02/06/2024
৭২টি ভ্রান্ত দলের সবাই-ই আল্লাহর দাওয়াত দিবে। তাহলে পার্থক্য কোথায়? চিনবেন কিভাবে?
---------------
ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক, হযরত আলী কাররামাল্লাহ ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম কে যিনি হত্যা করেছে। তাকে যখন শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল অঙ্গ প্রতঙ্গ কেটে ফেলে, তখন সে বলতেছিল যে, আমার জিহ্বা তোমরা কেটে দিও না, কারণ এই জিহ্বা দিয়ে আমি মহান রবের জিকির করি।
কি মনে হয় আপনাদের এই ঘটনা শুনে??? মনে হচ্ছে না যে, আহা কত মুত্তাকি, পরহেজগার। অথচ এই ব্যক্তি-ই হচ্ছেন ওই ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর শেষ হতে কিয়ামাত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইজন মানুষ সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলেছিলেন। এই ব্যক্তি একজন, আরেজন হচ্ছে হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম এর উট হত্যাকারী।
----------------
স্বাভাবিকভাবে আমরা নিকৃষ্ট মানুষ বলতে অনেকেই অনেক কিছু মনে করি। সন্ত্রাসী, খুনি, ব্যাভিচারী, সুদখোর, মদখোর, জালিম বাদশাহ ইত্যাদী। কিন্তু দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিও মহান রবের জিকিরে মশগুল থাকতো। তাহলে আপনি কিভাবে চিনবেন হক্ব আর বাতিল???
এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাতায় হাজারো বার উল্লেখিত হয়েছে। কেউ মহান রবের জিকির করতে করতে ফানা হয়ে গেলেও সে সর্বোত্তম হতে পারে না, সে হক্ব হতে পারে না, সে সঠিক ব্যক্তি হতে পারে না। এই হাদীস এবং এই ঘটনাই এটার সবচেয়ে মজবুত দলীল। তাহলে হক্ব কিভাবে চিনবেন? বুঝবেন কিভাবে হক্ব কোনটা আর বাতিল কোনটা?
—--------------
আরেকটা ঘটনা বলি, এই ঘটনাটা অনেকগুলো হাদীসে এসেছে। সবগুলো হাদীসই গ্রহণযোগ্য সনদের হাদীস। হাদীসগুলো বেশ লম্বা লম্বা। হাদীসের মুলভাষ্য আমার ভাষায় তুলে ধরলাম:
”নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীর পাশে সাহাবীদেরকে নিয়ে অবস্থান করতেছিলেন। এমন সময় তামিমী গোত্রের এক লোক আসলো। তিনি কাউকে সালাম দিল না। মজলিসে তিনি নবীজির দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালো, এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সাহাবীদের দিকেও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালো। ওই লোক মুখে তাসবীহ পড়তে ছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এমন ভাব-সাব দেখে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি একথা মনে মনে ভাবছো যে, এই মজলিসে তোমার চেয়ে উত্তম কেউ নেই? তখন লোকটি বলল হ্যা, আমি এমনটাই ভাবছি। (অথচ সেই মজলিসে স্বয়ং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত রয়েছেন)।
লোকটি একথা বলে মসজিদে নববীতে গেল। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করলেন, কে আছো এই লোককে হত্যা করবে? তখন হযরত আবু বক্বর সিদ্দীক রদিয়াল্লাহু আনহু বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি তাকে হত্যা করবো। তখন সিদ্দীকে আকবার রদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে গিয়ে দেখলেন লোকটি রুকু অবস্থায় আছে। এটা দেখে তিনি চলে আসলেন, আর বললেন ইয়া রাসূলুল্লাহ তিনি নামাজে রুকু অবস্থায় ছিল। তাই আমি তাকে হত্যা করতে ইতস্তত করে ফিরে আসলাম। যিনি আল্লাহকে রুকু দেয়, তাকে কিভাবে হত্যা করবো?
তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার ঘোষণা করলেন, কে আছো তাকে হত্যা করবে? তখন হযরত ওমর রদিয়াল্লাহু আনহু গেলেন, তিনি গিয়ে তাকে সিজদা অবস্থায় দেখে ফিরে আসলেন। এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে হযরত ওসমান ও হযরত আলী রদিয়াল্লাহু আনহুমা গেলেন। হযরত আলী রদিয়াল্লাহ আনহু গিয়ে তাকে আর পায়নি। তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই খবর দেওয়ার পরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই লোককে যদি হত্যা করা হতো, তাহলে ফেৎনার দরজা কিয়ামাত পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেত। এই লোক থেকেই ফিৎনা বের হবে। ”
—-------------------
>> ওই লোক মুসলিম, সে আল্লাহর ইবাদত করে, জিকির করে, নামাজ আদায় করে, রুকু সিজদা করে। কিন্তু সে হক্বের উপরে ছিল না। এমনকি তার থেকেই ৭২ ফিরকার উৎপত্তি। তার মধ্যে কিসের অভাব ছিল?
