19/10/2025
আত্মঅন্বেষণ
গায়ের ভোরটা তখনও কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে। বাশঝাড়ের ফোকর গলে আসা কাচা আলো মাটির সাদা গন্ধের সাথে মিশে একাকার। চোখ খুলতেই আগে শুনি মুরগির তীক্ষ্ণ ডাক। আমাদের বসতবাটি হয়তো মধ্যবিত্তের চৌকাঠ ডিঙোয়নি, বরং তারও খানিক নিচে। অথচ বাবা বলতেন, যে নিজের ইজ্জত বোঝে, সে কখনও গরীব না। সেই কথাটাই শিরদাড়ায় জোর দিত। পাশের বাড়ির পোলাটা যখন নতুন সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে স্কুলে যাইত, আমি তখন খালি পায়ে হাটতাম শুধু এই একটি বাক্যকে পুজি কইরা।
শৈশবটা ছিল নরম মাটির মতোই, বাইরে নরম হইলেও ভেতরে সাচিত ছিল এক জোর।
প্রতিটি অভাব প্রতিটি কষ্ট আমারে শিখাইত অন্ধকারে কেমন কইরা আলো খুজতে হয়। তখন বুঝি নাই এই আলোই একদিন আমারে নিজের আত্ম-অন্বেষণের পথে টানিয়া নিবে।
আমার জীবন তো কোনো কোলাহল না, বরং এক নীরব সফর যেখানে সব প্রশ্নের উত্তর আমি শুধু নিজের ভিতরের গভীরে খুজছি। বন্ধুরা একে একে শহরে পাড়ি জমাইলো, আর আমি পইড়া রইলাম এই ধূলিমাখা গায়ে। কেন জানো।
আমার মনে হইত এই মাটিটাই আমার আয়না। এখানে আমি যেমন, তেমনই দেখতে পাই নিজেকে।
সেই সত্যের গভীরে একদিন তার আগমন হইল কালো রঙে মোড়া এক মায়াবতী। প্রথম দেখায় কিছুই অনুভব করি নাই, শুধু মনে হইছিল, তার চোখে এক অন্যরকম শান্তি বিরাজ করে। মনে হতো শত ঝড়ের পরও কেউ স্থির থাকতে শিখছে। আজও তার নাম মনে পড়লে বুকের ভিতরটা কেপে ওঠে, কিন্তু আজ আর নাম কমু না।
এই গল্পটা তো শুধু তার না, এ আমার অপরাধবোধের কিসসা।
বিয়েটা হইছিল সামাজিক নিয়ম মেনেই। আমার ধারণা ছিল, ভালোবাসা বুঝি সময়ের লগে লগে হাঁটি হাঁটি পা পা কইরা আসে। কিন্তু সময়ের লগে যা আইলো, তা ভালোবাসা না, সে হইল অভাবের অভিশাপ, অপূর্ণতার ভার, আর নিজের প্রতি অসহ্য ঘৃণা।
আমি যে অর্থহীন সে তো জানতো।
কিন্তু সমাজ জানতো না। আর সমাজের সেই তির্যক দৃষ্টি বিষের মতো আমাদের ঘরের দেওয়াল ফুড়ে ঢুকছিল।
আমি জানি না, তারে আমি ট্যাকার কাছে হারাইছি নাকি তার অহংকারে ছাইড়া গেছে। তবে সে চইল্যা যাওয়ার দিন প্রথমবার বুঝলাম।
ভালোবাসা মানে অধিকার না, ভালোবাসা মানে হইল মাথা নত কইরা ক্ষমা চাওয়ার সাহস। অথচ ক্ষমা বার বার আমারই চাইতে হইছে।
সেই দিন থাইকাই আমার আত্মানুসন্ধানের শুরু। আমি খুজতে শুরু করলাম মানুষ আসলে কীসের জোরে বাচে। প্রেমের জন্য, নাকি আত্মমর্যাদার জন্য।
ভোরের আলো ফুটলে আমি ভিজে মাঠে দাড়াই। শিশিরে ভেজা ঘাসের গন্ধে বুক ভইরা যায়। মনে হয়, এই ঘ্রাণই বুঝি আমার অতীত, আমার অপরাধবোধ, আমার অপ্রকাশিত প্রার্থনা।
