30/03/2025
সে কতই না সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যে রমাদানকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে। নতুন অঙ্গীকার, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, পরিশুদ্ধ মন ও সতেজ সংকল্প নিয়ে সে রমাদানের পরবর্তী দিনগুলো শুরু করতে যাচ্ছে। অন্য জাতিগুলো নতুন বছর এলে, প্রতিবার বছরের শুরুর দিনে অর্থহীন সব অঙ্গীকার করে—যেগুলো তাদের কখনও পূরণ করা হয়ে উঠে না। কিন্তু রমাদানে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক এই শুদ্ধতার ধারাবাহিকতা—গুনাহ থেকে নিজেদের বিরত রাখার দৃঢ় সংকল্প। যদি না-ও পারি, অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসার সুযোগ আছে—মহান রবের তাওবার দরজা আমাদের জন্য সবসময় খোলা।
রমাদানে আমরা অর্জন করেছি তাকওয়া। তাকওয়া হলো মনের এক ধরনের সচেতন অবস্থা-যে সচেতনতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আল্লাহ আমাদের সবসময় দেখছেন। এই তাকওয়া যেন বছরের বাকি সময়জুড়েও আমাদের মধ্যে থাকে।
রমাদান চলে যাচ্ছে, কিন্তু আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্য, কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর কাছে দুআ, অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহর কাছে চাওয়া-এই অভ্যাসগুলো যেন আমাদের ছেড়ে চলে না যায়। এই রমাদানে আপনি আপনার অভ্যাস বদলেছেন, গুনাহ ছেড়ে দিয়েছেন, অতীত জীবনের গুনাহগুলোর জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন, আল্লাহ আপনাকে গুনাহের গভীর অন্ধকার থেকে উদ্ধার করেছেন। ইনশাআল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনি আজ একজন পরিচ্ছন্ন এবং পরিশুদ্ধ মানুষ। এতটাই পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ, যেন মাত্র আপনার জন্ম হয়েছে। কাজেই গুনাহের সেই আস্তাকুঁড়ে নিজেকে আর কখনোই ছুঁড়ে ফেলবেন না।
রমাদানের পর কী হবে? রমাদানের সময়টায় শ`য়তানকে আটকে রাখা হয়েছিল। সে নিদারুণ মনঃকষ্ট নিয়ে দেখছিল আমরা সালাত আদায় করছি, ইবাদাত করছি। সে দেখেছে আমরা ঈমানের পরিষ্কার চাদর দিয়ে নিজেদের ঢেকেছি। তাই সে চাইবে রমাদান শেষ হলে গুনাহের নর্দমায় যেন আমাদের আবার টেনে হিঁচড়ে নামাতে পারে। রমাদানের দিনগুলোতে সে তিক্ততা আর যন্ত্রণা নিয়ে আমাদের ভালো আমল আর তাওবার দিকে কেবল তাকিয়ে ছিল, কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।
রমাদান শেষ হয়ে গেলে সতর্ক থাকবেন, আল্লাহর সাথে যে অঙ্গীকার আপনি করেছেন, শ`য়তান যেন সেই অঙ্গীকার ভেঙে আপনাকে প্ররোচিত করতে না পারে। আল্লাহর সাথে আপনার শপথ এবং প্রতিশ্রুতিকে নষ্ট করবেন না। রমাদান মাসে যে ভালো আমলগুলো আপনি করেছেন, সেগুলো যেন একটি অনিন্দ্য সুন্দর প্রাসাদের মতো। ইটের পর ইঁট সাজিয়ে, স্তরে স্তরে আপনি এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। রামাদানের প্রতিটি সেকেন্ডকে কাজে লাগিয়ে এই প্রাসাদ নির্মাণে আপনি ত্যাগ আর কষ্ট স্বীকার করেছেন—ক্ষুধার কষ্ট, তৃষ্ণার কষ্ট, নির্ঘুম রাত এবং নিজের প্রবৃত্তি আর নফসের বিরুদ্ধে ল*ড়াই করার কষ্ট। শুধু রমাদানে আপনি যে ভালো কাজগুলো করেছেন, সেটার দাম একজন কোটিপতির সম্পদের চাইতেও বেশি!
