30/03/2025
ঈদে বাড়ি যাওয়ার এই এক সমস্যা। মেস থেকে বেড় হয়ে ট্রেনে উঠার আগ পর্যন্ত রীতিমতো যুদ্ধ চলে। আমিও এই যুদ্ধ এড়ানোর ক্ষমতা রাখিনা। যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য স্টেশনে প্রবেশ করেই খেয়াল করলাম আমার পিছনের পকেটে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করেছে। কাজটা ঠিক কখন করে ফেললো বুঝে উঠতে পারিনি। শরীর শিউরে উঠলো আমার। মানিব্যাগের সামান্য কয়টা টাকা ছাড়া আর কোনো অবশিষ্ট টাকা আমার কাছে নেই। আজকের দিনেই আমার পকেটে আক্রমণ চালাতে হলো! এখন টিকিট কাটবো কিভাবে! সিস্টেম বদলাইলো না। ইউসুফ সরকারকে এর চরম মূল্য দিতে হবে।
মনে মনে পকেটমারের উদ্দেশে বদদোয়া দিচ্ছি আর ভাবছি কি করা যায়। এখন টিকিট কাটবো কিভাবে! ওদিকে বাড়ি যাওয়াও জরুরী। কোনো বন্ধুর কাছে ধার চাইবো? উমম নাহ, অলরেডি অনেকের কাছে ধার করা হয়ে গেছে। সেগুলো পরিশোধ না করে উল্টো আবার ধার চাওয়াটা অনেক লজ্জার। এর চেয়ে একটা রিস্ক নিলে কেমন হয় ..
যা আছে কপালে। কবি বলেছেন এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। আমিতো অলরেডি যুদ্ধের ময়দানে আছি। রিস্ক না নিলে যুদ্ধে জেতা যাবেনা। ভাবতে ভাবতে ভিড় ঠেলে টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠে পড়লাম আমি। স্টেশনে দাড়িয়ে থাকা ট্রেন টার ভিতরে তিল পরিমাণ জায়গা বাকি নেই দাড়াবার জন্য। ভিড় ঠেলে একটু ভিতরে যেতেই দেখলাম বগির মাঝখানে একটা সীটে বসে তার সামনের মুখোমুখি থাকা সীটে পা তুলে দিয়ে বসে আছে এক রমনী। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো সানগ্লাস। তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। তার মুখ দেখতে পাচ্ছিনা। পিছন থেকে শুধু তার লম্বা ঘন কালো চুল দেখা যাচ্ছে।
আমি তার পাশে দাঁড়াতেই সে একবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে ঘুরে তাকালো। খেয়াল করলাম তার গালের একপাশে মস্ত বড় একটা তিল। যেটা তার রূপের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে সহযোগিতা করছে। এরপর আবারও মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। এ তো দেখি অনেক সুন্দরী মেয়ে? সাক্ষাৎ অপ্সরী। চেহারা দেখে তো লাট সাহেবের মেয়ে মনে হচ্ছে। এক সীটে বসে আবার অন্য সীটে পা দিয়েছে! সীট কি ওর বাপের নামে রেজিস্টার করা নাকি! সামনে ফাঁকা সীট থাকতেও আমার মতো ছেলে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ট্রেন জার্নি করবে! নাহ, এত বড় অন্যায় তো মেনে নেয়া যায়না। রীতিমতো বৈষম্য চলছে। এইসব সহ্য করার জন্য দেশ স্বাধীন করছি নাকি! কিন্ত কি বলবো? মেয়েটাকে সীট থেকে পা সরাতে বলবো? যদি রেগে যায়! সুন্দরী মেয়েরা নাকি আবার অনেক রাগী হয়!
দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবছি। কপাল বেয়ে ঘাম ছুটছে আমার। সাথে টিকিট নেই সেটা নিয়ে তো দুশ্চিন্তা আছেই। তারপর এত লম্বা ভ্রমণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবেনা। মনে মনে আরেকবার পকেটমারকে বদদোয়া দিলাম। এরই মধ্যে ট্রেনে জোরেসোরে একটা হুইসেলের সাথে ঝাঁকুনি হলো। ট্রেন স্টেশন ছাড়তে আরম্ভ করেছে।
আজ যা আছে কপালে দেখা যাবে, এত লম্বা জার্নি দাড়িয়ে দাড়িয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না! এই সীট আমার লাগবেই। রাগ করলে করবে। সুন্দরী জন্য কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি! সুন্দরী মেয়েরা নাকি রেগে গেলে আরো বেশি সুন্দর লাগে। কেমন সুন্দর লাগে সেটাও দেখে নেয়া যাবে। ভাবতে ভাবতেই মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম ..
– এক্সকিউজমি ম্যাডাম, পা সরান বসবো।
মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। চোখের চশমাটা চোখ থেকে খুলে মাথায় রাখলো। আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে সম্ভবত আশ্চর্য হয়েছে। পা না নামিয়ে প্রশ্ন করে বসলো মেয়েটা।
– সীটটা কি আপনার?
আমি এমন প্রশ্ন শুনে একটু রেগে গেলাম।
–আপনি কি টিটি যে আপনাকে এখন টিকিট দেখাতে হবে! সীট ছাড়ুন। মানুষ দাড়িয়ে আছে আর আপনি একাই দুইটা সীট দখল করে আছেন লজ্জা করেনা?
মানিব্যাগ হারানোর কষ্ট সাথে গরম আবহাওয়া। মাথাটা এমনিতেই ধরে আছে। মেজাজ হারিয়ে কথা শুনিয়ে দিলাম মেয়েটাকে। কিন্ত খেয়াল করলাম মেয়েটা আমার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। উল্টো একটা মুচকি হাসি দিলো। মেয়েটার স্ক্রু ঢিলা নাকি! আমি কথা শুনালাম আর সে মুচকি হাসে! সীট থেকে পা নামিয়ে নিলো মেয়েটা।
– ওকে স্যার, আপনি বসতে পারেন।
আরে এত বাধ্য মেয়ে! একবার বলাতেই সীট ছেড়ে দিলো! কোথায় ভাবলাম তার রাগি চেহারা টা দেখবো! আরে এসব কি ভাবছি আমি! সীট পেয়েছি এখন আমার জলদি বসে পড়া উচিৎ।
আমি সীটে বসলাম। মেয়েটা আবারও তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। আর আমি তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। জানালা দিয়ে আসা দমকা বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছে। সুন্দরী মেয়ে সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই আমার ধারণা তাদের রাগ সবসময় একটু বেশি থাকে। তারা বাংলা সিনেমার দজ্জাল শাশুড়ি রিনা খান টাইপের হয়। আমার সামনে বসা মেয়েটাও কি তাই! একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়। খুব বেশি রেগে গেলে কি এমন হবে! একটা থাপ্পড়ের বেশি তো কিছু হবেনা। রাজপথে বুক চ্যাতায়া গুলি খাওয়ার থেকে একটা থাপ্পড় হজম করা অনেক সহজ। কথা বলার উদ্দেশ্যে গলা খাকাড়ি দিলাম আমি …
– এই যে ম্যাডাম ..
আচমকা ঘুরে তাকালো মেয়েটা
– জি বলুন
– আপনার গালের তিলটা অন্য লেভেলের
– থ্যাঙ্কস
– আরে থ্যাঙ্কস জানানোর কি হলো! অন্য লেভেলের বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি তিলটা আপনার গালে একদম মানাচ্ছে না।
– হোয়াট!
– হুম, একদম বাংলা সিনেমার দিলদারের মতো লাগছে।
আমার কথা শুনে মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে। ঝড় আসার পূর্বে প্রকৃতি এমন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এ কি! খুব বেশি রেগে যাবে নাকি! কিন্ত না, মেয়েটা আমাকে অবাক করে দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠে উত্তর দেয়..
– মনে হচ্ছে আপনি দিলদারের অনেক বড় ফ্যান?
