11/04/2025
৯২.সূরা আল লাইল | سورة الليل| Surah Lail আয়াত সংখ্যা : ২১, রুকু সংখ্যা : ১, শব্দ সংখ্যা : ৭১, অক্ষর সংখ্যা : ৩২০। সূরা লাইল এর শানে নুযুল
হযরত বেলাল রা. মক্কার মুশরিক উমাইয়া ইবনে খালফের গোলাম ছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার অপরাধে উমাইয়া তাঁকে প্রচণ্ড রৌদ্রের সময় পাথর ভূমিতে চিত করে শোয়ায়ে তার বুকের ওপর পাথর দিয়ে রাখল। আর সে বলত, যদি তুমি ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ না করো । মৃত্যু না হওয়া পযর্ন্ত তোমাকে এভাবে শাস্তি ভোগ করতেই হবে। হযরত বেলাল রা. এই কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হওয়ার পরেও বলতেন আহাদ আহাদ। (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) একবার রাসূল স. তাঁর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, এই এক আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবেন।
তারপর তিনি আবু বকর রা.-কে বললেন, হে আবু বকর! বেলালকে আল্লাহর একত্ববাদের কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। রাসূল স. কী বোঝাতে চাইলেন, আবু বকর রা. তা বুঝে গেলেন। তিনি বাড়িতে গিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ নিয়ে উমাইয়ার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি কি বেলালকে বিক্রি করবে? উমাইয়া রাজি হলে তাঁকে ক্রয় করে তিনি আযাদ করে দিলেন। তখন মুশরিকরা বলতে শুরু করল যে, আবু বকরের ওপর বেলালের কোনো অনুগ্রহ ছিল বিধায় সে তাকে মুক্ত করেছে। এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা হযরত আবু বকর রা.-এর প্রশংসায় ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১-এই পাঁচটি আয়াত নাযিল করেছেন।
সূরা লাইল এর তাফসীর
আয়াত-১.
শপথ রাতের, যখন সে অন্ধকার দ্বারা পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে। অর্থাৎ যখন চুতুর্দিকে অন্ধকার ছেয়ে যায়।
আয়াত-২.
শপথ দিনের, যখন সে সূর্যের আলো দ্বারা প্রকাশ পায় ও আলোকিত হয়। রাত-দিনের শপথ করার কারণ হলো, এ দুটি আল্লাহ তা’আলার বড় নিদর্শন । তিনি রাত সৃষ্টি করেছেন, মানুষ যেন দিনের বেলায় পরিশ্রম করে ক্লান্ত হওয়ার পর ঘুমিয়ে প্রশান্তি লাভ করতে পারে। আর দিন সৃষ্টি করেছেন মানুষের জীবিকা উপার্জনের জন্য।
আয়াত-৩.
এবং শপথ তাঁর, যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ তিনি হযরত আদম আ.-কে পুরুষ ও মা হাওয়া আ.-কে নারী আকারে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁদের সন্তানাদির মধ্যেও পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করেছেন । এমনকি তিনি প্রতিটি প্রাণিজগতে নর ও নারী আকারে সৃষ্টি করেছেন। উল্লিখিত তিনটি শপথ করার পর আল্লাহ তা’আলা বলেন,
আয়াত-৪.
নিশ্চয়ই তোমাদের আমলসমূহ বিভিন্ন ধরনের। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে কোনো না কোনো কাজের জন্য প্রচেষ্টা করে। কেউ ঈমান আনার পর নেক আমল করে জান্নাতের অধিকারী হচ্ছে। কেউ কুফরী ও পাপকর্ম করে জাহান্নামের পথে ছুটছে। আবার কেউ বা ঈমান আনার পরও পাপকর্ম করে জাহান্নামের উপযুক্ত হচ্ছে। রাসূল স. বলেন, প্রত্যেক মানুষ সকাল বেলায় নিজেকে কোনো কাজে নিয়োজিত করে। কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে নিজেকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্ত করে। আবার কেউ আল্লাহর আনুগত্য না করে নিজেকে ধ্বংস করে। (সহীহ মুসলিম-২২৩)
আয়াত-৫.
