
07/10/2025
#ভিএম্পায়ার
#পর্বঃ১৬
#লেখাঃKhalid_Hasan
উঠে দাঁড়ালো এজেন্ট খালিদ। ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে হেঁটে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। রুমালের আড়াল থেকে ভেসে এলো তাঁর কণ্ঠস্বর
– আমাকে নিশ্চিত করো পিচ্চি ছেলে, তুমি তাঁর সাথে চুক্তি করোনি।
আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলাম। লোকটা কি বিষয়ে বললো মাথায় ঢুকলো না। সে আবারও বললো ..
– তুমি কি বুঝতে পারছোনা আমি তোমার ভিতরে থাকা পরজীবীর ব্যপারে বলছি!
এবারে পরিষ্কার বুঝলাম আমি। কিন্ত আমার ভিতরে পরজীবী বাস করে সে ব্যপারে এই আগন্তুক কিভাবে জানলো! সে কি অন্তর্যামী! না, এটা তো অসম্ভব! লোকটাকে খুবই চিন্তিত লাগছে। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম ..
– যদি বলি আমি তার সাথে চুক্তি করেছি?
রুমালের বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম এজেন্ট খালিদের রাগান্বিত কুচকানো ভ্রু
– তবে এখানেই তোমার জীবন গল্পের সমাপ্তি হবে।
লোকটার কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি। যেনো প্রচন্ড রেগে গেছে সে। খানিক বাদেই শান্ত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটা বললো ..
– আমি জানি তুমি এমনটা করোনি। আর আমার বিশ্বাস তুমি এমনটা কখনো করবেনা। আর যদি করো তবে আমার হাতেই তোমার জীবনের সমাপ্তি হবে।
তার কথাবার্তা খুবই রহস্যময় লাগছে আর আমি ক্রমেই বিষ্ময়ের সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম
– আমি তা করিনি আপনি এটা কিভাবে নিশ্চিত হলেন?
লোকটা তার ব্রিফকেস নিয়ে আবারও বালির উপর বসে পড়লো। কিছু একটা করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো আবারও। উত্তর দিল ..
–তোমার সাথে তো এটাই প্রথমবার সাক্ষাৎ নয়। পরজীবীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে কবেই তোমার জীবনের সমাপ্তি হয়ে যেতো। অবশ্যই আমার হাত দিয়েই সেটা হতো।
অবাক হয়ে গেলাম আমি। লোকটার সাথে আসলেই কি আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো এর আগে! না, তা কিভাবে সম্ভব! আমি এতিমখানায় বড়ো হওয়া ছেলে। এতিমখানা সমুদ্রসৈকত আর আমাদের এতিমখানার পাশে থাকা বাজার পর্যন্তই আমার বিচরণ ছিলো। এমন আজগুবি পোশাকের মানুষের সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। জিজ্ঞেস করলাম ..
– মাফ করবেন স্যার, কিন্ত আমার সাথে আপনার এর আগে কোথায় সাক্ষাৎ হয়েছিলো? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।
লোকটা মুখ তুলে চাইলো আমার দিকে। বললো ..
– ওহ আমারই ভুল হয়েছে কোথাও। একটু কনফিউজড। আমাদের দেখা হয়েছিলো ভবিষ্যতে।
– অদ্ভুত তো! আপনি বলছেন ভবিষ্যতে! আবার বলছেন দেখা হয়েছিলো!
লোকটা একটু হাসলো। তারপর ব্রিফকেসে নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলতে লাগলো ..
– বাদ দাও, ব্রেইনে এত চাপ প্রয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই। কাজের কথায় আসা যাক। আমি ভ্যালমোরায় এসেছি একটা সিক্রেট মিশনে। যেটা তোমার সহযোগিতা ছাড়া কম্প্লিট করা সম্ভব নয়।
– এর মানে!
– এর মানে হলো তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে।
– একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন মিস্টার আগন্তুক। এজেন্সি “ট্রিপল এ” টাকা ছাড়া কোনো চুক্তি করেনা।
হোহো করে হেসে উঠলো লোকটা। অদ্ভুত! আমি কি কোনো জোকস বলেছি! প্রশ্ন করলো সে ..
– তুমি খুবই মজার ছেলে তো। সবসময়ই কি এমন মজা করো?
সে আবার উঠে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে বললো…
– শুনো পিচ্চি, ভ্যালমোরায় আনাচে কানাচে মনস্টারদের আবির্ভাব হচ্ছে। তুমি কি ভাবো কাড়ি কাড়ি টাকা তোমাকে এদের থেকে বাঁচাতে পারবে? ইতোমধ্যেই তোমার অনেক শত্রু তৈরী হয়ে গেছে। আমার সাথে চুক্তি করো, আমি তোমাকে বিনিময় হিসেবে যা দিবো তা আর কেউ দিতে পারবে না। আর তার বিনিময়ে আমি তোমাকে যা করতে বলবো তাই করবে।
– ওয়েট ওয়েট, আপনি আমার কাছে সহযোগিতা চাচ্ছেন তার মানে আমি যোগ্য ব্যক্তি তাইতো! ওকে, আমি সবকিছু করতে পারি। তবে আমার জানা জরুরী বিনিময়ে আপনি আমাকে কি দিবেন।
লোকটা একদম মাথা নুইয়ে আমার কানে কানে বললো ..