আমাদের গায়ের মাইয়ারা সূর্যের আলোয় খুব একটা বেরোইত না। দুপুরের পর তারা গামছায় মুখ ঢাইক্যা হাটতো, যেন সূর্যের থাইক্যাও ভয়ানক সমাজের চোখের দৃষ্টি। কিন্তু সে ছিল আলাদা। তার চোখে এমন এক আলোর জোর ছিল, যা কারও পরোয়া করতো না।
যেদিন প্রথম তারে দেখি, পুকুরঘাটে। সে তখন কাথা ধুয়ে চলেছে। জলরাশি তার কৃষ্ণবর্ণে এমনভাবে প্রতিফলিত হইতেছিল, প্রকৃতি নিজেই তার সামনে নিষ্প্রভ। আমার চোখে তখন কোনো শরম ছিল না, ছিল শুধুই কৌতূহল। এমন আত্মবিশ্বাস, এমন নির্ভরতার ছাপ আমি এর আগে কোনো মাইয়ার চোখে দেখি নাই।
গায়ের মানুষ কইতো, ওর রঙ কালা, তবে মনটা সাদা। আমি জানতাম, তারা প্রশংসা করছিল না, তারা পরিমাপ করছিল সৌন্দর্যের সেই পুরনো মানদণ্ডে। আর আমি, সেই সমাজেরই একটা অংশ হইয়াও, অদ্ভুতভাবে তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম।
তার নাম ছিল মায়া। নামটা ঠিক তার মতোই সরল, অথচ ভেতরে জটিলতা।
প্রথম কথা হইছিল ফোনে, একদিন প্রাইভেট গেছিলাম। মায়া তার মা'র লগে ছিল। আমার নজর তার উপর পড়তেই, দুর থাইকা ডাক দিয়া সে একবার তাকাইয়া হাসছিল খুব আলতো হাসি, কিন্তু সেই হাসির প্রতিধ্বনি আমার বুকের ভেতর চিরতরে বাইজ্যা উঠলো। এরপর মাঝে মাঝেই দেখা হইত। আমি জানতাম, সবার চোখে সব ধরা পড়ে, তবুও কিছু করার ছিল না। আমি যেমন তার দিকে তাকাইতাম, সে-ও তেমন কইরা নির্ভয়ে, নির্লজ্জভাবে তাকাইত। মনে হইতো সে কইতাছে, তুমি যত দেখবা, আমি তত বেশি তোমাকে ধ্বংস করব।
ধীরে ধীরে কথা গড়াইল। বিকেলের মরা আলোয় মাঠের ধারে বইসা গল্প হইত আমি কইতাম ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আর সে কইতো তার ভয়গুলো। সে কইতো, তুমি বড় হইবা, শহরে যাইবা, আমি এই গায়েই থাইক্যা যামু।আমি উত্তর দিতাম, না, আমি যামু না। আমার সব স্বপ্ন তো তুমি। সে হাইস্যা কইতো, স্বপ্নের মধ্যে থাকা মাইয়াদের বাস্তবে পাওয়া যায় না।
মায়া ছিল ব্যতিক্রম। সে কখনও ভালোবাসার কথা মুখে আনে নাই, কিন্তু তার চোখে সব প্রশ্নের উত্তর জমা ছিল। তার রঙ কালা হইলেও, আমি তার ভেতরে এমন এক আলোর শিখা দেখছিলাম, যা আমারে ভিতরের অন্ধকার থাইক্যা নাড়াইয়া দিল। সেই প্রথমবার বুঝলাম, আমি নিজেরই নিজে ধ্বংসের দিকে ঠ্যাইল্লা দিতাছি।
যখন জানতে পারলাম, তার পরিবার আমার পরিবারের লগে বিয়ার প্রস্তাব দিতাছে, আমি ভেতরে ভেতরে কাইপা উঠলাম। ভয় না, ছিল অবিশ্বাস। এইটা যে তার মিথ্যা নাটকীয় চক্রান্ত ছিল, আমি বুঝতে পারি নাই। সেই ফাদে আমারে ফালাইয়াই ছাড়লো। ভাবছিলাম যারে স্বপ্নে দেখছি, সে সত্যি সত্যিই আমার বাস্তব হইতে চলতাছে!