এবার একটি ঘটনা কল্পনা করুন। ধরুন, আপনি একটা বিশেষ প্রজেক্টে বেশ কিছু সপ্তাহ বা মাস জুড়ে অনেক খাটুনি করলেন। আপনি আপনার সমস্ত কাজ একটি পাওয়ারপয়েন্ট ফাইলে সেইভ করে রাখলেন। কিন্তু আপনার প্রফেসরকে দেখানোর ঠিক আগ মুহূর্তে আপনি হঠাৎ করে পুরো হার্ড ড্রাইভ ফরম্যাট করে দিলেন। মানুষ বলবে আপনি স্রেফ একটা পাগল! কারো যদি কোটি টাকা থাকে যা সে জীবনভর কষ্ট করে কামিয়েছে, সেটা যদি সে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে তাহলে কি আমরা তাকে পাগল বলব না? সারা রমাদান ইবাদাত করে রমাদান শেষে যারা আবার গুনাহের পথে ফিরে গেল-তাদের উদাহরণও এমনই।
“আর তোমরা সে নারীর মতো হয়ো না, যে তার পাকানো সুতো শক্ত করে পাকানোর পর টুকরো টুকরো করে ফেলে। তোমরা তোমাদের উপর অঙ্গীকারকে নিজেদের মধ্যে প্রতারণা হিসেবে গ্রহণ করছো (এই উদ্দেশ্যে) যে, একদল অপর দলের চেয়ে বড় হবে।”
[সূরা আন-নাহল; আয়াত : ৯২]
জুরায়েজ, আস সুদ্দি এবং ইবনু কাসিরের মতে, এখানে মক্কার এক পাগল মহিলার কথা বলা হচ্ছে। মুজাহিদ, কাতাদা এবং ইবনে যায়েদ বলেন, এটা একটি উদাহরণ যা ঐ সমস্ত লোকদের ক্ষেত্রে পেশ করা হয়, যারা কোন পাকাপাকি শপথ করার পর তা ভঙ্গ করত। ঘটনাটা হলো— মক্কার সেই মহিলা অনেক সুন্দর সুন্দর কম্বল, কাপড়, টুপি তৈরি করত, কিন্তু বানানো শেষ করে সে দুই দিক থেকে সুতা ধরে টান দিয়ে সুন্দর জিনিসটা নষ্ট করে ফেলত। সবাই বলত সে একটা পাগল। এটি হচ্ছে সেই লোকটির মতো, যার প্রজেক্টের উপর তার পুরো ক্যারিয়ার নির্ভর করে আছে, কিন্তু এটা জমা দেওয়ার আগেই সে তার হার্ড ড্রাইভ ফরম্যাট করে দিল। আর যে লোকটা রমাদানের পর আগের জীবনে ফিরে গিয়ে তার সমস্ত ভালো আমল নষ্ট করে ফেলল, সে এদের চাইতেও বড় পাগল।
কাজেই সেই মহিলার মতো হবেন না, যে নিজের বোনা সুতা খুলে ফেলে সুন্দর জিনিসটিকে নষ্ট করে ফেলে। সেই লোকটার মতো হবেন না, যে বছরের পর বছর পরিশ্রম করে অনেক উঁচু একটা দালান নির্মাণ করল আর কাজটা শেষ হওয়ার পর যখন তার সেই দালানে প্রবেশ করার সময় এলো, তখন সে একটি ডিনামাইট দিয়ে দালানটিকে ধ্বংস করে ফেলল। আপনি রমাদানের সিজনাল মুসলিম হবেন না। আপনি হবেন একজন ঈমানদার মুসলিম, ইহসানি মুসলিম, রাব্বানি মুসলিম। রমাদান শেষ হয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে দিনগুলো। কিন্তু যিনি এই রমাদানের মালিক, যিনি দিন-রাত সৃষ্টি করেছেন, তাঁর কোনো শেষ নেই- তিনি চিরঞ্জীব!
বই: ধূলিমলিন উপহার রামাদান
পৃষ্ঠা: ২০৬-২০৮
Islamic lecture