আরে, এই মেয়ে কি এলিয়েন নাকি? এত বাজে কমপ্লিমেন্ট দিলাম তাও রেগে যাচ্ছে না! উল্টো খুশি হয়ে যাচ্ছে! আচ্ছা অন্যভাবে ট্রাই করিতো। কি সুন্দর চুল মেয়েটার। মনে হয় চুলের খুব যত্ন নেয়। চুল নিয়ে বাজে কমপ্লিমেন্ট দিলে নিশ্চয়ই রেগে যাবে। আবারও রাগানোর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলাম …
– হুম, দিলদার বলতে মনে পড়লো, আপনার চুলগুলো কিন্ত একদম পারফেক্ট!
লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে উত্তর দিলো সে
– ওহ, থ্যাঙ্কস!
– আহা আমি সেটা বুঝাইনি। আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে আপনার চুলগুলো কাকের বাসা বানানোর জন্য একদম পারফেক্ট।
– ইশ তাই নাকি! আপনার কথা শুনে ইচ্ছে করছে এখুনি কাকের কাছে নিজের চুলগুলো দান করে দেই!
এই মেয়ে পিওর সাইকো। অন্য কোনো মেয়ে হলে এতক্ষণ আমার কলার ধরে ঝাঁকুনি দেয়া শুরু করতো। চুল ছিঁড়ে নেয়া শুরু করতো। অন্তত দুই তিনটা ঝাড়ি তো মারতোই। ঝাড়ি না মারলেও রাগি চোখে তো তাকাতোই। সুন্দরী মেয়ে আবার এত নরম মনের হয় নাকি! নাহ, এই মেয়ে সাধারণ কোনো মেয়ে হতেই পারেনা। এত ধৈর্যশীল মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। মেয়েটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আমি। ঠিক সেই মুহুর্তে আমার কাধে অপরিচিত একটা হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘার তুলে তাকাতেই দেখলাম অদ্ভুত সাজের একটা লোক আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চেহারা দেখে বুঝাই যাচ্ছে সে শরীফ না আবার শরীফাও না। ঠোঁটে এমনভাবে লিপিস্টিক মেখেছে যেনো এইমাত্র জোকার মুভির শুটিং শেষ করে আসলো। সে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে জিজ্ঞেস করলো …
– কিরে জান্টুস, সারা রাস্তায় কি এই সুন্দরী গালপেন্ডের দিকে তাকায় থাকবি নাকি আমার দিকেও এট্টু তাকাইবি?
– মানে, আমি কেন তোমার দিকে তাকাবো! আশ্চর্য!
– ও তাইলে কি আমি সারা রাস্তায় তোর দিকে তাকায় থাকমু!
– সে কি! তুমি কেন আমার দিকে তাকায় থাকবা?
– তাইলে বিশ টাকা দে
আরে, আমার পকেটে নাই এক টাকা আর সে বিশ টাকা দাবি করছে। এখন কি করি! এরা তো আবার নাছোড়বান্দা।
– ওই, ট্যাকা দিবিনা?
– আরে বিশ টাকা দিয়া তুমি কি করবা?
– ললিপপ খামু।
– আরে কি বলো, এই বয়সে কেউ ললিপপ খায়! যাওতো মশকরা করো না। যাও।
– ওই, তুই ট্যাকা দিবি নাকি তোর প্যান্ট খুইলা নিমু? তখন কিন্ত তোর ললিপপ সবাই দেইখা ফেলবে। বুঝোস কিন্তু!
– আরে আরে! ছিহ! কি বলে এগুলা!
কথোপকথন শুনে সামনে বসে থাকা সুন্দরী মেম সাহেব খিল খিল করে হেসে উঠলো। আমি আছি বিপদে আর এই মেয়ে মজা নিচ্ছে! সাথে সাথে আবারও হুঙ্কার এলো
– কিরে, ট্যাকা দিবি? নাকি ..
– আরে বাবা আমার কাছে টাকা নাই।
– তুইতো ভালোই কিপ্টা আছোস রে। ছুট বুট পইড়া বড়লোক বেটাগো মতো ট্রেনে উঠছোস, সুন্দরী গালপেন্ড নিয়া ঘুরতাছোস আর পকেটে নাই বিশ ট্যাকা। মশকরা করোস? এখন তো আমি পঞ্চাশ টাকার কম তোরে ছাড়মুই না।
– আরে কি মুসিবত!