তার মধ্যে নবী প্রেম ছিল না, নবীজির প্রতি সম্মান ছিল না, নবীজির মজলিসে কিভাবে আদব রক্ষা করতে হয়, নবীজিকে কিভাবে তাজীম করতে হয়, সেটা সে অবজ্ঞা করেছিল। কেননা, সে নবীজির মজলিসে সালাম বিহীন অবস্থায় প্রবেশ করেছিল এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহ সকল সাহাবীগণের প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সে নিজেকে নবীজির চেয়ে, সাহাবীদের চেয়ে বড় মনে করেছিল আমলের অহংকারের কারণে। যার জন্য এই লোক থেকেই ফিৎনার উৎপত্তি হয়েছিল।
—-----------------
একবার এক সাহাবী এবং ইহুদীর মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ দেখা দিল। তারা নবীজির কাছে এসেছিল বিচারের জন্য। নবীজি সব শুনে ইহুদীর পক্ষে রায় দিলেন। তখন ওই সাহাবী নবীজির রায় মেনে নেয়নি। সে আবার ইহুদীকে নিয়ে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রদিয়াল্লাহু আনহু এর কাছে গিয়েছিল। ওমর রদিয়াল্লাহু আনহু বিস্তারিত শুনে ওই সাহাবী নামের মুনাফিককে তরবারী দিয়ে দুই টুকরো করেছিল।
তখন অন্যান্য মুনাফিক সাহাবী নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে হযরত ওমর রদিয়াল্লাহু আনহু এর নামে বিচার দিয়ে সমালোচনা শুরু করেছিল। তখন মহান রাব্বুল আলামীন নবীজির শানে বেয়াদবদের পরিণতি এবং হযরত ওমর রদিয়াল্লাহু আনহু এর সিন্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে আয়াত নাযিল করেছিলেন।
—-----------------
আরো বেশ কয়েকটি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, এক যুদ্ধের পরে নবীজি গণিমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তখন একজন সাহাবী বলে উঠলো ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইনসাফ করুন। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তো ইনসাফ করার জন্যই এসেছি। আমি ইনসাফ না করলে, কে করবে? তোমার যা প্রাপ্য আমি তা-ই তোমাকে দিয়েছি। তখন ওই মুনাফিক তা মানলো না। সে ছিল তামিমী গোত্রের। হযরত ওমর রদিয়াল্লাহু আনহু এটা দেখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে অনুমতি চাইলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমাকে অনুমতি দিন। আমি এই মুনাফিককে দু টুকরো করে ফেলবো। তখন নবীজি বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। তার থেকে ফেৎনা বের হবে।
—-----------------
সুপ্রিয় পাঠক ! ওই লোক সাহাবী ছিল (মুনাফিক) সে যুদ্ধ করেছে। সে সালাত আদায় করতো, নামাজ পড়তো, এমনকি যুদ্ধও করেছে। অথচ নবীজিকে কিভাবে সম্মান করতে হয়, তা জানতো না। নবীজির সাথে বেয়াদবির দরুন, তার থেকে পরবর্তিতে ফেৎনা বের হয়েছে।
>> তার মানে, হক্ব ও বাতিল চিনতে হলে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত দিয়ে আপনি হক্ব ও বাতিল যাচাই করতে পারবেন না। হক্ব চিনতে হলে আপনাকে দেখতে হবে যে, কারা নবীজির প্রতি তাজীম করে, কারা নবীজিকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দেয়, কারা নবীজির পরিবারকে ভালবাসে, কারা নবীজির মদীনা শরীফকে ভালবাসে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, শুধু ঈমানদারগণ-ই মদীনা এবং মদীনা বাসীকে ভালবাসবে। বর্তমানে এমন অনেক স্কলার নামের ওয়াজ ব্যাবসায়ী, পেট পূজারীদের দেখা যায়, যারা নবীজির প্রতি দুরুদ ও সালাম পেশ করার বিভিন্ন পদ্ধতির উপরে বিদআত-শিরকের ফতোয়া লাগায়। মসজিদে নববীতে যাওয়াকে তারা হজ্বের অংশ হিসেবে দেখে না। মদীনা শরীফে নাকি দোয়া কবুলের স্থান নাই। তাদের সামনে নবীজির বিভিন্ন শান-মান বর্ণনা করলে, তারা সেটাকে সহ্য করতে পারে না। তারা সেটাকে শুধু মুজেযা বলেই উড়িয়ে দেয়।
সেদিন এক এরাবিক টকশোর ভিডিও দেখলাম, সেখানে কিং সাউদের একজন প্রফেসর বলতেছে যে, নবীজির ভুল হতে পারে কারণ তিনি বাশার। আর মানুষ মাত্রই ভুল করবে। কিন্তু যখন তাকে প্রশ্ন করা হল যে, ইবনে তাইমিয়া কী ভুল করেছে কিনা? সে বললো, ইবনে তাইমিয়া কিভাবে ভুল করবে, কারণ তার প্রত্যেকটি কথাই কুরআন ও হাদীসের দলীল সমৃদ্ধ। ভুল হলে হাদীসের বা কুরআনের থাকবে। ইবনে তাইমিয়ার ভুল হয়নি।
—-------------------
সুতরাং হক্ব চিনতে হলে, আপনাকে দেখতে হবে কারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাজীম করে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে তাজীম করে। যেমন তার জুতা মুবারক, ঘাম মুবারক, পশম মুবারক, থুতু মুবারক, চুল মুবারক, কদম মুবারক। কারা নবীজির প্রশংসার আলোচনা করে, কারা নবীজির প্রতিটি জিনিসের বরকতের কথা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চায়। সেটা আপনাকে দেখতে হবে।
মনে রাখবেন, আমল দিয়ে, ভাল কথা দিয়ে, কুরআনের বাক্য দিয়ে, হাদীসের দলীল দিয়ে, বাহ্যিক জিকির দেখে, বাহ্যিক মিষ্ট কথা দেখে, আপনি কখনোই হক্ব চিনতে পারবেন না। মহান আল্লাহ তায়ালা মেধার হিসাব নিবেন। সময় থাকতে মেধাকে কাজে লাগান। আল্লাহ সহায় হোক।
—-----------
মাআসসালাম
মাওঃ তাহমিদ হাসান