বিয়ার দিন সকালে তারে যখন দেখলাম, লাল শাড়ি, আমার মনে হইল, পৃথিবী স্থির। তার চোখে সেই একই ভয়ংকর আলো ছাপ, তবে তাতে এখন শান্ত কৌতূহল মেশানো। সে ফিসফিস কইরা কইছিল, তুমি ভয় পাইয়ো না। জানি, আমাদের জীবন সহজ হইবো না, কিন্তু আমি পারুম।
ওর সেই (আমি পারুম) কথাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে দামি প্রতিশ্রুতি হইয়া রইল। কিন্তু তখন বুঝি নাই, প্রতিশ্রুতি যতটা আলো দেয়, ততটাই গভীর ছায়া ফেলে। অভাবের দংশন, সমাজের কটাক্ষ, আর নিজের অযোগ্যতার বোধ ধীরে ধীরে তার মিথ্যা ভালোবাসার জমিন শুকাইয়া দিতে শুরু করলো।
বিয়ার পর প্রথম মাসেই বুঝছিলাম, সংসার কেবল ভালোবাসা দিয়া চলে না। চাউলের দাম, ঔষুধের খরচ, তার শপিং, এসব মিলাইয়া আমি এক অদৃশ্য বোঝা বইতেছিলাম, আমার কাছে তখন ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নাই। মায়া তবুও হাসতো। ও কইতো, আমরা ভালো আছি, অন্যদের মতো তো কেউ আমাদের ঘর ভাইঙ্যা দেয় নাই।ওর কথায় একরকম নিরাশার আশাবাদ থাকতো, যা শুনলে মনে হইত, ও নিজেকেই বেশি কইরা বুঝাইতাছে, আমারে না।
রাতে ঘুমাইতে গেলে আমি শুনতাম, মায়া চুপচাপ জানালার দিকে তাকাইয়া থাকে। বাইরে জোনাকির আলোয় ওর মুখে ছায়া পড়তো, আলোও জানে ওর ভিতরে আলো নাই। আমি চেষ্টা করতাম হাসাইতে, কিন্তু দিন দিন ও চুপ হইয়া যাইতাছিল। আমার রাগ হইত, আবার অপরাধবোধও। আমি যদি আরেকটু বেশি ট্যাকা কামাইতে পারতাম, হয়তো ওর মুখে এই নীরবতা থাকতো না।
গায়ে গুজব ছড়াইলো। পোলাটা কিছুই করতে পারে না। মায়া এমন লোকের লগে বিয়া করছে, যার হাতে কিছুই নাই। কথাগুলো মায়া সরাসরি শুনতো না, কিন্তু আমি শুনতাম। আর তাতে আমার ভেতরের আত্মসম্মান টুকরা টুকরা হইয়া যাইতো। একদিন সন্ধ্যায় আমি ঘরে ফিরা দেখি, মায়া কাথা সেলাই করতাছে। এগুলা কেন। জিজ্ঞেস করতেই ও কইছিল, ভালো লাগে। আর কইলো কবে প্রতিষ্ঠিত হবা। আমি কিছু কই নাই, কিন্তু মনে মনে লজ্জায় পুড়তেছিলাম। যে মাইয়াটা একসময় আমার চোখে আলো ছিল, সে এখন নিজেই সংসার ভাঙার লাইগা চেষ্টায় আছে।
সেই রাতে আমি প্রথমবার মায়াকে এড়াইয়া চলি। ও ঘুমাইয়া পড়লে আমি উঠোনে বইসা থাকতাম। চান্দের আলোয় নিজের ছায়া দেখতাম, এক ক্লান্ত ছায়া, যার চোখে ভয় আর হৃদয়ে অপরাধবোধ। পরের দিনগুলোতে আমরা পাশাপাশি থাকতাম, কিন্তু দূরত্বটা বাড়ছিল। ওর হাসি, কথাগুলো ছোট হইয়া যাইতাছিল। আমার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল এক অদ্ভুত অপরাধ, যে পুরুষ কিছু দিতে পারে না, সে অন্তত দূরে থাকতে পারে।