আমাকে মাইনকার চিপায় পড়তে দেখে সুন্দরী মেয়েটা মুখ চেপে ধরে আরো জোরে হেসে উঠলো। আমি বেজায় রেগে গেলাম। কিন্ত মানিব্যাগ হারানোর কথাটা মনে হতেই নিজেকে শান্ত করলাম। মনে মনে পকেটমারটাকে আরেকবার বদদোয়া করলাম। আর এই শরীফ শরীফার মাঝামাঝি লোকটার থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য মেয়েটার দিকে তাকিয়ে অনুনয় করে বলতে লাগলাম ..
– আরে ও ম্যাডাম, পঞ্চাশ টাকা ধার হবে? আমি পরে দিয়ে দেবো।
আমার অনুনয় শুনে মেয়েটা হাসি থামিয়ে বলতে লাগলো
– ধার নয়, আপনার হয়ে পুরো টাকা আমি পরিশোধ করে দেবো।
– সে কি, আপনি তো দেখি সাক্ষাৎ দেবী।
– কিন্ত তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
– আরে কি কাজ জলদি বলুন। আমি সব করবো তবু এই লোকের থেকে আমাকে উদ্ধার করুন। এদের কাজকর্ম খুবই ভয়ংকর।
– হুম, এতক্ষণ ধরে যে আজেবাজে কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছিলেন আমাকে নিয়ে। এখন তিনবার স্যরি বলুন। হাতজোর করে বলতে হবে কিন্ত ..
রীতিমতো চমকে উঠলাম আমি। ওরে সুন্দরী রমনী আমিতো ভেবেছিলাম তোমার কোনো রাগই নাই। তুমিতো দেখি প্রতিশোধ নেয়ার অপেক্ষায় ছিলে। এই ছিলো তোমার মনে! কি আর করার, মাইনকা চিপা থেকে বাঁচতে এই মেয়ের সামনে আমাকে মাথানত করাই লাগবে। পকেটমারের বাচ্চাটার আজই সময় হলো আমার মানিব্যাগ চুরি করার। ফাটা কপাল আমার। পকেটমারকে আরেকবার মনে মনে বদদোয়া দিয়ে মেয়েটার উদ্দেশ্যে হাতজোর করা শুরু করলাম ..
– ওহে ম্যাডাম, আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দেন। আপনার মতো সুন্দরী নারী আমি জীবনেও দেখিনি। আপনার চুল জগতের শ্রেষ্ঠ চুল। আপনার গাল জগতের শ্রেষ্ঠ গাল। আপনার গালের ওই ছোট্ট কালো তিল যেনো মরুভূমির বুকে খেজুর গাছের ছায়া। সমস্ত পথিক যেনো সেই ছায়ায় আশ্রয় নিতে চায়। তারা সেই ছায়ার প্রেমে মশগুল হয়ে যায়। ওটা যেনো তিল নয়। যেনো বিধ্বস্ত বাংলাদেশে আশার আলো দেখানো অন্তর্বর্তীকালীন ইউসুফ সরকার।
আমার কথা শুনে আবারও খিলখিল করে হেসে উঠে মেয়েটা।
– হাহাহাহা, হয়েছে হয়েছে। আর মনের বিরুদ্ধে জোর করে কোনো কমপ্লিমেন্ট দিতে হবেনা। পঞ্চাশ টাকা ধার দিতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে উল্টো আপনাকে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা করা দরকার ওভারএক্টিং এর জন্য।
পার্স থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে দাড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে এগিয়ে দেয়। টাকা নিয়েই লোকটা খুশিতে গদগদ হয়ে বলতে থাকে..
– আল্লাহ তোর ভালো করুক রে দিদি। আর তোর এই কিপ্টা বয়পেন্ডের উপ্রে ঠাডা পড়ুক।
আরে আরে! লোকটার দিকে রাগি চোখে তাকালাম তার কথা শুনে। সে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো। টাকাও নিলো বদদোয়াও দিলো কি সাংঘাতিক! ইউসুফ সরকারকে এর চরম মূল্য দিতে হবে। সাথে সাথে সুন্দরী মেয়েটা প্রশ্ন করে বসে ..
