাভাষীদের প্রতি আহ্বান
বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে অন্য ভাষাভাষী মানুষদের নিরাপত্তা প্রদানের অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, **“আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই, বাঙালিরা শুধু স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে জানে না, তারা শান্তিতে বাস করতেও জানে।”**
# # # বঙ্গবন্ধুকে দেখতে মানুষের ঢল
সেদিন রেসকোর্স ময়দান ছিল জনতার ঢল। কুয়াশা কাটতে না কাটতেই মানুষের স্রোত ছুটে আসে। ৭০ বছর বয়সী করিমননেছা দুই শহীদ সন্তানের রক্তাক্ত কাপড় নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য। তাঁর ভাষায়, **“আমি যার জন্য ছেলেগ পাডাইলাম যুদ্ধ করতে, তারে এক নজর দেইখা যাইতে আইছি।”** এমন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার সাক্ষী ছিলেন আরও অসংখ্য হাতেম আলী, জয়গুনা খাতুনের মতো মানুষ।
# # # বঙ্গবন্ধুর অভিভাষণ
তিনি স্পষ্ট ঘোষণা দেন, **“বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। এর ভিত্তি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।”** তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান এবং বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সাহায্যের আবেদন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, **“বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারত যে সহযোগিতা করেছে, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।”**
# # # ঐতিহাসিক গুরুত্ব
১০ জানুয়ারি ১৯৭২, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর আগমন ছিল স্বাধীন জাতির পুনর্জন্মের মাইলফলক। সেই দিনটি ছিল শুধু তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নয়; এটি ছিল বাঙালির বিজয়গাথার আরেকটি অধ্যায়।