
05/05/2025
বাংলার সুন্দরবন অঞ্চলে এমন এক দেবীর পূজা হয়, যার নাম শুনে শাস্ত্রীয় দেবী মনে হলেও আসলে তিনি নন। নারায়ণী দেবীর নাম শুনে নারায়ণ কিংবা বিষ্ণুর স্ত্রী বলে মনে হলেও, আদতে তাঁর সঙ্গে বিষ্ণু কিংবা শাস্ত্রীয় কোনো দেবদেবীর কোনো সম্পর্কই নেই। ইনি অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ দেবী হলেও, বর্তমানে তাঁর পূজা কমে এসেছে অনেকাংশে। লৌকিক এই দেবীর পূজা হয় সুন্দরবন, বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে। তবে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে মর্যাদা ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে দক্ষিণরায়ের পরই তাঁর স্থান। ধারণা করা হয়, এই অঞ্চলে বনবিবির পূজা প্রচলিত হওয়ার আগেই নারায়ণীর পূজা প্রচলিত ছিলো। পরে বনবিবির জনপ্রিয়তার আড়ালে ঢাকা পড়ে যান দেবী নারায়ণী।
বনবিবির 'জহুরা নামায়' বনবিবি ও নারায়ণীর জঙ্গ (যুদ্ধ) নামে একটি অধ্যায় আছে। ওই অধ্যায়ে নারায়ণী দেবী আর বনবিবির পূজার উৎপত্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়-
“খোদাতালার হুকুমে মক্কা থেকে বনবিবি ভাটী দেশে অর্থাৎ সুন্দরবনে এলেন অধিকার করতে। কিন্তু ঐ সময় সুন্দরবনের রাজা ছিলেন দক্ষিণ রায়। তিনি বনবিবির আগমনের উদ্দেশ্য জানতে পেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় উদ্যোগী হলে রাজমাতা নারায়ণী বাধা দিয়ে বললেন:
‘তুমি থাক আমি যাই, হারি জিতি ক্ষতি নাই,
আওরতে আওরতে লড়া ভাল।
নারায়ণী ইহা বলে, দেও-দানা লিয়ে চলে,
সেনা শিষ্য যত তার ছিল॥
সারাদিন জঙ্গ চলে, কেহ কারে নাহি
বনবিবি বিপাক দেখিয়া।
মা বরকত বলে ডাকে, উদ্ধারিয়া লেহ মোকে
নারায়ণী ডালিল মারিয়া॥'
বনবিবি মা বরকতকে ডাকতেই নারায়ণী ধরাশায়ী হলেন। তখন বনবিবি -
'দাবাইয়া বৈসে বুকে,চুলে ধরে ছের ঠোকে,
খুন্তি ফের দিতে চায় গলে।
নারায়ণী দেখে ডরে, বিবীর দুই পাও ধরে,
কহে বাত সই সই বলে॥'
'সই' বলাতে তুষ্ট হয়ে বনবিবি শুধু জঙ্গ থামালেন না, সুন্দরবনের ভাগ দিতেও রাজি হলেন।
'বোনবিবি বলে সই শুন দেল দিয়া।
সকলে আঠার ভাটি লইব বাটিয়া॥'
অর্থাৎ, এই কাব্যে বর্ণিত যুদ্ধের পরে, নারায়ণী দেবী আর বনবিবির মধ্যে নিজেদের মাঝে আপোস করে তাদের পূজার এলাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিতে দেখা যায়। এবং এখনো শুধুমাত্র ওই অঞ্চলেই এই দেবীদের পূজার প্রাধান্য দেখা যায়। এখানে চমকপ্রদ একটি বিষয় হলো বনবিবি ও নারায়ণীর মাঝে ‘সই’ বলে সম্পর্ক স্থাপন। নৃবিজ্ঞানের ভাষায় এটি এক ধরণের “ফিকটিভ কিনশিপ”। অর্থাৎ মুখে বলে সম্পর্ক স্থাপন। আর এই চর্চাটি বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায়, যার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। মোঘল ও ইংরেজ আমলে বাংলা ও পার্শ্ববর্তী রাজ্য গুলো থেকে বিভিন্ন লোকজনকে এনে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে দেয়া হয়। পরিচিত স্থান, পরিবার, বন্ধু ছেড়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন এই পরিবেশে বসতি স্থাপন করা মানুষ গুলো অনেকটা নিজেদের বন্ধন দৃঢ় করতেই এই ধরণের চর্চার উৎপত্তি ঘটায়, যার ছাপ আমরা খুঁজে পাই বনবিবি ও নারায়ণীর গল্পেও।
যাই হোক। ধারণা করা যায়, নারায়ণী পূজার উৎপত্তি হয়েছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার 'খাড়ি' নামে এক জায়গায় । এখানে এই দেবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও বিখ্যাত মন্দির এখনো আছে। নারায়ণীর বিশেষ পূজা হয় পৌষ সংক্রান্তি আর মাঘের শুরুতে, এ সময় দেবীর ঘট পূজা হতে দেখা যায়। ঘট পূজার সময় দুটি ঘট একসাথে থাকে, একটি ঘট দক্ষিণরায়ের ও আরেকটি নারায়ণী দেবীর। এ পূজায় মদ ও মাংস নৈবেদ্য দিতেও দেখা যায়। বন অধ্যুষিত অঞ্চলে অনেক সময় রাতভর মশাল জ্বালিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে পূজা হয়।
এককালে নারায়ণী দেবী পূজার যে বিশেষ প্রাধান্য ছিল সেটা বোঝা যায়। এককালে দেবীর পূজায় বলি সহ অন্যান্য লৌকিক রীতি প্রচলিত ছিলো, এটাও ধারণা করা হয়। তবে সেন রাজত্বের সময় বিষ্ণুধর্মাবলম্বী রাজাদের প্রভাবে দেবীর পূজায় নিরামিষাশী বৈশিষ্ট্য আবির্ভূত হয়। ‘ডাকার্ণব’ গ্রন্থে তান্ত্রিক দেবীদের তালিকায় নারায়ণীর নাম পাওয়া যায়, যদিও তান্ত্রিক পূজার ধারা কিংবা আচার এই দেবীর পূজায় খুব একটা দেখা যায় না।
— জাকিয়া তাবাসসুম শশী
তথ্যসূত্রঃ
১। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, “বাংলার লৌকিক দেবতা”, দে’জ পাবলিশিং (১৯৬৬)
২। “বাংলার প্রাচীনতম দেবী নারায়ণী”, দৃষ্টিভঙ্গি (মে ২৭, ২০২৩)