04/04/2025
দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত হিসেবে শোলাকিয়াকে গত কয়েক বছর ধরে চ্যালেঞ্জ করে আসছে অন্য একটি ময়দান। সেটির অবস্থান উত্তরের জেলা দিনাজপুরে।
জেলা শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত ময়দানটির আয়তন ২২ একর, যা শোলাকিয়া ময়দানের চেয়ে তিন গুণ বড়। জনবহুল এই দেশে এত বড় উন্মুক্ত মাঠ বিরল। সারা বছর সেখানে খেলাধুলা এবং নানা আয়োজন থাকে। তবে গত ৮ বছর ধরে এর পরিচিতি সারা দেশে।
২০১৭ সালে হঠাৎ করেই সেখানে বড় আকারের ঈদ জামাত আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়। নামাজ শেষে দাবি করা হয় সেই জামাতে মানুষ এসেছিল ছয় লাখ। আদৌ এত মানুষ হয়েছে কি না, তা গুনে দেখেনি কেউ। তবে তখন থেকে দাবি করা হচ্ছে, এত বড় জামাত দক্ষিণ এশিয়ায় আর হয় না। সেই বছর থেকে দেশের সবচেয়ে বড় জামাত নিয়ে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ও গোর এ শহীদ নিয়ে পাল্টাপাল্টি দাবি চলে আসছে।
১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর থেকেই ছোট পরিসরে এখানে ঈদের জামাত হয়ে আসছিল। তবে ২০১৫ সালে জেলা পরিষদের অর্থায়নে ঈদগাহ মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। শেষ হয় দুই বছর পর। তখন থেকেই বড় জামাত আয়োজনের এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। ব্যাপক প্রচারণাও চালানো হয়।
করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ বাদ দিয়ে প্রতি বছর বড় বড় জামাত হয়ে আসছে বিশেষ করে ঈদুল ফিতরে। দিনাজপুর শহর ছাড়াও আশেপাশের উপজেলা এবং পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওসহ প্রতিবেশী জেলা থেকেও মুসল্লিরা এই মাঠে নামাজ পড়তে আসেন।
সেখানে এত বড় ফাঁকা জায়গা কীভাবে হল, মাঠের নাম গোর-এ-শহীদই বা কেন রাখা হল, তা নিয়ে আছে নানা মত। বাংলায় এই নামের অর্থ দাঁড়ায় শহীদের কবর। কেউ ভাবতে পারেন, সেখানে যোদ্ধাদের কবর দেওয়া হতো। এই নামকরণের বিষয়ে লোকমুখে আছে বেশ কয়েকটি বর্ণনা। কেউ কেউ বলে থাকেন, ইরান থেকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন শাহ আমিরউদ্দিন ঘুরি নামে একজন। তিনি ঘোড়ায় চড়ে দিনাজপুরে ইসলাম প্রচার করেন।
মৃত্যুর পর তাকে সমাহিত করা হয় এই মাঠের পাশে একটি জায়গায়। সে জন্য এ মাঠের এমন নামকরণ, এ কথা বলে থাকেন অনেকে। এখনো সেখানে তার মাজার আছে।
নামকরণের আরেকটি বর্ণনা হল সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের আমলে ইসলাম প্রচার নিয়ে দিনাজপুরে ৪০ জন সুফির সঙ্গে ওই সময়ের এক হিন্দু রাজার যুদ্ধ হয়েছিল। সেই লড়াই প্রাণ হারান একজন সুফি। তাকে এই মাঠের পাশে কবর দেওয়া হয়। সে সময় বাংলায় মুসলিম শাসকের ভাষা ছিল ফারসি। ফারসিতে কবরকে বলা হয় গোর। আর যুদ্ধে প্রাণ হারানো শহীদকে কবর দেওয়া হয় যে মাঠে তার নাম হয় গোর-এ-শহীদ।
ময়দানটি ব্রিটিশ আমলে সামরিক কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই মাঠে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উত্তর ফ্রন্টের সমাবেশ হয়েছিল। পরে মাঠটি তাদের মালিকানায় নেওয়া হয়। এমনিতে সারা বছর এলাকার শিশু কিশোরদের খেলাধুলা ও অন্যান্য আয়োজন চলে এই মাঠে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম ভাবলেন, সেখানে বড় পরিসরে ঈদের জামাত হবে। এই ভেবেই সেখানে দৃষ্টিনন্দন ঈদগাহের মিনারটি তৈরি করা হয়। এটির বানানো হয়েছে মোগল স্থাপত্য রীতিতে।
এর মিম্বারের উচ্চতা ৫৫ ফুট। ৫২ গম্বুজের ঈদগাহ মিনারের দুই প্রান্তে দুটি মিনারের উচ্চতা ৬০ ফুট। মাঝের দুটির উচ্চতা ৫০ ফুট ও টাইলস করা মিম্বারের উচ্চতা ৪৭ ফুট। মসজিদে নববি, কুয়েত, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের স্থাপত্যশৈলীর আদলে তৈরি করা হয়েছে মিনারগুলো। ঈদগাহ মিনারটি নির্মিত হওয়ার পরই আসলে মাঠের গুরুত্ব বেড়েছে স্থানীয়দের কাছে।
প্রতিটি গম্বুজে রয়েছে বৈদ্যুতিক বাতি। সন্ধ্যার পর মিনারে নান্দনিক আলো জ্বালানো হয়। তাই সন্ধ্যায় গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দানটা একটু বেশিই সুন্দর লাগে। অনেক মানুষ বিকাল বা সন্ধ্যায় একটু মুক্ত হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতেও সেখানে গিয়ে সময় কাটায়।