24/10/2025
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।
আসলেই কি দাসপ্রথার অবসান হয়েছে?
না।
নতুন এক ধরনের দাসে ভরে গেছে দুনিয়া- ডিজিটাল দাস।
আমরা প্রায় সবাইই নিজের হাতে থাকা স্মার্টফোনের দাসে পরিণত হয়েছি।
ঘুম থেকে ওঠার পর এবং ঘুমিয়ে পড়ার আগে- প্রায় ৯০% সময় আমাদের মনোযোগ থাকে হাতের ফোনের দিকে।
ফেইসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, বিভিন্ন গেইম- এরকম অসংখ্য অ্যাপ দিয়ে ভরা আমাদের ফোন। আমরা বুঁদ হয়ে থাকি সেইসব অ্যাপ এর ফাঁদে।
অজান্তেই আমরা কখনো মার্ক জাকারবার্গের, কখনো গুগলের মালিকদের, কখনো জেফ বেজোসের, কখনো এলন মাস্কের, কখনো অন্য কারো দাসত্ব করছি; তাও আবার স্বেচ্ছায়, হাসিমুখে।
আমাদের ফোনের অ্যাপ আমাদের সময় কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের প্রাইভেসি কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে৷ আবার আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রিও করছে!
আপনি ফোনে যেসব অ্যাপ ব্যবহার করেন, সেগুলো মাঝেমধ্যেই নানা রকম পারমিশন চায়। কখনো লোকেশন একসেস করার, কখনো ফোনবুক একসেস করার, কখনো নোটিফিকেশন পাঠানোর, কখনো ছবি এবং ভিডিও দেখার, কখনো মাইক্রোফোন ব্যবহার করার, আবার কখনও ক্যামেরা ব্যবহার করার।
অ্যাপ যখন কোনো পারমিশন চায়, তখন আমরা একটুও না ভেবে পারমিশন দিয়ে দিই। আমাদের এতো তাড়া যে, কেনো পারমিশন চাইছে, এটা দিলে কী কনসিকোয়েন্স হতে পারে- এসব ভাবার ফুসরত ই নাই!
ছবিতে দেখুন, আমি গুগলি মামীকে কী কী পারমিশন দিয়ে রেখেছি...
ক্যামেরা, কন্ট্যাক্টস, লোকেশন, মাইক্রোফোন, ফোন, ফটোজ এন্ড ভিডিওজ, এসএমএস, নোটিফিকেশন, নিয়ারবাই ডিভাইজেজ- সব।
এখন, আমার সবকিছু দেখার, শোনার অধিকার আছে আমার গুগল অ্যাপ এর। আল্লাহর পরে, আমার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানে গুগল অ্যাপ!
এমনকি, আমার অন্য সব অ্যাপ আর ওয়েবসাইট একসেস এর পাসওয়ার্ড ও জানে গুগল।
গুগল আমার ছবি সেইভ করে রাখে ফটোজ এ। আমি আমার সব গুরুত্বপূর্ণ ডকস সেইভ করে রাখি গুগল ড্রাইভ এ।
আমার হাতের আঙুলের ছাপ, আমার রেটিনার ছবি, আমি কতোটুকু প্রেসার দিয়ে ফোনে চাপ দিই, আমার অভ্যাস, আমার খাদ্যাভ্যাস, আমার প্যাশন- সব জানে গুগল।
আমি কী কথা বলি, কোথায় যাই, কী গপ্পো করি, কী অ্যাপ ব্যবহার করি, কোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করি, কী কেনাকাটা করি, কী স্বপ্ন দেখি, কী খরচ করি, কোথায় টাকা জমাই- সব জানে গুগল। সব মানে সব!
গুগল যদি এই সব তথ্য জেনে সেগুলো গোপন রাখতো, তাও হতো!
গুগল দুনিয়ার তাবত মানুষের সব তথ্য জোগাড় করে সেগুলো বিশ্লেষণ করে। তারপর, প্রয়োজনমতো সেগুলো কাজে লাগায়, বিক্রি করে।
এই তথ্য ব্যবহার করে আপনাকে, আপনার চিন্তার ডাইমেনশনকে নিয়ন্ত্রণ করে গুগল!
শুধুমাত্র গুগলই যদি এরকম তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং ব্যবহার করতো, তাও হতো!
স্যাডলি, দুনিয়ার অনেক কোম্পানি ই আমার- আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও বিপণন করে। এপল, এমাজন, আলীবাবা, ফেইসবুক- কেউ কারও চেয়ে কম নয় এই কাজে।
এই তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেই আপনি যখন যা ভাবেন, সেটাই আপনাকে দেখায় ডিজিটাল দুনিয়া।
আপনি একটা জুতা কেনার কথা বলেছেন আপনার বউকে। কতোক্ষণ পরে দেখবেন, আপনাকে জুতার বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করবে আপনার ফোনের বিভিন্ন অ্যাপ!
আপনি কক্সবাজার গেছেন, আপনাকে কক্সবাজারের স্পা কিংবা সেখানকার রেস্টুরেন্টের খাবারের এর বিজ্ঞাপন দেখাবে আপনার ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক!
আপনার ডিভাইস শুধু যে আপনার কথা শোনে আর আপনার ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করে, সেটা হলেও হতো!
আপনার রেটিনার মুভমেন্টও দেখে ফেলে আপনার ফোন! আপনি যখন ফোন স্ক্রল করতে করতে কোনো পেইজ কিংবা কন্টেন্ট এ একটু চোখ স্থির করেন, সে বুঝে যায়, এতে আপনার আগ্রহ আছে। সেই পেইজ কিংবা কন্টেন্ট আপনি লাইক দেন আর না দেন, আপনাকে এরপরে সেটা আবার দেখাবে।
আপনি খেয়াল করেছেন কি না, আপনি যা দেখেন কিংবা দেখতে চান, আপনাকে সেটাই বেশি দেখায় আপনার ফেইসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, ইমু, মেসেঞ্জার কিংবা অন্য অ্যাপ।
আপনি মাছের ভিডিও পছন্দ করেন, আপনাকে শুধু মাছের ভিডিও ই দেখাবে। আপনি গাছ দেখতে পছন্দ করেন, আপনাকে শুধু গাছ এবং গাছের ভিডিও ই দেখাবে। আপনি তামান্না ভাটিয়ার নাচ দেখতে পছন্দ করেন- আপনাকে ভাটিয়ার দেহের সব ভাঁজ দেখিয়েই ছাড়বে!
আপনাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আপনার ফোন, আরও স্পেসিফিক্যালি আপনার ফোনের বিভিন্ন অ্যাপ।
মানুষের চিন্তাশক্তি, ধীশক্তি নষ্ট করে দেবার জন্য আবিষ্কার হয়েছে রিলস আর শর্টস। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এইসব ভিডিও দেখে আমাদের মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে যায়। মগজ তরল হয়ে যায়। এই উত্তেজনা আমাদের আবিষ্ট করে রাখে৷ আমরা শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু সেগুলোই ভাবি, যা ইউটিউব-ফেইসবুক আমাদের ভাবাতে চায়।
এই ডিজিটাল দাসত্ব দিনদিন বাড়ছে। আমাদের আর মুক্তি নাই।