01/11/2024
কবি কাজি নজরুল ইসলামের এক অজানা প্রেমের কাহিনী বলব, যার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল কালজয়ী দুটি গান। সেই দুটি গান রচনা করার ইতিহাস।
কবি কাজি নজরুল ইসলাম রাজশাহী জেলায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজশাহীতে এক নজরুল ভক্ত ব্যাকুল হয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। কারণ প্রাণের চেয়ে প্রিয়তম কবি নজরুলকে নিজ চোখে দেখে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়াকে সার্থক করবেন। ভক্তটি ছিলেন একজন তরুণী। শুধু তরুণী বললে কম বলা হয় তিনি ছিলেন যেমন সুন্দরী তেমন ব্যক্তিত্ববান, ও শিক্ষিত।
তরুণী নির্দিষ্ট দিনে পদ্মার ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা স্টিমারে উঠলেন রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তরুণী স্টিমারের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িযে আছেন, দুই হাতে অবাধ্য চুল গুলোকে বাঁধছেন আর ভাবছেন কিভাবে তাঁর প্রিয় কবির সাথে দেখা করবেন। দেখা হলে তিনি কি বলে কবিকে সম্ভাষণ করবেন। মধুর ভাবনায় ছন্দ-পতন হল। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলেন এক তরুণ ভাবালু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। সুঠাম দেহ তাঁর। তরুণী নিজেকে সামলে নিলেন। যুবকটির অসভ্যতায় বিরক্ত বোধ করতে লাগলেন। তরুণী ঐ জায়গা থেকে সরে অন্য দিকে চলে গেলেন। সেখানে বসে আবার তাঁর প্রিয় কবির ভাবনায় বিভোর হয়ে গেলেন। এই সময় আবার যুবকটিকে দেখলেন। এবারও তিনি তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। তরুণী এবার আর সরে গেলেন না। সাহস করে সোজা যুবকের দিকে এগিয়ে গেলেন। সরাসরি যুবকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর যুবকের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেনঃ 'আপনি এমন করছেন কেন ? মেয়ে মানুষ কখনও দেখেননি ? লজ্জা করে না এভাবে পথে ঘাটে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে?' যুবক কিছুই বললেন না। ধীর পায়ে তরুণীর কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন। তরুণীও স্বচ্ছন্দ বোধ করলেন।
তরুণী যথা সময়ে অনুষ্ঠানে পৌছলেন। প্রিয় কবিকে দেখার জন্য সেই সভার একেবারে সামনের দিকে বসলেন। কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শুরু হল। দর্শকরা দেখতে পেল তাদের প্রিয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে মঞ্চে উঠে তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। আর তরুণী দেখতে পেলেন তাঁর কবি কাজি নজরুল ইসলাম আর কেউ নয়, পদ্মা নদীতে ঢেউ কেটে চলা স্টিমারের সেই অসভ্য সহযাত্রী। যাঁকে তিনি অপমান করেছিলেন তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন বলে।
নজরুল মঞ্চে বসে সরাসরি তরুণীর দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হল দুজনের। তরুণী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন। হায় হায় একি করেছেন তিনি। যাঁকে সারা জীবন পূজা করেছেন প্রিয় কবির বেদিতে রেখে, তাঁর সাথে তিনি না জেনে, না বুঝে একি আচরণ করলেন। এই সময় মঞ্চ থেকে ভেসে এল উপাস্থপকের ঘোষণা - এখন সংগীত পরিবেশন করবেন আমাদের প্রিয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম। বেজে উঠল হারমোনিয়াম আর তবলার সম্মিলিত আওয়াজ। তার কিছু পরেই যোগ হল কবির ভরাট কন্ঠের গান। সম্পূর্ণ নতুন গান। কবির সব গান তরুণীর কন্ঠস্থ, কিন্তু এই গান সম্পূর্ন নতুন যা আগে কখনও তিনি শোনেননি । তার মানে কবি এখনই এই গান খানা রচনা করেছেন। যা কবি কাজি নজরুল ইসলামের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। কবি গাইলেন -
*তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ*।
তরুণী বুঝতে পারলেন গান খানা তাঁকে নিয়েই কবি রচনা করেছেন। অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেলেন, কবি তাঁর দিকে তাকিয়েই গান গেয়ে যাচ্ছেন। কবির আশে পাশে তার বন্ধুরাও তাকিয়ে আছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। এত সুন্দর গান শুনেও তরুণীর মনে হল ধরণী দ্বিধা হলে ভাল হত।
তরুণী এরপর ওভাবেই মাথা নিচু করে পুরো অনুষ্ঠানটা শেষ করলেন। অনুষ্ঠান শেষে, আর কিসের কবির সাথে দেখা করা আর কথা বলা , এখন পালাতে পারলেই তিনি যেন বেঁচে যান।
স্টিমারে ফিরতি পথে রওয়ানা দিলেন তরুণী। মনের মাঝে চলছে উথাল পাথাল আত্মসমালোচনার ঢেউ। যাঁর জন্য এত কিছু, তাঁর সাথে প্রথম দেখায় তিনি একি আচরণ করলেন। তিনি তো পত্রিকায় কবির ছবিও দেখেছিলেন, তারপরও কেন চিনতে পারলেন না? কবির সাথে নিজকৃত আচরণের জন্য তরুণী কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। এই ঘটনায় তরুণী তাঁর নিজের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেললেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজের জীবন নিয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তাকালেন পদ্মা নদীর পাক খাওয়া ঘোলা জলের দিকে। পদ্মা নদীর বুকেই যেন সব শান্তি। নদীর অশান্ত জল যেন তাঁর সকল গ্লানি মুছে দিতে তাঁকে ডাকছে।
কবি কাজি নজরুল রাজশাহীতে থাকা অবস্থায় শুনতে পেলেন তাঁর অচেনা সেই তরুণী ভক্তের পদ্মা নদীতে আত্মহত্যা করার করুণ কাহিনী । সেই তরুণী ভক্তের মৃত্যুতে তাঁর কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠল।
জন্ম নিল আরেকটি কালজয়ী গান।
*পদ্মার ঢেউরে, মোর শূণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে,*