21/10/2025
মুন্সীগঞ্জে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির গ্রাম আদালতে ন্যায় বিচার: অন্তর্ভুক্তির নতুন অধ্যায়
স্টাফ রিপোর্টারঃ
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বেতকা ইউনিয়নে এক তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির গ্রাম আদালতে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সমাজের প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা যেখানে সামাজিক ও প্রশাসনিক ন্যায়বিচার থেকে প্রায়শই বঞ্চিত, সেখানে এ ঘটনা একটি ইতিবাচক ও অনুকরণীয় উদাহরণ তৈরি করেছে।
জানা যায়, উপজেলার দক্ষিণ বেতকা গ্রামের তৃতীয় লিঙ্গের রাজন তালুকদার (৪০), পিতা মকবুল হোসেন, গত ৯ সেপ্টেম্বর সকালে বাড়ির পাশের পুকুরে হাসঁ যাওয়াকে কেন্দ্র করে একই এলাকার আনোয়ার শেখের ছেলে রিপন শেখের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। রাজনের অভিযোগ, রিপন শেখ তার বাড়িতে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, গলা চেপে ধরে কিল-ঘুষি মারে এবং তার মা’কেও মারধর করে। ঘটনাটি স্থানীয় প্রতিবেশী নুর জাহান প্রত্যক্ষ করেন বলে জানা গেছে।
ঘটনার পর তৃতীয় লিঙ্গের রাজন তালুকদার বেতকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে বিচার চেয়ে আবেদন করেন।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বেতকা ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে চেয়ারম্যান রিগ্যান শিকদারের সভাপতিত্বে মামলাটির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বাদী রাজন তালুকদার, বিবাদী রিপন শেখ এবং সাক্ষী নুর জাহান উপস্থিত ছিলেন। শুনানি শেষে আদালত রিপন শেখকে ২ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেন এবং প্রকাশ্যে রাজন তালুকদারের কাছে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দেন।
বিচার শেষে তৃতীয় লিঙ্গের রাজন তালুকদার বলেন, “আমি খুব সন্তুষ্ট। অনেক সময় মানুষ আমাদের মানুষ মনে করে না, কিন্তু আজ আমি ইউনিয়ন পরিষদে এসে ন্যায় বিচার পেয়েছি। আমি চেয়ারম্যান ও আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞ।”
বিচার শেষে বিবাদী রিপন শেখ বলেন, “ঘটনার দিন আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমি কাউকে ইচ্ছা করে মারিনি। পরে বিষয়টি বড় হয়ে যায়। গ্রাম আদালতে আসার পর চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পরামর্শে আমি বিষয়টি মীমাংসা করেছি এবং রাজনের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। ভবিষ্যতে যেন এমন কিছু আর না হয়, সে চেষ্টা করব।”
বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের টঙ্গীবাড়ি উপজেলা সমন্বয়কারী লিয়াকত হোসেন বলেন, “গ্রাম আদালত প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো সমাজের নিপীড়িত, অসহায় ও দরিদ্র মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আজকের মামলার মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করে ন্যায়বিচার পেয়েছেন এবং তিনি এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এটি আমাদের প্রকল্পের জন্য একটি বড় সাফল্য। আমি আনন্দিত যে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে আমরা এমন একজন অসহায় ব্যক্তিকে ন্যায়বিচার দিতে পেরেছি।”
বেতকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও গ্রাম আদালতের বিচারক রিগ্যান শিকদার বলেন,
“গ্রাম আদালত সবার জন্য উন্মুক্ত। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও সমাজের নাগরিক—তাদেরও ন্যায়বিচারের অধিকার আছে। আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে সমান মর্যাদা ও আইনি সুরক্ষা দিতে। তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কিত এমন বিচার চেয়ারম্যান হিসেবে এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। আমি মনে করি, সামাজিকভাবে যতটুকু ন্যায্য বিচার করা প্রয়োজন ছিল, তা করেছি। ইনশাআল্লাহ, ভবিষ্যতে দ্বিতীয় লিঙ্গের সঙ্গে এ ধরনের অন্যায় বা ঝামেলা আর হবে না—এই আশা রাখি।”
গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের মুন্সীগঞ্জ জেলা ব্যবস্থাপক কবির উদ্দিন বলেন,
“গ্রাম আদালত প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের আইনি সেবা নিশ্চিত করা। আজকের মামলাটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী—একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি তার ছোট একটি বিরোধ নিয়ে গ্রাম আদালতে মামলা করেন, যা সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ।”
তিনি আরো বলেন, “এই ঘটনাটি সমাজে একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে। আইনের দৃষ্টিতে কেউ ছোট নয়—সবাই গ্রাম আদালতে এসে ন্যায্য বিচার পেতে পারেন। আমি বিচারকমণ্ডলী ও চেয়ারম্যান মহোদয়কে ধন্যবাদ জানাই এবং আহ্বান জানাই, ছোটখাটো বিরোধের সমাধানে সবাই যেন প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে আসেন।”
সামাজিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রামীণ সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে এটি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা—বিচার ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে।”
বেতকা ইউনিয়ন পরিষদে গত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের চলতি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা ১৩ টি, উচ্চ আদালত থেকে প্রাপ্ত মামলার সংখ্যা ৬ টি, মোট মামলার সংখ্যা ১৯ টি। নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা (বিধি-৩১, আপোষ বা শুনানীতে নিষ্পত্তি) ১৬ টি, উচ্চ আদালতে ফেরত বা বাতিল মামলার সংখ্যা ২ টি, মোট নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ১৮ টি ও বর্তমানে অপেক্ষমান মামলার সংখ্যা ১ টি এবং প্রতিবেদনকালীন সময়ে রায় বাস্তবায়নকৃত মামলার সংখ্যা ১৪ টি।
মুন্সীগঞ্জ জেলায় গত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের চলতি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পূর্বের অপেক্ষমান মামলার সংখ্যা ২৩৬ টি, ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা ৭১৫ টি, উচ্চ আদালত থেকে প্রাপ্ত মামলার সংখ্যা ২০২ টি, মোট মামলার সংখ্যা ১১৫৩ টি। নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা (বিধি-৩১, আপোষ বা শুনানীতে নিষ্পত্তি) ৭৫৯ টি, উচ্চ আদালতে ফেরত বা বাতিল মামলার সংখ্যা ২৮৯ টি, মোট নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ১০৪৮ টি ও বর্তমানে অপেক্ষমান মামলার সংখ্যা ১০৫ টি এবং প্রতিবেদনকালীন সময়ে রায় বাস্তবায়নকৃত মামলার সংখ্যা ৬৭৭ টি।