– ভ্যালমোরার হিরো বানাবো তোমাকে। ভ্যালমোরা থেকে বের হওয়ার রাস্তা দেখাবো। তুমি যেতে পারবে সমুদ্রের ওইপাড়ে। যেটা ভ্যালমোরার সবার কাছে একটা স্বপ্ন মাত্র। আর সবচেয়ে বড়ো রহস্য, তোমার গলায় ঝুলে থাকা ওই লকেট! হাহাহা, এর ব্যপারে হয়তো আমিই সবচেয়ে ভালো জানি। বলো পিচ্চি ছেলে, এমন বিনিময় মূল্য কি তোমার ভিতরে বসবাসকারী পরজীবী দিতে পারবে? মনে রাখবে, ভিতরে বাস করা পরজীবী যা দেয় তার থেকে বেশি কেড়ে নেয়। আমি তেমনটা নই।
সরে দাঁড়ালো লোকটা। আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। লোকটা কি আসলেই অন্তর্যামী! সে কিভাবে জানলো আমি ভ্যালমোরার হিরো হতে চাই! কিভাবেই বা জানলো আমি সমুদ্রের ওপারে যেতে চাই! আর এই লকেট! সে কি সত্যি আমাকে আগে থেকেই চিনে! আমার পিছনে পড়ে ছিলো আগে থেকেই! সে কি আগে থেকেই জানে আমি একটা মনস্টার হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে! লোকটা আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দিলো ..
– বলো, তুমি কি চুক্তি করতে প্রস্তুত?
আমার মস্তিষ্কে ট্রাফিক জ্যাম লেগে যেতে লাগলো। আমার এখুনি সম্মতি জানাতে হবে। হ্যাঁ এখুনি। অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ..
– ডিল ফাইনাল, বলুন আপনাকে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?
হেসে উঠলো লোকটা
– হাহাহা, জানতাম রাজি না হয়ে পারবে না।
আমার মাথায় হাত রাখলো লোকটা। তারপর বললো ..
– এত তাড়াহুড়ো করতে হবেনা পিচ্চি ছেলে। মিশন তো সবেমাত্র শুরু হলো। তবে আমাকে সহযোগিতা করার মতো যোগ্যতা এখনো তোমার হয়নি। আগে তোমাকে যোগ্য বানাতে হবে। যোগ্য হওয়ার জন্য সহযোগিতা আমিই করবো। আর যোগ্য হবার পরেই জানাবো তোমাকে কি করতে হবে। আপাতত তোমার একটাই কাজ আর সেটা হলো তোমার রাজ্যের কিং কে পরাস্ত করা। আশাকরি এই সহজ কাজটা তুমি খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলবে। আমাদের আবারও দেখা হবে। খুব শিঘ্রই …
কিং কে পরাস্ত করতে হবে! লোকটার মাথা ঠিক আছে! কি বলছে সে! কিং কে পরাস্ত করা সহজ কাজ!
লোকটা তার হাতে থাকা একটা কালো বস্তুতে কিছু একটা করলো। আর সেটা করতেই আমার পিছনে খানিকটা দূরে আলোর ঝলকানি শুরু হয়ে গেলো। আমি পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম একটা পোর্টাল খুলেছে। আরে! এই জিনিস তো আমি আগেও দেখেছিলাম। হ্যাঁ, মারিয়া। মারিয়া এর ভিতর থেকে আসে। লোকটা বলতে লাগলো ..
– এর ভিতরে প্রবেশ করো। তোমার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। অবাক হবার কিছু নেই পিচ্চি ছেলে। আরো অনেক কিছু জানা বাকি তোমার। এখুনি এত অবাক হলে চলবে না। আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। ভবিষ্যতে আমরা একসাথে সব বিস্ময়কর ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ পাবো।
আমি বাধ্য ছেলের মতো পোর্টালের দিকে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। তীব্র আলো আসছে সেখান থেকে। ঢুকতে যাবো এমন সময় পিছুডাক ..
– কিছু একটা ভুলে গিয়েছো পিচ্চি ছেলে।
পিছন ঘুরে তাকালাম। সে আবারও তার ব্রিফকেস নিয়ে বসে পড়েছে। মাথা নোয়ানো অবস্থাতেই বললো ..
– ভিক্টরের মতো মনস্টার থেকে বাঁচিয়েছি তোমায়। তুমি ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেছিলে ..
আরে তাইতো, ভিক্টরের কথা তো ভুলেই গেছিলাম। সে হাসতে হাসতে বললো ..
– আচ্ছা এখুনি ধন্যবাদ দিতে হবেনা। জমা করে রাখো। আমি একসাথে অনেক ধন্যবাদ পেতে চাই। এবারে যাও .. কিং কে পরাস্ত করার প্রস্তুতি নাও। এটাই তোমার রাজ্যের জন্য মঙ্গলজনক। বেস্ট অফ লাক ..
