04/06/2025
এক দশকের শেষ অধ্যায়।
সম্পর্কটা পারিবারিক পরিচিতি থেকেই শুরু, কিন্তু আমার ছাত্রজীবনের হিফজখানায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই জামিয়া ফয়জুর রহমান (রহ.) এর সাথে এক নতুন বন্ধনের সূচনা ঘটে। তখন থেকেই জা.ফ.র.-এর ছোট-বড় সব অনুষ্ঠান, কর্মসূচি, আয়োজন—সবকিছুর সাথেই আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে। সময়ের প্রবাহে সেই সম্পৃক্ততা শুধুমাত্র বাড়তেই থাকে, যেন দিন দিন তা দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। এই অন্তর্ভুক্তির প্রতিটি মুহূর্তই আমার জীবনে প্রশান্তির এক গভীর পরশ ছড়িয়ে দিয়েছে।
তবে, ০৩/০৬/২০২৫ ইংরেজি তারিখে এসে, দীর্ঘ এক দশকের পথচলার এক আবেগঘন পরিসমাপ্তি টানলাম। জা.ফ.র.-এর স্টেজে দাঁড়িয়ে আমার এই দীর্ঘ যাত্রার পর্দা নামিয়ে, দায়িত্বের ভার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সসম্মানে তুলে দিলাম।
বিদায়ের মুহূর্তটি ছিল এলোমেলো, অথচ হৃদয়স্পর্শী। আসাতিযায়ে কেরাম ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বিক্ষিপ্ত কথা বলেই আমি আমার দায়িত্বের গণ্ডি থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নতুনদের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দিলাম। কিন্তু ঠিক তখনই হৃদয়ের গভীর শূন্যতায় যে নামটা বারবার ভেসে উঠছিল, সে হচ্ছে 'রাকিব ভাই'। জীবনের এই স্মরণীয় অধ্যায়ের শেষে তাঁর অনুপস্থিতি এক অপূর্ণতার রেখা এঁকে দিল।
জামিয়ার সাথে আমার দায়িত্বশীল ভূমিকা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। মাহফিলের সাত বছর ও কাফেলার সাথে শেষ চার বছরের একান্ত সম্পৃক্ততা আমাকে অনেক কিছু শেখার, ভাবার, এবং করার সুযোগ এনে দেয়। এই জায়গাগুলোর উন্নয়নে যেভাবে আমি অংশ নিতে পেরেছি, আগের অনেক সিনিয়র ভাইয়াদের সেই সুযোগ হয়তো ছিল না। তবে একথা অকপটে স্বীকার করতেই হয়—যদি তারা আগে থেকেই পথ তৈরি না করে দিতেন, সহানুভূতিশীল পরামর্শ আর সাহস না দিতেন, তবে আমার পক্ষে এতটা এগিয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব হতো না।
এই পথে আমার পথপ্রদর্শক ছিলেন সম্মানিত উস্তাদ রফিকুল ইসলাম (ধোবাউড়া হুজুর) দা.বা. এবং আমার সম্মানিত মামা আবু দু’জানা (হাজী সাহেব হুজুর) দা.বা.। আর যাঁদের বড় ভাই হিসেবে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি, তারা হলেন: Monir Ashraf ভাই, Ashraf Ali ভাই, Masum Billah Toki ভাই, Farid Ahmad ভাই ও Nafis Imtiaz ভাই। তাঁদের অবদান, উৎসাহ ও ভালোবাসা—সবকিছুর ঋণ আমি আজীবন হৃদয়ে বহন করে যাব।
আমি চেয়েছি একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা শুরু করতে। এবং আল্লাহর অশেষ কৃপায় তা কিছুটা হলেও সম্ভব হয়েছে। আমার এই আকাঙ্ক্ষা—যারা আজ দায়িত্বে আছেন এবং যারা ভবিষ্যতে আসবেন, তারা যেন এই ধারাকে অব্যাহত রাখেন এবং আগের চেয়েও বড় কিছু করে দেখান। আমি আন্তরিকভাবে তাদের জন্য দোয়া করি—আল্লাহ যেন তাদেরকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার তাওফিক দান করেন। আমীন।
এবারের আয়োজন ছিল আমার ছাত্র ও দায়িত্বশীল হিসেবে শেষ আয়োজন। এটি বাস্তবায়িত হয়েছে বর্তমান কাফেলার সদস্যদের হাতে, আমার উপস্থিতিতে। ৪৬-৪৭ হিজরী শিক্ষাবর্ষে, জামিয়ার আসাতিযায়ে কেরামগণের দিকনির্দেশনায় পরিচালিত আল ফায়জ ছাত্র কাফেলার উদ্যোগে পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে আয়োজন করা হয় দুই দিনব্যাপী এক বিশাল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান।
এই প্রতিযোগিতা ছিল ১৫টি পর্বে বিভক্ত:
১. ক্বেরাত
২. বাংলা বক্তৃতা
৩. আরবি বক্তৃতা
৪. হিফজুল কুরআন (৩০ পারা)
৫. হিফজুল কুরআন (১০ পারা)
৬. শেরের বাহাস
৭. আরবি মুক্বালামা
৮. যেমন পারো তেমন বলো (নূরানী বিভাগ)
৯. হদর (নাযেরা বিভাগ)
১০. সুন্দর হস্তলিপি
১১. বিশুদ্ধ বানান চর্চা
১২. কুরবানির মাসায়েল (ইফতা বিভাগ)
১৩. প্রবন্ধ (বাংলা ও আরবি)
১৪. বাংলা কবিতা আবৃত্তি
১৫. হামদ ও নাত
জামিয়া প্রতি বছরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ, যোগ্য ও প্রতিভাবান করে গড়ে তুলতে এমন আয়োজন করে থাকে। এবছরও সেই ধারাবাহিকতায় আয়োজনটি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে এবারের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক বিষয় ছিল—আয়োজনের মানসিকতা ও গঠন ছিল অতুলনীয়ভাবে পরিপক্ব ও নান্দনিক। এই সৌন্দর্য ও সফলতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছেন কাফেলার বর্তমান সিনিয়র দায়িত্বশীল কাউসার আহমদ ভাই ও তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সহযোদ্ধারা।
মিষ্টি ও তিক্ত অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে আমার এই দশ বছরের শেষ আয়োজনও একটি চিরস্মরণীয় অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে।
সবশেষে, শোকর আলহামদুলিল্লাহ—এই দীর্ঘ পথচলায় যাঁরা ছিলেন, না থেকেও প্রেরণা দিয়েছেন, তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।
- M Azizul Haque Muaj
০৪/০৬/২০২৫ ইং___🖊️