– কি মিস্টার, আমাকে অপমানজনক কথা বলার শখ মিটেছে তো?
– মানিব্যাগটা চুরি না হলে দেখে নিতাম। যাইহোক, আপদটা যেহেতু বিদায় হয়েছে তাই আর কোনো ভয় নেই আমার। এখন আমি আমার কমপ্লিমেন্ট আগের টাই রাখছি। আপনি আসলেই দিলদারের ফিমেল ভার্সন।
– কিহহহহহ!
সত্যিকারের রাগ ফুটে উঠে মেয়েটার চেহারায়। উচ্চস্বরে হেসে উঠি আমি ..
– ওয়াও আমি পেরেছি। আপনাকে রাগাতে পেরেছি।
কিন্ত আমার হাসি খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। কাধে আবারও কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘার ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি কোট পড়া এক চশমিশ ভদ্রলোক চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
– ও ভাই, রাগারাগি পরে করবেন। আগে টিকিট দেখান।
আরে, এই লোকের এখুনি আসার সময় হলো! এখন কি করি! টিকিট তো নেই! কি বলি এখন! কিছু একটা তো করতে হবেই। মনে মনে আবারও পকেটমারকে একটু বদদোয়া করে নিলাম। আর ভাবতে লাগলাম কিভাবে এই মুসিবত থেকে রেহাই পাবো। হ্যাঁ, আইডিয়া।
– কাকু, একটু পরে আসুন। টিকিট আমার ভাইয়ের মানিব্যাগে।
– টিকিট …..
– আরে কাকু, আমার ভাই মানিব্যাগ সহ টয়লেটে গেছে।
– টিকিট!
– আহ কাকু একটু পরে আসুন না।
– টিইইকিইইইট……..
– আরে টিকিট কিসের জন্য? আমি কি সিনেমা হলে ঢুকেছি যে টিকিট লাগবে?
– মনে হচ্ছে ভালোই সিনেমা দেখো বাপু। শেয়ানা গিরি হচ্ছে? ট্রেনে কি নতুন নাকি!
– কারেক্ট, আমিতো নতুন।
– টিকিট ছাড়া যে ট্রেন ভ্রমণ অবৈধ এইটা জানা ছিলোনা?
– আরে, ট্রেন তো সরকারি গাড়ি। আমিতো জানতাম সরকার এটা জনসেবার জন্য ফ্রি যাতায়াত ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কি এক্টা ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেলো বলুন তো! আচ্ছা নেক্সট টাইম অবশ্যই টিকিট সহ উঠবো।
– হুম তা তো করবেই। আর এইবার ডাবল ফাইন দিতে হবে।
– সে কি! কেন?
– সরকারি গাড়ির এটাই সরকারি আইন!
– কিন্ত আমার কাছে তো টাকা নাই কাকু! দেখুন এট্টু চেষ্টা করে সমন্বয়ক কোটায় ফাইন টাইন মওকুফ করা যায় কিনা।
– তাইলে এবার সরকারি ঘরে তোমার ফ্রি তে থাকার ব্যবস্থা করতে হয় দেখছি। পুলিশকে ডাকবো নাকি টাকা বের করবে?
সামনের সুন্দরী মেমসাহেব আবারও খিলখিল করে হেসে উঠলো। মেজাজ হারিয়ে ফেললাম আমি ..
– মানুষ বিপদে পড়েছে আর তিনি হাসছেন? কোথায় বিপদ থেকে উদ্ধার করবে তা না করে মজা নিচ্ছে!