সে বুরো আঙ্গুল দেখিয়ে আমার থেকে মনোযোগ সরিয়ে মাথা নুইয়ে আবারও তার ব্রিফকেসে কিছু একটা করতে লাগলো। আমি দ্রুত পোর্টালে প্রবেশ করলাম। তীব্র আলোর ঝলকানি আর শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। আলোর ঝলকানিতে চোখ বন্ধ করেই সামনের দিকে পা বাড়ালাম আমি। আর চোখ খুলেই দেখলাম আমি দাড়িয়ে আছি আমাদের হোস্টেলের পিছনের দিকে।
পোর্টাল বন্ধ হয়ে গেলো। আলোর ঝলকানি নিভে গেলো। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ঘন জঙ্গল। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আমার। কি সব আজগুবি ঘটনার শুরু হয়েছে আমার সাথে। ও হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ভিক্টরের ব্যপারে। দ্রুত হোস্টেলে যাই। লোকটা একটা মনস্টার এবং সে আমার উপর চরমভাবে ক্ষেপে আছে। যেকোনো সময় আবারও আক্রমণ করতে পারে। আমার দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিতে হবে। সেইসাথে এজেন্সি ট্রিপল এ এর বাকি সদস্যদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি দ্রুত হোস্টেলের রুমে চলে গেলাম। আর গিয়েই দেখলাম ঘরে আমার বন্ধুরা ব্যাগ গুছাচ্ছে।
সঙ্গে ঘরে একজন নতুন সদস্য। ছেলেটা হালকা বেঁটে। আর মাথায় অগোছালো নোংরা চুল। ফকির মিসকিন নাকি বুঝা যাচ্ছেনা। পড়নেও নোংরা পোশাক। আমাকে দেখা মাত্রই আব্রাহাম বলে উঠলো…
– দোস্ত এসে গেছিস তুই! পরিচয় হয়ে নে, ও হলো আমার রুমমেট সাদেক। আমরা তার গ্রামে যাচ্ছি আজ রাতের মধ্যেই ..
সাদেক ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো। আমি একটু অবাক হলাম আদিল আব্রাহামের ব্যাগ গুছানোর তাড়াহুড়ো দেখে। জিজ্ঞেস করলাম ..
– তোরা রাতের বেলা এত তাড়াহুড়ো করে তার গ্রামে কেন যাচ্ছিস বুঝলাম না!
রেগে উঠলো আদিল ..
– বুঝেনা! কচি খোকা! দিছোস তো লাইফের বারোটা বাজায়া। চোখ কান খোলা আছে তোর? যেই বেডার ভি চুরি করছে হালায় সেই বেডারই মাইয়ারে প্রপোজ কইরা দিছে। এবার বুঝো ঠেলা! তোরে যে এখনো ক্রসফায়ার করেনাই কপাল ভালা। ওরে ডরে আমার ঠ্যাং কাঁপতাছে। কোনদিক থাইকা কে আইসা আবার পাকড়াও করে!
সাদেক ছেলেটা আদিলকে অভয় দিতে লাগলো ..
– ভয় নেই বন্ধু, তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো। আমার সিক্রেট ভিলেজে তোমরা নিরাপদ থাকবে। আমার মা তোমাদের রক্ষা করবেন।
কিঞ্চিৎ অবাক হলো আব্রাহাম
– মা! ওই বেটা তোর আবার মা এলো কোথা থেকে! তুই না চাচা চাচীর কাছে বড়ো হইছোস বলছিলি!
– আরে বাবা আমার দেবী মায়ের কথা বলেছি! আমি যার পূজো করি।
এবার আমিও অবাক হলাম। আমি বললাম ..
– তোমার নাম শুনে তো মুসলিম ভেবেছিলাম!
– আরে আমিতো মুসলিম জন্মগত। কিন্ত আমি নাস্তিক ছিলাম। আর এখন দেবী মায়ের পূজো করি। আমাদের সিক্রেট ভিলেজে সেই এখন রক্ষাকর্তা।
আমার ভীষণ বিরক্ত লাগলো ছেলেটার কথায়। আস্ত পাগল মনে হচ্ছে। একবার বলছে সে মুসলিম আবার একবার নাস্তিক। আবার এখন নাকি পূজো করে! আজব! বিরক্ত হয়েই আব্রাহামের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম ..
– আরে বাবা রাতের বেলা এভাবে তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিস কেন!
উত্তর দিলো আদিল ..
– শুধু আমরা না তুইও যাচ্ছিস।
– কিন্ত কেন!
আমার দিকে এগিয়ে এলো আব্রাহাম। তার মোবাইল স্ক্রিনটা আমার সামনে ধরলো। আমি দেখলাম তাতে পরিষ্কার লিখা “এজেন্সি ট্রিপল এ আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে। তাদের ধরিয়ে দিন। যে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে পাঁচ কোটি টাকা পুরষ্কার দেয়া হবে।” লিখাটার সঙ্গে আমার আর আলিশার আজ সকালের ক্যান্টিনের ঘটনার একটা ছবি জুড়ে দেয়া।
আব্রাহাম ফোন পকেটে রেখে বলতে লাগলো ..
– এই ছিলো রাত দশটার ব্রেকিং নিউজ। এবার বুঝেছিস তো কেন আত্মগোপনে যেতে হবে। নে, রেডি হয়ে নে। অনেক পথ হাঁটতে হবে। রাতে গাড়িঘোড়া পাবো কিনা জানিনা।
– হুম বুঝলাম, কিন্ত পাঁচ কোটি টাকা মাত্র! এজেন্সি “ট্রিপল এ” এর দাম মাত্র পাঁচ কোটি! খুবই কম মনে হচ্ছে, অপমানিত বোধ করছি।
প্যানপ্যানানি শুরু হলো আদিলের
– ওই বেডা নাটক কম কর। হেতে এজেন্সি ট্রিপল এ এর দাম কয়নাই। হেতের হারানো মেয়ের লাইফের দাম কইছে। আজ দুপুরের পর থাইকা আসলেই ওই ডাইনি মাইয়াডারে খুঁইজা পাওয়া যাইতেছে না। আর তাই হেতে আমগোরেই সন্দেহ করতাছে।
বেশ অবাক হলাম আদিলের কথা শুনে। আসলেই আলিশাকে খুজেঁ পাওয়া যাচ্ছেনা! সঙ্গে সঙ্গে আব্রাহাম কাছে এসে বললো ..