একদিন ও কইল, তুমি বাইদলা যাইতাছো। আমি কইলাম, না, সময় বাইদলা দিতাছে। সে চুপ হইয়া গেল। সেই চুপ কইরা যাওয়া ছিল আমাদের সম্পর্কের প্রথম নীরব মরণ।
তবু মায়া আমার জন্য রান্ধতো, কাপড় ধুত, কিন্তু চোখে সেই আগের আলোটা আর ছিল না, আমার সাথে সে আর থাকতে চাইতাছিল না,এটা আমি বুঝতাম। আমি যখন তার দিকে তাকাইতাম, ও চোখ নামাইয়া নিত। মনে হইত, ওর মধ্যে এমন কিছু কথা জমছে, যা কোনোদিন মুখে আইবো না। এক রাইতে বৃষ্টি পড়ছিল। টিনের চালের উপর বৃষ্টির শব্দে ঘর ভইরা গেছিল। আমি হঠাৎ কইছিলাম, তুমি কি সুখী, ও কিছুক্ষণ চুপ থাইক্যা কইল, সুখ তো খাওয়া-পরা না। কিন্তু তুমি নিজেকে ভালোবাসো না, তাই আমারেও ভালোবাসতে পারো না।
ওর এই একটুকু কথাই আমার বুকে বজ্রপাত ঘটাইল। আমি প্রথমবার বুঝলাম আমি মায়াকে হারাইতাছি না, মায়া নিজেই হারিয়ে যাইতাছে, আর আমি নিজেকেই হারাইয়া ফালাইছি।
তারপরের দিনগুলোয় আমরা শুধু একসঙ্গে থাকতাম, কিন্তু একে অপরের থাইক্যা দূরে। ও জানতো, আমি বাইরে কাজ খুজছি, হয়তো আর ফিরুম না। আমি জানতাম, ও চায় আমি ফিরা আসি, কিন্তু সেটা আর হইবো না। একদিন ভোরে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, চইল্যা যামু। মায়া তখন ঘুমাইতেছিল। ওর পাশে বইসা শুধু একটা কথা কইলাম ক্ষমা করো। ও চোখ খুলল না, শুধু ঠোট নড়ল হয়তো কিছু কইতে চাইছিল।
সেই ভোরেই আমি গাও ছাইড়্যা শহরের দিকে রওনা হইলাম। মাটির গন্ধটা পেছনে থাইক্যা গেল, লগে রইল মায়ার চোখের আলো যা আজও আমার অপরাধবোধের ভিতরে জ্বলতাছে, নিভতাছে না।
শহরের নিঃসঙ্গতা পুরোনো চিঠি
শহররে আমি সবসময় ভয় পাইতাম। গায়ের নরম মাটির বদলে এখানে পিচঢালা রাস্তা, মানুষের মুখে হাসি নাই, চোখে তাড়াহুড়ো। প্রথম দিন শহরে পৌছাইলাম যখন, সূর্যটা ডুবতাছিল আকাশে লালচে আভা, দেইখা মনে হয় কারও পুরোনো স্মৃতি পোড়ানো ধোয়া। হাতে ছিল ছোট একটা ব্যাগ, ভেতরে দু’জোড়া কাপড় আর বাবার কয়েকটা চিঠি কাজ খুজে নিস, কিন্তু মন যেন না হারাস। আমি জানতাম, কাজ খুজে পাওয়া সহজ না, কিন্তু মন তো আগে থাইক্যাই হারাইয়া ফালাইছি মায়ার চোখে।
শহরে প্রথম কয়েকদিন কাটলো এক বন্ধুর মেসে। ভাড়া বেশি, কাজ কম। আমি ছোটখাটো কাজ খুজতে বাইর হইতাম দোকানে, গুদামে, বই বেইচা। কেউ নিত না। কইতো, তোমার অভিজ্ঞতা আছে। আমি মৃদু হাইস্যা কইতাম, জীবনের। তারা হাসতো না।
রাইতে জানালার পাশে বইসা থাকতাম। দূরে আলো ঝলমল করতো, কিন্তু আমার ভেতরে ছিল অন্ধকার। প্রতিদিন রাইতে মনে হইত, মায়া হয়তো এখন ঘুমাইতাছে, হয়তো উঠোনে বইসা তারা দেখতাছে, হয়তো আমার নাম একবারও উচ্চারণ করে না। তবুও আমি ওর কণ্ঠস্বর শুনতাম কল্পনায়, বাতাসে আবার কখনও বৃষ্টির শব্দে।