– ও মিস্টার! আপনাকে উদ্ধার করলে একটু পরেই তো সেটা ভুলে যাবেন।
– ভুলবো না। কসম খোদার। শেষবারের মতো আমায় উদ্ধার করুন।
– আহা, এভাবে বললে তো হবে না। লম্বা করে রিকোয়েস্ট করুন। বলুন,,, প্লিজজজজজ
ইশ, কি দিন এলো! এই দৃশ্য দেখার জন্য দেশ স্বাধীন করছিলাম! একটা মেয়ের কাছে বার বার মাথা নত করতে হচ্ছে! সকালে কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। আরে হ্যাঁ মনে পড়েছে। নিজের মুখই তো দেখছিলাম আয়নাতে। ফাডা কপাল আমার। মনে মনে পকেটমারকে আরেকটু বদদোয়া করলাম।
– কি হলো, বলুন ।
– ও হ্যাঁ .. প্লিজজজজজজজ …
আবারও তার খিলখিল হাসির শব্দ।
পার্স থেকে একটা টিকিট বের করে টিটির উদ্দেশ্যে দিলো। আর বললো ..
– দুটো সীটই আমার। আর আমরা দুজন একসাথে আছি।
টিটি মহাশয় চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে টিকিটটার একটা ছোটখাটো পোস্টমোর্টেম করে বিদায় নিলো। আমি তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে।
– এই যে মিস্টার কি দেখছেন এভাবে?
– দেবী, এ যেনো সাক্ষাৎ দেবী রূপে হাজির হয়েছে আমার সামনে। বার বার আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করছে।
– হয়েছে হয়েছে, ঢং! একটু পরেই তো ভুলে যাবেন সব।
– ও হ্যাঁ, এই সীটটা যে আপনার সেটা আগে বলেন নি কেন!
– হা হা হা, আগে বললে কি করতেন? দাড়িয়ে যেতেন বুঝি?
– আপনি কিন্ত আসলেই..
– আসলেই কি?
– দিলদার
– এই, বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্ত ..
– হুম, তিলটা আসলেই বাড়াবাড়ি। অবশ্য তিলটা না থাকলে খুব একটা সুবিধা হতো না। টেলি সামাদের মতো লাগতো তখন.. হাহাহা..
– কিহ… আপনাকে আমি খুন করে ফেলবো কিন্ত ..
– হাহাহা….
এরপর ট্রেনের ঝকঝক শব্দের সাথে শুধু হাসি আড্ডা আর খুনশুটি। যার স্থায়িত্ব কয়েক মুহুর্ত থেকে শুরু করে কয়েক ঘন্টায় গিয়ে ঠেকে যায়। কথায় কথায় জানতে পারলাম দুজনের গন্তব্য একই স্টেশন। দুই বান্ধবীর একসাথে যাওয়ার কথা থাকলেও কারণ বসত একজন আজ যেতে পারছে না। তাই দুটো সীটের একাই ভাগীদার হয়েছে সে। আমিও জানালাম পকেটমারের কবলে পরে আজ আমার এই নাজেহাল অবস্থা। একে অপরের ব্যপারে অনেক কিছু জানলাম আমরা। স্টেশনে দুজনে একসাথে নেমে গেলাম। আমি তার লাগেজটা ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতেই দেখলাম সে আমার দিকে একটা একশত টাকার নোট ধরে দাড়িয়ে আছে।
– আরে ম্যাডাম করছেন কি! নিজেকে কুলি নাম্বার ওয়ান মনে হচ্ছে তো।
– এত ভাব না দেখিয়ে টাকাটা ধরুন বলছি।
– অলরেডি আমি আপনার কাছে অনেক ঋণী।
– আপনার পকেটে কোনো টাকা নেই আমি জানি। নেক্সট টাইম থেকে মানিব্যাগ সাবধানে রাখবেন। টাকাটা নিন, এটা দিয়ে অন্তত আপনার বাড়ি যাওয়ার জন্য রিক্সা ভাড়া হয়ে যাবে।
– আরে না, আমি হেটে যেতে পারবো
মেয়েটা ঝাড়ি মেরে বলে উঠলো ..
– উফ বাবা, ছেলে মানুষ ভালোই ন্যাকামি করতে জানেতো। রাখুন বলছি। আর আমি কি টাকাটা একবারে দিয়ে দিলাম নাকি! পরে সময় করে ফেরত দিয়ে দেবেন।
– জি অবশ্যই।
ঝাড়ি খেয়ে তরিঘরি করে টাকাটা নিলাম আমি।
–তাহলে চলি।
– হুম
দুজন দুদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছে কি যেনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে গেছি। হঠাৎ কিছু একটা মাথায় আসতেই আমি আবার ঘুরে দাঁড়ালাম। ঘুরে তাকাতেই দেখি মেয়েটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে লাগেজ হাতে দাড়িয়ে। মুচকি হেসে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ..