– আমার মনে হয় সে একটা গেম খেলতে চাইছে। সে নিশ্চয়ই নিজে থেকেই তার মেয়েকে কিডন্যাপ করিয়েছে আমাদের উপর দোষ চাপানোর জন্য। সকালের ক্যান্টিনের ঘটনায় সে বড়ো সুযোগ পেয়েছে আর সেটাকেই কাজে লাগাচ্ছে। তোর কি মনে হয়না আমাদের মতো তিনটে ছেলেকে ধরা তার বাম হাতের কাজ মাত্র। সে পলিটিশার, নাভারার মেয়র। ডেল্টোরার যেকোনো প্রয়োজনে সে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আমাদের পাকড়াও করতে পারে। সে চাইলেই হোস্টেলে পুলিশ পাঠিয়ে আমাদের ধরতে পারতো। কিন্ত সে এমনটা করছে ভি ফেরত পাওয়ার জন্য। আর তাই সে গেম খেলছে যাতে আমরা বাধ্য হই তার সাথে নেগোশিয়েট করতে। ভি এর ব্যপারটা সে গোপন রাখতে চাইছে এটা এখন পরিষ্কার। সে চাইছে রাজ্যবাসীর কাছে এজেন্সি “ট্রিপল এ” ভিলেনে পরিণত হোক। হয়তো ভি ফেরত দিলে সে আমাদের আবারও হিরো বানিয়ে দেবে। এরা পলিটিশার ভাই, সবই পারে। তুই কি ভি ফেরত দিবি?
– একদমই না ..
– হুম জানতাম। তো দেরি না করে চল ভাই। আপাতত আত্মগোপন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নাই।
সবাই হোস্টেল থেকে বের হতে লাগলাম। কিন্ত একটা বিষয় এখনো মাথায় ঢুকছে না। ভিক্টর ভি ফেরত পাবার আশায় যদি আমার সাথে এমন গেম খেলবে তাহলে একটু আগে কেন সে আমার মুখোমুখি হয়েছিলো তার মেয়েকে ফেরত পাবার আশায়। এর মানে হলো আলিশা সত্যিই হারিয়ে গেছে। কিন্ত লোকটা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুরো রাজ্যের কাছে আমাকে ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে। আররে! আমার এজেন্সি “ট্রিপল এ” এর পুরো ভবিষ্যৎ খেয়ে দিয়েছে! এখন আমি রাজ্যবাসীর সামনে এই মুখ দেখাবো কিভাবে! আচ্ছা তাহলে কিছুদিনের জন্য আত্মগোপণেই যাই। তার মেয়েকে খুজেঁ পেলে হয়তো এজেন্সি “ট্রিপল এ” এর সম্মান কিছুটা হলেও রক্ষা হবে। সবকিছু যেনো তড়িৎ গতিতে ঘটে যাচ্ছে। কি যে শুরু হলো আমার সাথে!
সাদেকের সিক্রেট ভিলেজের দিকে রওনা করলাম আমরা। রাতের অন্ধকারে প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর আমরা গ্রামের পথ পেয়ে গেলাম। আর দেখলাম আমাদের জন্য সাদেক আগে থেকেই একটা ঘোড়াগাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। ঘোড়াগাড়ির দেখেই আদিল আব্রাহামের খুশিতে গদগদ অবস্থা। তারা জীবনে এই প্রথম ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে এই খুশি দেখে কে! অবশ্য আমারও প্রথমবার ঘোড়াগাড়িতে যাত্রা। সবাই ঘোড়া গাড়িতে উঠে বসলাম। চালক ঘোড়ার পিছনে লাথি মেরে যাত্রা শুরু করলো। সাদেক জানালো তার গ্রাম ডেল্টোরা থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ী জঙ্গলের মাঝে। যেতে অনেক সময় লাগবে। এদিকে আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে! শরীর অনেক ক্লান্ত। ঘোড়ার গাড়ি এমন ভাবে দুলতে দুলতে যাচ্ছে ঘুমও হবেনা। বিরক্ত লাগছে আমার।
কতক্ষণ ঘোড়ার গাড়ি চললো হিসেব নেই আমার। পাহাড়ী রাস্তার ধারে গিয়ে ঘোড়া গাড়ি থেকে নামতে হলো আমাদের। সাদেক জানালো বাকিটা পথ পাহাড়ী রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে হবে। আমরা হাঁটতে লাগলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা অনবরত হেঁটেই চলেছি। পাহাড়ী ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে যতই এগোচ্ছি ততই যেনো গা ছমছমে পরিবেশ তৈরী হচ্ছে। আমরা শহর থেকে এত দূরে চলে এসেছি যে এখানে আব্রাহামের ফোনে কোনো নেটওয়ার্ক পাচ্ছেনা। কোনো গাড়ি ঘোড়া নেই, নেই কোনো জনমানব। কি এক নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ চারদিকে। আকাশ মেঘলা, চাঁদটাও যেনো দুর্বল হয়ে গেছে। এভাবে চলতে চলতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু হলো। আর সাদেক জানালো আমরা তার গ্রামের একদম কাছে চলে এসেছি। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নামতে শুরু করেছি আমরা।
খানিক হাঁটার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম ঝোপঝাড় পার হয়ে একটা খোলা ময়দানের মতো জায়গা। তার চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়ী জঙ্গলে ঘেরা। ময়দানের কোণায় একটা গেট, যেটা বাঁশের কঞ্চি আর পাহাড়ী বুনো ফুল দিয়ে সাজানো। তার ওপাশে কতগুলো নারী ও ছেলে বুড়ো দাড়িয়ে আছে। যেনো তারা এতক্ষণ আমাদেরই অপেক্ষায় ছিলো। তাদের হাতে ফুলের ঝুড়ি। কারো হাতে গ্লাস ভর্তি শরবত। বেশ অবাক হলাম। তারা কি আগে থেকেই জানতো আমরা আসতাম! সাদেক তো কলেজে ছিলোনা! তবে তার গ্রামে অতিথি আসছে এই ব্যপারটা গ্রামের লোকজন কিভাবে জানলো। হয়তো খবর পাঠিয়েছিলো কোনোভাবে। ফোনেও জানাতে পারে! কিন্ত এখানে তো নেটওয়ার্ক নেই! বিষয়টা নিয়ে ভাব্বার সময় পেলাম না।
আমাদের দেখামাত্র লোকগুলো যেনো উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলো। আমরা প্রবেশদ্বার পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে ফুলের বৃষ্টি শুরু হলো। তারা আমাদের মাথায় ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছে। দুজন অল্পবয়সী মেয়ে চলে এলো শরবত হাতে নিয়ে। শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিলো আমাদের দিকে। বিষয়টা ভালো লাগলো, খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। শরবতের গ্লাস পেয়ে সবাই ঢকঢক করে গিলতে শুরু করলাম।
ভোরের আলো ফুটে গেছে। ময়দানের এক কোণায় কয়েকটা দোতলা কাঠের ঘর চোখে পড়লো। সাদেক মুচকি হেসে আব্রাহামের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো ..