কিছুদিন পর একটা ছোট কাজ পাইলাম। মাসে সামান্য ট্যাকা, কিন্তু অন্তত বাচা যায়। দিনভর কষ্ট আর অজানা মানুষের লেখা ছুইয়া থাকতাম। মনে হইত, আমি অন্যোর গল্প ছাপতাছি, নিজেরটা মুইছা ফালাইতাছি।
একদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টির পর রাস্তায় হাটতেছিলাম। চারপাশের কোলাহল, আলো অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। হঠাৎ মনে পড়ল, মায়া বৃষ্টিতে দাড়াইয়া থাকতে ভালোবাসতো। ও কইতো, বৃষ্টি আসলে পুরোনো কষ্ট ধুইয়া যায়। আমি হাইস্যা কইতাম, তাইলে তুমি তো প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভিজতে পারো।ও হাসতো।
সেই হাসিটা হঠাৎ আবার শুনতে পাইলাম, শহরের কোলাহলের মাঝেও। আমি থাইম্যা গেলাম। মনে হইল, ওর ছায়া আমার সামনে দাড়াইয়া আছে। চোখ মেলতেই দেখি কিছুই নাই। তবু বুকের ভেতর এমন কাপন উঠল, মনে হইতাছো সময় আবার পেছনে ফিরা গেছে। সেই রাতে ঘরে ফিরা প্রথমবার ডায়েরি খুললাম। লিখলাম,
“আমি মায়াকে হারাই নাই, আমি হারাইছি নিজেকে। ভালোবাসা কখনও মরে না, শুধু জায়গা বদলায় এক শরীর থাইক্যা অন্য স্মৃতিতে"
সেই ডায়েরিটাই হইয়া গেল আমার একমাত্র সঙ্গী। প্রতিদিন রাইতে কিছু না কিছু লিখতাম নিজের অপরাধবোধ, আত্মসমালোচনা, জীবনের নতুন উপলব্ধি। আমি বুঝতে শুরু করলাম, আত্ম-অন্বেষণ মানে নিজেকে খুজে পাওয়া না, বরং নিজেকে মাইন্যা নেওয়া।
তবুও মায়া থাইক্যা গেল না। ওর নাম লিখলে কলম কাপে, ওর মুখ মনে পড়লে বুক ভারী হইয়া যায়। একদিন আমি ভাবলাম, ওরে চিঠি লিখুম। কলম হাতে নিয়া অনেকক্ষণ বইসা থাকলাম। লিখলাম,
“মায়া, আমি ভালো নাই, কিন্তু বাইচ্যা আছি। তুমি কেমন আছ। তোমার চোখে কি এখনও সেই আলো আছে"
চিঠিটা শেষ করতে পারি নাই। মনে হইল, এইটা ওরে পাঠানো না, নিজের কাছে স্বীকারোক্তি মাত্র।
কয়েক মাস চইল্যা গেল। জীবন ধীরে ধীরে স্থির হইতে লাগল। কাজ থাইক্যা কিছু বাড়তি আয় হইতেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, ট্যাকা আসলে সুখ না, কিন্তু অভাবের দংশনরে কিছুটা থামায়া দেয়। তবুও, রাইতে ঘুম আসতো না। মনে হইত, কোথাও মায়া এখনো জাগনা আছে, আমার মতোই একলা, আমার মতোই আত্মানুসন্ধানী। আমরা দুইজন দুই প্রান্তে থাইক্যাও একই প্রশ্নে বাইচ্যা আছি। ভালোবাসা কি একা টিইক্যা থাকে।
একদিন অফিস থাইক্যা ফেরার পথে দেখলাম, রাস্তার পাশে এক মাইয়ার চোখে সেই একই আলো। আমি থাইম্যা গেলাম, কিন্তু ও আমার দিকে তাকাইল না। আমি হাটতে লাগলাম, বুঝলাম, মায়ার আলো শুধু তার না সেই আলো এখন আমার ভেতরেই বাস করে। সেই রাতে আবার লিখলাম,
