
24/05/2025
খলিলুর রহমান: ধর্ষক যখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
২০০১ সালের আগস্ট। রাজধানীর নীলক্ষেতে বিসিএস প্রশাসন একাডেমির অফিসার্স কোয়ার্টারের তিস্তা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার প্রটোকল অফিসার আয়েশা আফসারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন স্বামী জহিরুল ইসলামের হাতে। নিজের লাইসেন্সকৃত ১২ বোর পিস্তল দিয়ে আয়েশাকে গুলি করে হত্যার পর জহিরুল একই অস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জহিরুল ইসলাম পেশায় ছিলেন রি-রোলিং ব্যবসায়ী ও সরকারি ঠিকাদার।
প্রথমদিকে ঘটনাটিকে পারিবারিক কলহ হিসেবে তুলে ধরা হলেও, পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে আরও ভয়াবহ সত্য। জানা যায়, আয়েশা আফসারী প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েরই আরেক প্রভাবশালী কর্মকর্তার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। নিউইয়র্কে পোস্টিংয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দিনের পর দিন ভোগ করা হয়। শেষ পর্যন্ত সেই কর্মকর্তার প্রভাবেই আয়েশার পোস্টিং হয় নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে।
ধর্ষক কে?
তথ্যপ্রমাণ ও সংবাদসূত্র অনুযায়ী, আয়েশা আফসারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমানের ভায়রাভাই খলিলুর রহমানের হাতে। তিনি তখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পিএস-১ (Personal Secretary-1) হিসেবে কর্মরত ছিলেন, অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টার একেবারে ঘনিষ্ঠ দাপ্তরিক সহকারী।
খলিলুর রহমান আয়েশাকে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে পোস্টিং করিয়ে দেন। তবে বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি। একই সময়ে খলিলুর রহমানের নিজেরও পোস্টিং হয় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে। অর্থাৎ, দুজনেরই কর্মস্থল নির্ধারিত হয় একই দেশে- যুক্তরাষ্ট্রে।
আয়েশার স্বামী জহিরুল ইসলাম তার স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। তবে নিউইয়র্কে একইসঙ্গে আয়েশা ও খলিলুর রহমানের পোস্টিং হওয়ার ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এই পারিবারিক সংকট এবং অপমানবোধই একসময় ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত হয়- যেখানে এক দম্পতির জীবন শেষ হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছায়ায় লুকিয়ে থাকা একটি লোলুপ দানবের অপরাধের দায়ে।
খলিলুর রহমানের পলায়ন
আয়েশা আফসারী হত্যাকাণ্ডের পর উপদেষ্টা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা দায় চাপান খলিলুর রহমানের ওপর, কারণ অফিসে আগে থেকেই জানা ছিল তার সঙ্গে আয়েশার পরকীয়ার সম্পর্ক।
ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে আসার পর তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান নিজের ভায়রাভাই খলিলুর রহমানকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। তাঁর ছত্রছায়ায় খলিলুর দেশ ছাড়েন, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আত্মগোপন করেন এবং নাম পাল্টে হন ‘রজার রহমান’। সেখানেই তিনি কাটান দীর্ঘ ২৩ বছর।
ছদ্মনামে গোপন জীবন
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালীন খলিলুর রহমান নিজের পরিচয় গোপন করে ‘রজার রহমান’ নামে বসবাস করতেন। পাবলিক রেকর্ড অনুযায়ী তিনি নিউ ইয়র্ক, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস ও মেরিল্যান্ড- এই চারটি রাজ্যে বিভিন্ন ঠিকানায় অবস্থান করেন। তার বসবাসের স্থানগুলোর মধ্যে ছিল:
• ২৯ ব্রেটন রোড, স্কারসডেল, নিউ ইয়র্ক
• ১ কুয়াকার লেন, গ্রিনউইচ, কানেকটিকাট
• ১৭ ক্লাইড রোড, ওয়াটারটাউন, ম্যাসাচুসেটস
• ৩৬ আলেকজান্দ্রিয়া ড্রাইভ, অক্সন হিল, মেরিল্যান্ড
এই ঠিকানাগুলোর তথ্য জনসংযোগ নথি, ভোটার রেকর্ড ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনপত্রে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
তিনি ‘রজার রহমান’ নামে একটি ফেসবুক প্রোফাইলও পরিচালনা করতেন, যেখানে স্ত্রী নুরুন নাহার রহমানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ছবি ও মন্তব্য পাওয়া যায়- যা তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে দেয়। ২০১৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, দাবি করেন তিনি বিএনপির সদস্য এবং দেশে ফিরলে তার প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে। অথচ এই আশ্রয়ের আবেদন ছিল মূলত নিজের অপরাধ আড়াল করার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্ষকের পুনর্বাসন?
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে ড. খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস- যার নিজের নৈতিকতা ও মানবিক দায় নিয়েও রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চ সুদের ফাঁদে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন হাজার হাজার হতদরিদ্র মানুষ; কেউ নিখোঁজ, কেউ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।
প্রশ্ন হলো, ড. ইউনূস কীভাবে একজন ধর্ষকের অতীত জেনেও তাকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে সংবেদনশীল পদে বসালেন? নাকি এই নিয়োগের পেছনেও রয়েছে কোনো আন্তর্জাতিক শক্তির সুচিন্তিত ষড়যন্ত্র?
বিচারহীনতার বাংলাদেশ
ড. খলিলুর রহমান বর্তমানে শুধু জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পাশাপাশি রোহিঙ্গা বিষয়ক পরামর্শকের ভূমিকাও পালন করছেন- যা নিছক নিয়োগ নয়, বরং একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘মানবিক করিডর’ উদ্যোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পুনঃপ্রবেশ ও নাগরিকত্ব প্রশ্নে পশ্চিমা চাপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইতোমধ্যে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বিনা বাধায় কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে যাওয়ার প্রস্তুতি, বিদেশি কোম্পানির শেয়ার বাজারে গোপন লিস্টিং এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে বিদেশি প্রভাব- সব মিলিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
তাহলে প্রশ্ন- খলিলুর রহমান কি আসলেই বাংলাদেশের উপদেষ্টা, না কি পশ্চিমা এজেন্ডার নিরব বাহক?
২৩ বছর যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপন, ‘রজার রহমান’ ছদ্মনামে বসবাস, তারপর হঠাৎ করেই ফিরে এসে নিরাপত্তা ও অভিবাসন নীতির নিয়ন্ত্রণ- এটা কি কাকতালীয়, না একটি নিখুঁত অপারেশন?
বাংলাদেশ কি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রিত এক সফট-স্টেটে? আর সেই অপারেশনের মুখপাত্র কি খলিলুর রহমান নিজেই?
ধর্ষকের বিচার চাই
আজ প্রয়োজন- একটি নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, পুরনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করা, এবং আয়েশা আফসারী হত্যার নেপথ্যে থাকা ধর্ষক খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিচার কার্যক্রম শুরু করা। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়—তা প্রমাণ করাই এখন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
ধর্ষক খলিলুর রহমানের বিচার চাই।