– আমরা অতিথিদের এভাবেই বরণ করি। রাতেই আমাদের আসার ব্যপারে খবর পাঠিয়েছিলাম। তাই তারা আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছে।
আব্রাহাম অট্টহাসিতে মেতে উঠলো ..
– তুই যে গেঁয়ো ভূত এটা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু এত অজপাড়া গাঁয়ে থাকিস এটা কল্পনা করিনি। একেবারে রূপকথার দেশে এসে গেছি বলে মনে হচ্ছে। ছবির মতো সুন্দর। বাপের জন্মে এমন সুন্দর জায়গা দেখিনি।
সাদেক হেসে উত্তর দিলো
– এমন সৌভাগ্য সবার হয়না দোস্ত। আমাদের এই সিক্রেট ভিলেজের সন্ধান ভ্যালমোরার কোনো ট্যুরিস্টের কাছে নেই। এখনো তো অতিথি আপায়ন করলামই না। চল দ্রুত। আগে বিশ্রাম করবি। আজ আবার একটা রিচুয়াল আছে আমাদের। বিকেল বেলা। দেখবি অনেক মজা পাবি।
আমি খেয়াল করলাম আদিল এখন পর্যন্ত চুপচাপ আছে। আমার কেমন যেনো এই জায়গাটা অন্যরকম লাগছে। মানুষগুলোর চাহনি অন্যরকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা আমাদের ব্যপারে অনেক কৌতুহলি কিন্ত তারা আমাদের ব্যপারে জানার ইচ্ছাটা চেপে রাখছে। কেউ আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলছে না। যেনো অতিথিদের সাথে দায় সাড়া কিছু রীতিনীতি পালনে ব্যস্ত। আর জায়গাটাও কেমন গা ছমছমে। না জানি রাতের বেলা আরো কতটা ভয়ংকর লাগে দেখতে। যদিও জায়গাটা দেখতে কোনো দক্ষ শিল্পীর রং তুলিতে আঁকা ছবির মতোই সুন্দর।
আমরা একটা দোতলা বাড়ির উপরের ঘরে চলে গেলাম। সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আব্রাহাম সাদেককে প্রশ্ন করলো …
– তোর চাচা চাচীকে কোথাও দেখছি না।
– আরে আজ তো চাচা চাচীর বিশেষ দিন। তারা নদীর পাড়ে আছে। একান্তে সময় কাটাচ্ছে। রিচুয়ালের সময় দেখতে পাবি। তোরা বিশ্রাম কর। আমার কিছু কাজ আছে। রিচুয়ালের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তোদের সাথে পরে দেখা হচ্ছে। বিশ্রামের পর আমি তোদের গ্রামের চারপাশটা ঘুরে দেখাবো কেমন ..
কথাগুলো বলে সাদেক চলে গেলো। আমরা ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ঘরের দেয়ালগুলোতে অদ্ভুত সব ছবি অঙ্কন করা। যার কোনো মাথামুন্ডু বুঝতে পারছি না আমি। আদিল চারপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে নিয়ে আব্রাহামের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো ..
– দোস্ত, তুই সাদেকরে কতদিন ধরে চিনিস?
– চিনি তো অনেক আগে থেকেই। কিন্ত খুব বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। ও যে এমন জায়গায় বসবাস করে এটা তো কল্পনাও করিনি আমি।
– দোস্ত এই জায়গায় কি বসবাস করা যায়! আমার তো এইখানে আসার পর থাইকাই ভিতরে ভিতরে ফাটতাছে। কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগতাছে। ওরে আব্রাহাম, দেয়ালের ওই ছবিগুলা দেখ! ডরে আমার ঠ্যাং কাঁপতাছে। রাইতের বেলা আমি ক্যামনে ঘুমামু!