– কিছু বলবেন?
আমি মাথা চুলকাই গাজনীর আমির খানের মতো। ভ্রমন সঙ্গী যদি মেয়ে হয় তবে বিদায় বেলায় তাকে কি বলতে হয় তা আমি অধমের জানা নেই।
– ইয়ে মানে, কি যেনো বলতে চাইলাম। উম, ও হ্যাঁ। ট্রেনে আমাকে বার বার বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি সত্যিই সাক্ষাৎ দেবী।
– হাহাহা। এটা বলার জন্যই ঘুরে দাঁড়ালেন?
– উম, কি জানি!
– আর কিছু বলার নেই?
– কি বলবো বুঝতে পারছি না।
– কিছু জানার নেই?
– ইয়ে মানে, কি জানবো আর?
– ও আচ্ছা। ঠিক আছে। ভালো থাকবেন আমি চললাম।
মেয়েটা হন হন করে চলে যেতে শুরু করে। যেনো সে অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। আমিও বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলাম। দুই মিনিট হাঁটার পরেই বুঝতে পারলাম আমার বুকের বাঁ পাশে চিনচিন করছে।
আচমকা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। সেইসাথে একরাশ বিষন্নতা গ্রাস করে নিলো আমার বুকের বাঁ পাশটা। এরপর ঝুম বৃষ্টি। ছাউনির নিচে দাড়িয়ে রইলাম আমি। পাশে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত এক যাত্রীর ফোনে গান বাজছে ..
“ প্রেম একবারই এসেছিলো নীরবে, আমারও দুয়ারো প্রান্তে,
সে যে হায়, মৃদু পায়, এসেছিলো পারিনি তো জানতে। “
চমকে উঠলাম। চিন চিন করে উঠলো বুকের বাঁ পাশটায়।
তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাড়িয়ে দেখলাম স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেছে। মেয়েটার কোনো চিহ্ন নেই যতদূর চোখ যায়। ছোট্ট একটা ভুলে অনেক বড় মিস্টেক হয়ে গেছে।
ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই ছাউনি ছেড়ে মেয়েটাকে খুঁজতে ছুটলাম। জানিনা খুজেঁ পাবো কিনা। পুরো স্টেশন ছুটোছুটি করে কোথাও তাকে পেলাম না। বৃষ্টির তীব্রতা দেখে বুঝাই যাচ্ছে এই বৃষ্টির মধ্যে রিকশায় যাওয়া সম্ভব না। তাহলে মেয়েটা গেলো কোথায়!
শেষবারের মতো ওয়েটিং রুমে টুকি মারলাম। আর তাকেও পেয়ে গেলাম।
প্রথমবারের মতো আমি পকেটমারটাকে বদদোয়ার বদলে দোয়া করে দিলাম।
মেয়েটা আমাকে দেখেই বলে উঠলো
– আপনিও যেতে পারেননি?
আমি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছি।
সে মুচকি হেসে আবারও প্রশ্ন করে
– কিছু বলবেন নাকি?
আমি আমতা আমতা করে জবাব দেই
– আসলে আপনার ফোন নাম্বার নেয়া হয়নি। টাকা ফেরত দিবো কিভাবে?
খিল খিল করে হেসে উঠে উত্তর দেয় মেয়েটা
– ও এইজন্য এত চিন্তিত লাগছে। আসুন এখানে বসুন। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত গল্প করি।
আমার মনে অজানা এক শিহরণ জাগে। আমি জানিনা এটা কিসের অনুভূতি। কিন্ত কেন যেনো খুব করে চাচ্ছিলাম এই বৃষ্টি আজীবন থাকুক। ঠিক যেভাবে সমন্বয়ক ভাইয়ারা চায় এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আজীবন থাকুক।
– সাংঘাতিক রেল ভ্রমণ
– Khalid Hasan