“মায়া, তুমি আমার অপরাধবোধের নাম না, তুমি আমার আত্মার আয়না। তোমারে হারাইয়া আমি নিজেকে খুজে পাইছি।
আমার জীবন তখন একটু একটু কইরা নিয়মের ছন্দে ঢুকছে। সকালে কাজে, সন্ধায় কালমের কালি আর অক্ষরের গন্ধ, রাইতে নিঃসঙ্গতা। সবকিছু একঘেয়ে, কিন্তু শান্ত। আমি ভাবছিলাম, হয়তো এভাবেই চলবো যতদিন না বুকের ভেতরের অপরাধবোধ পুরাপুরি শ্যাষ হয়।
কিন্তু একদিন, সব পাল্টাইয়া গেল। সেই দিন বিকেলে অফিসে বইসা পুরান কাজ গোছাইতেছিলাম। একটা পুরান উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ডিজাইন অর্ডার আইছিল। ডিজাইন করতে করতে দেখি, একটা হলদেটে খাম পইড়া আছে চিঠির মতো, কিন্তু ঠিকানাবিহীন। খামের ওপরে হালকা হাতে লেখা যে খুজতাছে, সে একদিন খুজে পাইবো।
আমি থমকে গেলাম। এমন এক অদ্ভুত লাইন আমারই জন্য লেখা। চিঠিটা খুললাম। ভেতরে তিন পাতার লেখা, পুরান কালি, কিন্তু অক্ষরগুলা স্পষ্ট পরিচিত হাতের লেখা।
“তুমি যখন এইটা পড়বা, আমি হয়তো অনেক দূরে। আমি তোমারে দোষ দেই নাই কোনোদিন, শুধু তোমার ভিতরের অন্ধকাররে ভয় পাইছিলাম। তোমার না-পারাটা আমার ভালোবাসারে ভাঙে নাই, শুধু সময়রে ক্লান্ত করছে। একদিন যদি তুমি নিজেকে খুজে পাও, জাইন্যা রাইখো আমি তোমার নেই"
আমি নিঃশ্বাস নিতে পারতাছিলাম না। কলমের দাগ, লেখার ভঙ্গি সবই মায়ার মতো। কিন্তু ও কি সত্যিই লিখছিল এইটা। কখন, কীভাবে, কার কাছে পাঠাইছিল। আর এই খামটা আমার হাতেই বা আইলো কীভাবে। আমি ভাবতে লাগলাম এইটা কি কেবল কাকতালীয়, না কি কোনো অদৃশ্য যোগসূত্র। শহরের এত অজানা মানুষের মধ্যে, কেন আমি এই চিঠি পাইলাম।
সেই রাতে ঘরে ফিরা আমি সারাক্ষণ চিঠিটার দিকে তাকাইয়া ছিলাম। প্রতিটি শব্দ আমার ভেতর ঢুক্যা গিয়া পুরান ক্ষতগুলো আবার খুইলা দিল। আমি জানতাম না, মায়া এখন কই, বাইচ্যা আছে কি না, কিন্তু চিঠির ভাষা সময়ের ওপার থাইক্যা আইছে। রাইত গভীর হইলে জানালার পাশে বইসা আবার পড়লাম
“তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে শিখলে তবেই আমায় ভুলতে পারবা।”
এই লাইনটা আমার হৃদয়ের তাল ভাইঙ্যা দিল। আমি প্রথমবার বুঝলাম হয়তো মায়া আমারে ক্ষমা করছে, কিন্তু আমি নিজেকে এখনো করি নাই।
পরদিন অফিসে গিয়া খামের উল্টা দিকটা ভালো কইরা দেখলাম। এক কোণে ছোট একটা ছাপা অক্ষর ছিল। এইটা আমার ডিজাইন, প্রায় বছর খানিক আগের। মানে এই চিঠি বহু আগেই আইছিল। সব মিলাইয়া রহস্য আরও গভীর হইল।