আমরা আদিলের ইশারা করা দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখলাম একটা অদ্ভুত ছবি আঁকা। কোন এক ডাইনি একটা ছেলের পেটে নখ দিয়ে ছিঁড়ে নাড়িভুড়ি বের করেছে। মুখে লেগে আছে রক্ত। যদিও ছবি অস্পষ্ট। কিন্ত দেখে এমনটাই লাগছে। খুবই বিদ্ঘুটে, খুবই অস্বস্তিকর।
আব্রাহামের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ খেয়াল করলাম। সে কিছু একটা ভেবে বললো ..
– আরে বাবা এরা হয়তো ওদের দেবীর ছবি এভাবে এঁকেছে। সাদেক বললো না ওরা নাকি কোন দেবীর পূজা করে। এসব এতো সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন! আত্মগোপনের জন্য এত সুন্দর জায়গা পেয়েছি এটাই অনেক। তোরা খামোখা ভয় পাচ্ছিস।
কিন্ত আদিল যেনো কিছুতেই শান্ত হলোনা ..
– ভাই একবার চিন্তা কর, এমন অদ্ভুত ছবি অঙ্কন করার রুচি হইলো কোন আর্টিস্টের!
আদিলের কথা শেষ না হতেই ঘরে প্রবেশ করলো একটা বাচ্চা মেয়ে। তার হাতের ঝুড়িতে ফল ভর্তি। ঝুড়িটা রুমের এক কোণায় একটা টুলের উপর রেখে সে দ্রুত চলে গেলো। আব্রাহাম আদিলের কথায় আর পাত্তা দিলোনা। ফলের ঝুড়ি দেখেই বলে উঠলো ..
– রাখ তোর রুচি! ওই দেখে ফলের ঝুড়ি। মনে হচ্ছে এরা ফলমূল ছাড়া কিছু খায়না। চল দোস্ত ফল দিয়েই ব্রেকফাস্ট করা যাক। আরে কত সুন্দর তরতাজা পাহাড়ী ফলমূল , আমার তো দেখেই জিভে পানি এসে যাচ্ছে।
আব্রাহাম যদিও বিষয়টা পাত্তা দিচ্ছেনা কিন্ত আদিলের মতো আমিও চিন্তিত। জায়গাটা আসলেই গা ছমছমে আর ভুতুড়ে। মনে হচ্ছে কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। আর গ্রামে অল্প কিছু মানুষ যারা খুবই অদ্ভুত। শহরের এত আধুনিক জীবন ব্যবস্থা ছেড়ে এরা এই অজপাড়া গায়ে কেন এমন চ্যালেঞ্জিং জীবনযাপন করছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না!
আব্রাহাম ফলের ঝুড়ি থেকে ফল নিয়ে গপাগপ গিলতে শুরু করেছে। এদিকে আদিলের ভয় যেনো কাটছে না। সে এবার আমার সাথে প্যান্যপ্যানানি শুরু করলো ..
– ওই আকি, তুই ক। এই আজগুবি ছবি ঘরের মধ্যে থাকলে ঘুম হইবো?
বিরক্ত হয়ে জবাব দিলাম আমি
– হ্যাঁ হবে।
– হইবো মানে! ক্যামনে?
– এমনে
আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি তাই শরীর ভীষণ ক্লান্ত। একটু ঘুমিয়ে নেয়া জরুরী হয়ে গেছে আমার। আদিলও আব্রাহামের সাথে ফল খাওয়া শুরু করলো। আমি গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়ে গেলাম।
.
আমার ঘুম ভাংলো প্রায় তিন চার ঘন্টা পর জোড়ালো একটা কণ্ঠস্বর শুনে।
–তুমি ভেবেছো এই সব দানবের হাত থেকে এত সহজেই রক্ষা পাবে! চুক্তি তোমাকে করতেই হবে আকিরা! আমি ছাড়া তুমি অনেক দুর্বল। ওই আগন্তুক তোমাকে সবসময় রক্ষা করতে পারবে না।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলাম আমি। ঘরে আদিল আব্রাহাম কাউকে দেখতে পেলাম না। প্রচন্ড বিরক্ত হলাম ..
– তো তুমি এজন্যই শান্তিতে ঘুমাতে দিবেনা? এমনিতেও তোমার চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অতি উৎসাহ খুবই সন্দেহজনক মনে হয়। আমার আরো ভাবতে হবে ব্যপারটা নিয়ে।
– ভাবো ভাবো ভাবতে থাকো আকিরা। শীঘ্রই তুমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে যখন আমি ছাড়া তোমার কাছে বাঁচার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট রইবে না।
– আচ্ছা তখন ভেবে দেখবো চুক্তি করার ব্যপারটা।
আমার কথাটা শেষ হতেই ঘরে এলো আদিল। সে এসেই আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ..
– উইঠা গেছোস, আমিতো ভাবলাম তোর গায়ে পানি ঢাইলা উঠানো লাগবে। চল, সাদেক আমগো গ্রাম ঘুইরা দেখাইতে নিয়া যাইবে। চারদিকে তো পাহাড় আর জঙ্গল ছাড়া কিছু দেহিনা। হেতে আমগো কি দেখাইবো!
আমি আদিলের সাথে নিচে নামলাম। আব্রাহাম আর সাদেক নিচেই দাড়িয়ে ছিলো আমাদের অপেক্ষায়। সাদেক আমাদের জায়গাটা ঘুরে দেখাতে লাগলো। তাদের ফসলি জমি আর গরু ছাগলের খামার। কিভাবে তারা গ্রামীণ জীবন ও জীবিকা চালায় তার একটা পরিষ্কার ধারণা দিলো। জঙ্গলের ভিতরে পাহাড়ী ঢালের নদী। সেখানকার তাজা মাছ। জিনিসগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা। আর নদীর তীর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম নদীর তীরে একটা তাবু। জিজ্ঞেস করলো আব্রাহাম ..
