29/07/2025
কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে জনতার নেতা: আল্লামা মামুনুল হক
✍️ মুফতি সুলতান মাহমুদ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কিছু বিরল নেতা রয়েছেন, যাঁদের পথচলা শুরু হয় মঞ্চে, কিন্তু শেষ হয় মানুষের হৃদয়ে। তেমনই একজন আপসহীন সাহসী নেতা হলেন আল্লামা মামুনুল হক। তাঁকে কেবল একজন বক্তা, সংগঠক বা রাজনীতিবিদ বললে কম বলা হবে; তিনি হলেন এক চলমান আদর্শ, এক আপসহীন সংগ্রামের নাম, যিনি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে উঠে এসেছেন জনতার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উচ্চতর শিখরে।
আপসহীন ব্যাক্তিত্ব ও সংগ্রামী নেতৃত্ব
আল্লামা মামুনুল হক হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বে থেকে কখনোই আপসের রাজনীতি করেননি। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি বরাবরই ছিলেন অবিচল, কঠোর এবং আপসহীন। তাঁর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম কেবল একটি ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে নয়, বরং একটি গণমুখী ইসলামী আন্দোলনের রূপ নেয়।
শাপলা চত্বরে ইতিহাস গড়া সংগ্রাম
২০১৩ সালের ৫ মে’র শাপলা চত্বরের আন্দোলন ইতিহাসে এক অনন্য সংগ্রামের নাম। হেফাজতের নেতৃত্বে লাখো তৌহিদী জনতা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী নাস্তিক্যবাদী চক্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা আল্লামা মামুনুল হক অগণন ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেন। কিন্তু হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতি সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে নির্মমভাবে রক্তাক্ত করে। এরপর থেকেই মামুনুল হক ছিলেন সরকারের টার্গেটে।
মোদী বিরোধী সংগ্রাম ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত
২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর ঘিরে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। আল্লামা মামুনুল হক তাঁর জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে জনমতকে শাণিত করেন এবং রুখে দাঁড়ান সাম্প্রদায়িক ও ইসলামবিদ্বেষী শক্তির বিরুদ্ধে। এর ফলেই আন্তর্জাতিক ইসলামবিরোধী মহল ও ভারতের প্ররোচনায় তাঁকে দমন করার নীলনকশা তৈরি হয়।
মূর্তিবিরোধী আন্দোলন
এসময়ে হাসিনা সরকার আদালত চত্বরে থেমিসের মূর্তি ও মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্যের নামে জাহিলী সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আল্লামা মামুনুল হক রুখে দাড়ান৷ বিভিন্ন মাহফিল সভা- সেমিনারে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন ও আন্দোলনের ডাক দেন৷ এতেকরে তিনি সরকারের চক্ষুশুলে পরিনত হন৷
বর্ণচোরা গোষ্ঠী ও মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের ষড়যন্ত্র
আল্লামা মামুনুল হকের উত্থান যাদের রাজনীতির ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তারা ছিল দুটি বিপরীতমুখী পক্ষ—একদিকে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের নামে স্বঘোষিত চেতনার ব্যবসায়ীরা, অন্যদিকে ধর্মীয় আবরণে বিভ্রান্তিকর বর্ণচোরা গোষ্ঠী। এই দুই পক্ষ সরকারকে ব্যবহার করে তাঁকে নির্মূল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলা, কুৎসা রটনা, ব্যক্তিগত চরিত্র হননের চক্রান্ত—সবকিছুরই পেছনে এই দুষ্টচক্র সক্রিয় ছিল।
কারাগারে অমানবিক নির্যাতন ও অবিচলতা
আটকের পর কারাগারে তাঁর ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। দিনের পর দিন নির্জন সেলে রাখা, মানসিক চাপ, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিতকরণ—সবই ছিল তাঁকে নতজানু করানোর ষড়যন্ত্র। কিন্তু আল্লামা মামুনুল হক ছিলেন কুফর-ফ্যাসিবাদের সামনে এক অবিচল মিনার। তিনি মাথা নত করেননি, নীতিতে আপোষ করেননি।
“হয়ত খেলাফত নয়ত শাহাদাত”: কারামুক্তির পর ঘোষণা
বিপুল জনচাপ ও জাগরণের মুখে সরকার বাধ্য হয় তাঁকে মুক্তি দিতে। মুক্তির পর তিনি ইতিহাস গড়া বক্তব্য দেন—
“আমার লক্ষ্য একটাই—খেলাফত কায়েম না হওয়া পর্যন্ত থামবো না। হয়ত খেলাফত, নয়ত শাহাদাত।”
এই ঘোষণা কেবল এক রাজনীতিবিদের উচ্চারণ ছিল না, এটি ছিল এক ইমানদার নেতার আত্মপ্রত্যয়।
জুলাই বিপ্লব ও জনগণের ভালোবাসা
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল ইসলামপন্থীদের আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই বিপ্লবের পেছনে আল্লামা মামুনুল হকের ত্যাগ ও প্রেরণাই ছিল চালিকাশক্তি। বিপ্লবের পর তিনিই হয়ে ওঠেন ইসলামপ্রিয় জনগণের সবচেয়ে আস্থাভাজন নেতা। তাঁর প্রকাশ্য উপস্থিতি, সাহসী বক্তৃতা এবং কর্মসূচি দেশের রাজনীতিতে নতুন গতি এনে দেয়।
দেশ গঠনে নিরবিচার সংগ্রাম
বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে তিনি নতুন এক স্বপ্নের বীজ বুনেছেন—ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তবায়ন। তিনি চান এক নিরাপদ, ন্যায়ভিত্তিক ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ, যেখানে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, ইসলাম থাকবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। এলক্ষ্যে তিনি অবিরাম ছুটে চলেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত৷
জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে উঠে আসা আল্লামা মামুনুল হক আজ কেবল একজন নেতা নন—তিনি এক প্রতীক, এক প্রেরণা। তাঁর সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি পর্ব নতুন প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা।
দেশ যখন নেতৃত্ব সংকটে, তখন মামুনুল হকের মত একজন আপসহীন, প্রজ্ঞাবান, সাহসী এবং ঈমানদার নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ খুঁজে পাচ্ছে নতুন দিকনির্দেশনা।
কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে আলোর রাজপথে এটাই গণমানুষের নেতা আল্লামা মামুনুল হকের ইতিহাস।