কুরআন কর্মপ্রচেষ্টার দিক দিয়ে মানুষদের দুই দলে বিভক্ত করেছে। অতঃপর প্রত্যেক দলের বিশেষণ বর্ণনা করেছেন। প্রথমে সফলকাম দলের তিনটি বিশেষণ বর্ণনা করেছেন। তা হলো, فَأَمَّا مَنْ أَعْطى وَاتَّقَى وَصَدَّقَ بِالْحُسُلى
১. যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে অর্থ দান করে তথা যাকাত ও আবশ্যকীয় দান আদায় করে ও নেক কাজে সম্পদ ব্যয় করে।
২. এবং খোদাভীরু হয় বা সর্ব ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে।
৩. উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে বা সকল ক্ষেত্রে তাঁর আদেশ ও নিষেধ পালন করে।
আয়াত-৬.
এবং উত্তম বিষয়কে বিশ্বাস করে । অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা, রাসূল সা. ও জান্নাতকে বিশ্বাস করে এবং ঈমানের অন্য বিষয়গুলোকে বিশ্বাস করে।
আয়াত-৭.
যাদের মধ্যে উপরোক্ত সফলকাম দলের তিনটি বিশেষণ পাওয়া যাবে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার জন্য নেক কাজ সহজ করে দেব।’ ফলে নেক আমল করতে তার কাছে আনন্দ ও ভালো লাগবে। কোনো অলসতা আসবে না এবং কঠিন মনে হবে না; বরং গুনাহের কাজ করতে তার কষ্ট লাগবে। পরকালে তাকে অত্যন্ত সহজ ও সম্মানের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করাব।
আয়াত-৮. ৯
দ্বিতীয়ত ব্যর্থ দলের তিনটি বিশেষণ সম্পর্কে কুরআন বলছে, فَأَمَّا مَنْ أَعْطى وَاتَّقَى وَصَدَّقَ بِالْحُسُلى
১. আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে কৃপণতা করে তথা যাকাত ও আবশ্যকীয়
দান আদায় করে না।
২. এবং আল্লাহকে ভয় করার পরিবর্তে তাঁর প্রতি বিমুখ হয়।
৩. এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা, রাসূল স. ও জান্নাতকে অবিশ্বাস করে এবং ঈমানের অন্য বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে।
আয়াত-১০.
যার মধ্যে উল্লিখিত ব্যর্থ দলের তিনটি বিশেষণ পাওয়া যাবে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার জন্য গুনাহ ও জাহান্নামের কাজ সহজ করে দেব।’ ফলে সে এজাতীয় কাজই পছন্দ করবে এবং নেক কাজ তার কাছে কষ্টকর মনে হবে। পরিশেষে এসব আমল তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
আয়াত-১১.
যে সম্পদের আবশ্যকীয় হক দিতে এ হতভাগা কৃপণতা করত, সে সম্পদ তার ধ্বংস হওয়ার সময় তথা মৃত্যুর সময় কোনো কাজে আসবে না। মৃত্যুর পর যখন সে কবরের গর্তে পতিত হবে তারপর কিয়ামতের দিন জাহান্নামের গর্তে পড়বে, তখন এ সম্পদ তার কানো উপকারে আসবে না।
আয়াত-১২.
অবশ্যই আমার দায়িত্ব সবাইকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা। কোনটি হালাল, কোনটি হারাম এবং কোনটি নেকীর পথ ও কোনটি গুনাহের পথ-এ কথা সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব।
আয়াত-১৩.
আমি মালিক ইহকাল ও পরকালের। উভয় জগতে আমার একচ্ছত্র ক্ষমতা রয়েছে। আমি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারি। অতএব দুনিয়াতে কেউ আমার বিধান অমান্য করলে সে শাস্তি ভোগ করবে।
আয়াত-১৪.
আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত আগুন সম্পর্কে সতর্ক করছি। যেন তোমরা ঈমান ও নেক আমল করে তা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারো।
আয়াত-১৫.
এই জাহান্নামে শুধু নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই স্থায়ীভাবে দগ্ধ হবে।
আয়াত-১৬.
যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে এবং তাঁদের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরেয়ে নেয়। এরূপ অস্বীকারকারী ব্যক্তিকে কাফের বলা হয়। সে সবচেয়ে বড় হতভাগ্য। সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। কোনো মুমিন ব্যক্তি যদি পাপ করে তাহলে সেও হতভাগ্য হবে। তবে কাফেরের মতো নিতান্ত হতভাগ্য নয়। সে যদি তাওবা না করে অথবা কারো সুপারিশের বলে কিংবা আল্লাহর বিশেষ রহমতে যদি তাকে ক্ষমা না করা হয়, তাহলে সে জাহান্নামে যাবে এবং গুনাহের শাস্তি ভোগ করে ঈমানের কারণে এককালে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
আয়াত-১৭.
অধিক তাকওয়াসম্পন্ন (অত্যন্ত পরহেজগার) ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখা হবে। যে আল্লাহর ভয়ে কুফর ও গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখা হবে। তার গায়ে আগুনের বাতাসও লাগবে না। সকল তাফসীরবিদ বলেছেন, এখানে অত্যন্ত পরহেজগার ব্যক্তি দ্বারা আবু বকর রা.-কে উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রশংসায় এখান থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়েছে। তবে যারাই তাঁর মতো গুণাবলি অর্জন করবে তারাই আয়াতসমূহে বর্ণিত সুসংবাদের অধিকারী হবে।
আয়াত-১৮.
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা অধিক তাকওয়াসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয় উল্লেখ করে বলেন, যে আত্মশুদ্ধি ও গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার উদ্দেশ্যে নেক ও কল্যাণের পথে সম্পদ দান করে। পার্থিব কোনো স্বার্থ তার উদ্দেশ্য হয় না বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান করে।
আয়াত-১৯.
এই পরম পরহেজগার ব্যক্তির প্রতি কারো এমন কোনো অনুগ্রহ নেই, যার প্রতিদান হিসেবে তিনি সম্পদ দান করেন। কারো অনুগ্রহের প্রতিদান দেওয়ার উদ্দেশ্যে দান করেন না।
আয়াত-২০.
বরং তিনি শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ এবং পরকালে তাঁর সাক্ষাৎ লাভের প্রত্যাশায় সম্পদ দান করেন। কারো অনুগ্রহের প্রতিদান দেওয়া উত্তম। হযরত আবু বকর রা. বেলাল রা.সহ যেসব গোলামকে ক্রয় করে মুক্ত করেছিলেন, তাদের কারো কোনো সাবেক অনুগ্রহ তাঁর প্রতি ছিল না বরং إلا ابتغاء وجه ربه الأعلى আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত কিছুই ছিল না।
আয়াত-২১.
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে গোলাম আযাদ ও সম্পদ দান করে তার সম্পর্কে এ সূরায় সর্বশেষ আয়াতে মহান প্রভু ঘোষণা দেন ولسوف يرضى সে সত্বরই সন্তুষ্টি লাভ করবে; আল্লাহ তা’আলা পরকালে তাকে জান্নাত, কল্যাণ ও সম্মান দান করবেন। যেগুলো পেয়ে সে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। এই আয়াতটি হযরত আবু বকর রা.-এর জন্য একটি বিরাট সুসংবাদ। আল্লাহ তাঁকে সন্তুষ্ট করবেন, এ সংবাদ দুনিয়াতে তাঁকে প্রদান করা হয়েছে।