– আরে দোস্ত তাবুতে কি! এইখানে কি মাছ ধরতে আইসা রাতে থাকা যায় নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো সাদেক। তার চোখেমুখে একটা চিন্তার ছাপ। ঘুরে দাড়িয়ে বললো ..
– ওদিকে যাওয়া যাবেনা। ওখানে চাচা চাচী আছে। আজকের রিচুয়ালের প্রধান আকর্ষণ তারা। সাত দিন আগে থেকেই তারা ওখানে থাকছে। কোনো মানুষের সাথে কথা বলা নিষেধ রিচুয়াল সম্পন্ন না হওয়া অবধি।
বলে উঠলো আদিল ..
– ও বুইজা গেছি, মৌনব্রত টাইপ কাহিনী। আমার তো রিচুয়াল দেহনের লাইগা আগ্রহ বাইরা গেলো। কি হয় আসলে তোমাগো রিচুয়ালে?
সাদেক হেসে উত্তর দিলো
– সেটাতো বিকেলেই নিজ চোখে দেখতে পাবে সবাই। তার আগে চলো দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেড়ে নেই। আজ দুপুরে বুনো হাঁসের মাংস আর ডাল রান্না হয়েছে। সেই ভোজ হবে।
আব্রাহামের খুশি দেখে কে
– দোস্ত, কি শুনাইলি আমারে! জিভে পানি এসে যাচ্ছে।
আমি পিছন ঘুরে তাবুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। খেয়াল করলাম একজন মহিলা আর একজন পুরুষ নীরবে নদীর ওপারে তাকিয়ে আছে। তারা তাবুর বাইরে দাড়িয়ে আছে। তাদের খুবই বিষন্ন মনে হচ্ছে। অবশ্য দূর থেকে তাদের মুখাবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা। হঠাৎই আমার কাঁধে কেউ একজন হাত রাখতেই চমকে উঠলাম। দেখলাম সাদেক পাশে দাড়িয়ে। আদিল আব্রাহাম দূরে ময়দানের দিকে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো সাদেক ..
– কি হলো! খাবেনা?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সে বলতে লাগলো ..
– তোমার এই জায়গাটা পছন্দ হয়নি তাইনা?
হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলো সাদেক। উত্তরও সে নিজেই দিলো ..
– তোমার পছন্দ হয়নি কারণ তুমি জায়গাটার ব্যপারে জানোনা।
আমি বললাম
– জায়গাটা অন্য আট দশটা সাধারণ গ্রামের মতোই। বিশেষ কিছু দেখলাম না এখনো।
হেসে উঠলো সাদেক
– বাইরে থেকে দেখে বুঝা যায়না। তাছাড়া জায়গাটা তো বিশেষ কিছু না। বিশেষ তো আমাদের গ্রামের প্রতিটা মানুষ।
– বিশেষ! কিভাবে! তোমরাও ভ্যালমোরার অন্য মানুষদের মতোই!
আবারও হেসে উঠলো সাদেক
– হাহাহা, এই গ্রামের সবাই বিশেষ। কারণ এই গ্রামের সবাই অমর। আমরা এমন দেবীর পূজো করি যে আমাদের অমরত্ব দিয়েছে। বলো, ভ্যালমোরার কোথাও তুমি অমরত্ব পাবে?
থেমে গেলাম আমি। সাদেকের কথা শুনে রীতিমতো চমকে উঠলাম। কি বললো ছেলেটা! সবাই অমর! আমাকে আশ্চর্য হতে দেখে সাদেক আবারও বললো ..
– কি হলো, এমন আশ্চর্য হলে যে?
– তুমি মজা করছো তাইনা!
আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম আমি। আমার প্রশ্নে সাদেক হোহো করে হাসতে হাসতে আমাকে ময়দানের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ব্যপারটা যেনো তার কাছে খুবই মজার। আমাকে আশ্চর্য হতে দেখে সে আরো মজা নিচ্ছে।
খেয়াল করলাম ময়দানের মাঝখানে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। টেবিল আর মোড়া পেতে দেয়া হয়েছে আমাদের জন্য। খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে কলাপাতায়। কয়েকজন মহিলা আর একটা অল্পবয়সী মেয়ে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন আমাদের। আমাদের পাশাপাশি গ্রামের বাকি সবাই খেতে বসেছে। আমি গণনা করার চেষ্টা করলাম এখানে কতজন মানুষ আছে। আমরা সহ ত্রিশ জনও হবেনা মনে হচ্ছে। তার মানে এখানে মাত্র কয়েকটা পরিবারই বসবাস করে। খাবার খেতে খেতে পাতে একটা কাগজের টুকরো পেয়ে গেলাম। আরে! খাবারের মাঝে শুকনো কাগজ কিভাবে এলো! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আদিল আব্রাহাম সহ গ্রামের সবাই খাবার খেতে ব্যস্ত। আমি কাগজটা হাতে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম খাবার পরিবেশন করতে থাকা অল্পবয়সী মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাগজটা কি সে দিলো!