আমি ঠিক করলাম, গায়ের দিকে ফিরা যামু চিঠির উৎস খুজতে, না হয় মায়ার স্মৃতির শ্যাষ রেখাটা ছুইতে। রাতের ট্রেনে বইসা জানালার বাইরে তাকাইয়া থাকলাম। অন্ধকারে আলো জ্বইল্যা ওঠে, আবার নিভ্যা যায়। আমি মনে মনে কইলাম, "মায়া, যদি সত্যিই তুমি এই চিঠি লেখো, আমি এবার তোমার কথা রাখুম নিজেকে খুজুম, না হয় তোমাকেই।"
ট্রেনের ছন্দে মনে হইতেছিল, কেউ আমার পাশে বইসা হাসতাছে। বুকের ভেতর এক মৃদু আলো ছড়াইয়া পড়ল রহস্যের, ভালোবাসার, আর আত্ম-অন্বেষণের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। চিঠিটা এখনো আমার পকেটে। প্রতিবার স্পর্শ করলে মনে হয়, ওর আঙুল আমার হাত ছুইয়া গেছে। আমি জানি না, সামনে কী আছে, ওর দেখা, না আরেকটা হারানো উত্তর। কিন্তু এবার আমি ভয়ের না, খোজের পথে।
ট্রেনটা ভোরের আগে পৌছাইল। জানালার বাইরে অচেনা অন্ধকার ধীরে ধীরে ফিকে হইয়া আসছিল। কিন্তু আমার ভেতরের অন্ধকার তখনও ঘন প্রতিটি নিঃশ্বাসে মায়ার ছায়া ভাসতাছে। বহু বছর পর ফিরা আইলাম সেই গায়ে, যেখান থাইক্যা হারাই গেছিলাম একসময়। স্টেশনের বাইরে নাইম্যা দেখি, পথগুলা আগের মতোই, কিন্তু মানুষ বাইদলা গেছে। বাশঝাড়ের মাথায় সকাল লাগছে, ধানক্ষেতে শিশিরের ঝিলিক। বাতাসে সেই পুরান গন্ধ মাটির। মনে হইল, গ্রামটা আমারে চিন্যা ফালাইছে।
বাবার পুরান বন্ধুর বাড়িতে উঠলাম। তিনিই কইলেন, "মায়ার কথা শুনছোস" আমার বুক হঠাৎ থাইম্যা গেল। শব্দ বাইর হইল না মুখ থাইক্যা, কেবল চোখ তুইলা তাকাইলাম। তিনি চুপ কইরা কিছুক্ষণ পর কইলেন, ও তো অনেক আগেই চইল্যা গেছে। পাঁচ বছর হইল। আমি পাথর হইয়া গেলাম। চইল্যা গেছে মানে কী। মইরা গেছে। নাকি অন্য কোথাও হারাইয়া গেছে। প্রশ্নগুলা মনে ঢেউ তুলল, কিন্তু মুখে আনতে পারলাম না।
ওই রাইতে ঘুম আইল না। পরদিন সকালে আমি মায়ার বাড়ির পথে রওনা দিলাম। পথটা আগের মতোই। বাড়ির সামনে গিয়া দাড়াইতেই দেখি, পুরান চালের নিচে শুকনা পাতার স্তূপ। দরজায় টোকা দিতেই এক বুড়ি বাইর হইল। চিনতে পারে নাই আমারে প্রথমে। কিন্তু যখন নাম কইলাম, তার চোখে জল চইল্যা আইল। "তুই ফিরলি" আমি মাথা নিচু কইরা কইলাম, চিঠিটার জন্য।
তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেইলা ভেতরে নিয়া গেলেন। দেয়ালে মায়ার একটা ছবি সাদা শাড়ি, কপালে লাল টিপ, সেই চেনা শান্ত চোখ। বুড়ি ধীরে ধীরে কইলেন, "মায়া তোমার জন্যই বাইচ্যা ছিল, আবার তোমার জন্যই চইল্যা গেল।"
আমার হৃদয় তার লগে, বাকি গল্পও বইয়া চলতাছে অজ্ঞাত পথে। শহরের চিঠি, গায়ের মাটির গন্ধ, মায়ার চোখের আলো সব মিলাইয়া এক অমোঘ রহস্য। এই আলো কি সত্যিই মায়ার, নাকি ভ্রমের। এই প্রশ্নই পাঠকরে গল্প খাইক, বাইর কইরা নিয়া যায়, মায়া ও নায়ক দুজনেরই অস্তিত্ব, এক অজানা রহস্যের মধ্যে।