আমি খাওয়া বাদ দিয়ে কাগজটার দিকে মনোযোগ দিলাম। সেটা ভাজ করা বলে মনে হলো। ভাজ খুলতেই দেখলাম তাতে কিছু লিখা। “সময় থাকতে পালিয়ে যান”।
লিখাটা পড়া মাত্রই খাবার গলায় আটকালো আমার। হেঁচকি উঠে গেলো। কাগজটা পকেটে পুরে রাখলাম। অল্প বয়সী মেয়েটা আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। আমি পানি খেয়ে আবারও মেয়েটার দিকে তাকালাম। কি মায়াবী চেহারা মেয়েটার। চোখগুলো যেনো নিষ্প্রাণ। মুখে কোনো হাসি নেই। কিন্ত সে আমাকে পালিয়ে যেতে কেন বলছে! আর সবার অগোচরেই বা কেন বলছে! তবে কি সে অন্যদের থেকে আলাদা!
খাবার খাওয়া শেষ করতেই দেখলাম গ্রামের কয়েকজন ঢোল আর বাঁশি বাজানো শুরু করেছে। সবাই ময়দানের অন্য পাশের দিকে লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। সবার আগে সেই ঢোল বাদক আর বাঁশিওয়ালা হাঁটছে। বাকি সবাই তাদের অনুসরণ করতে লাগলো। সাদেক আমাদের বললো ..
– চলো সবাই, রিচুয়াল শুরু হয়ে গেছে।
কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। অগত্যা আদিল আব্রহামসহ আমি হাঁটতে লাগলাম। লোকগুলো ময়দানের এক কোণায় গিয়ে দাড়িয়ে গেলো। ঢোল আর বাঁশি অনবরত বেজেই যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে আমার অতিরিক্ত শব্দের কারণে। কি যে করুন সেই বাঁশির সুর। এই সুর যেনো হৃদয়ে আর্তনাদ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। খেয়াল করলাম ময়দানের কোণায় একটা উচুঁ টিলার মতো জায়গা। যেখানটায় সিঁড়ি বেয়ে উঠা যায়। আর টিলার নিচে বড়ো বড়ো পাথর বিছিয়ে দেয়া। জায়গাটা কেমন যেনো অন্যরকম লাগলো। টিলার উচ্চতা একটা চারতলা বিল্ডিংয়ের সমান তো হবেই। তবে মনে হচ্ছে এই টিলা মানুষের তৈরী। পাথর আর মাটি একত্র করে এরা নিজেরাই এটা বানিয়েছে হয়তো। হঠাৎই খেয়াল করলাম টিলার উপর সিঁড়ি বেয়ে উঠছে সাদেকের চাচা চাচী। বলে উঠলো আদিল ..
– আরে, ওরা তোমার চাচা চাচী না?
হ্যাঁ সম্মতি জানালাে সাদেক। আর মুখে আঙ্গুল দিয়ে আদিলের উদ্দেশ্যে বললো ..
– রিচুয়ালের সময় কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ। শুধু যা ঘটছে দেখতে থাকো।
আমরা কৌতুহল আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম টিলার দিকে। সাদেকের চাচা চাচী টিলার উপর উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা নিচের দিকে মানে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত তারা কোনো বক্তৃতা প্রদান করবে বলেই মনে হচ্ছে।
কিন্ত তারা সেটা না করে হঠাৎই তারা টিলার নিচে সাজানো পাথরগুলোর দিকে তাকালো। সেইসঙ্গে থেমে গেলো ঢোল আর বাঁশির শব্দ। আমি ব্যপারটা আঁচ করতে পেরেছি। এমনকি আব্রাহামও বুঝে ফেলেছে। সে সাদেকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো ..
– দোস্ত, চাচা চাচী কি করতে চাচ্ছে! তারা এভাবে নিচে তাকাচ্ছে কেন! তারা কি পাথরের উপরে ঝাপ দেবে নাকি!
বলে উঠলো সাদেক
– এটাই তো অমরত্ব লাভের প্রথম ধাপ। আগে পুরনো দেহ ত্যাগ করতে হবে।
সাদেকের কথা শেষ হতে না হতেই তার চাচা চাচী পাথরের উপর একসাথে ঝাপ দিলো। পাথরের উপর পতিত হবার সাথে সাথে তাদের দুজনেরই মাথা ফেটে চৌচির। মাথার ঘিলু ছিটকে ছড়িয়ে গেলো চারদিকে। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যেতে লাগলো পাথর। সেইসাথে থরথর করে কাঁপছে তাদের অর্ধমৃত শরীর। কিন্ত সবাই দাড়িয়ে তামাশা দেখছে। যেনো সবাই তাদের মরে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে।
এ দৃশ্য হজম করার মতো নয়। আব্রাহাম বমি করতে শুরু করে দিলো। আমি খেয়াল করলাম আদিলের পা ঠকঠক করে কাঁপছে। আমি পাথরের মতো জমে গেলাম। যা দেখলাম তা এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। আমার কাঁধে হাত রাখলো সাদেক। আর বললো ..
– অমর হতে গেলে এটুকুই সেক্রিফাইস যথেষ্ট
আমি তাকালার সাদেকের দিকে। ওর চেহারা যেনো ভয়ংকর লাগছে। মুখে একটা বিদ্ঘুটে হাসি। যেনো অমরত্বের নেশায় উন্মাদ হয়ে আছে। ফিসফিস করে বলে উঠলো সে ..
– রিচুয়াল এখনো শেষ হয়নি। রাতে দেবী মায়ের মন্দিরে পূজো হবে। তোমরা সকলে আমন্ত্রিত।
সাদেকের কথাবার্তা খুবই অস্বাভাবিক। ক্রমশই শরীরের লোমগুলো শিউরে উঠতে লাগলো আমার ….
—---------- চলবে—-----
অমর হতে চান?
অনুভূতি প্রকাশ করুন কমেন্টে …