23/04/2025
📣🥰📣 সন্তানকে অভাব নয়,শিক্ষা দিন
অর্থবিত্ত থাকা সত্ত্বেও আমি আমার একমাত্র ছেলেকে কখনোই দশ টাকার বেশি টিফিন খরচ দেইনি। সে প্রায়ই তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলত, “বাবা, দেখো, ও কত ব্র্যান্ডেড ঘড়ি পরে এসেছে!” কিংবা, “বাবা, ওর ব্যাগটা কত সুন্দর, ইম্পোর্টেড।”
আমি শুধু হেসে মাথা নাড়াতাম।
তবে সে কখনোই এসব চায়নি।
একদিন হালকা পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। বলল, “বাবা, আজ তোমার অফিসের গাড়িতে করে স্কুলে নামিয়ে দেবে?”
আমি ওর কষ্ট বুঝে রাজি হলাম। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ ও আমার সঙ্গেই গেল।
একদিন দেখলাম, হাঁটতে আর ওর ইচ্ছে করছে না। আমি আগেই বলে দিলাম—
“অফিসিয়াল জিনিস ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যায় না। স্কুল মাত্র দশ মিনিটের পথ। একটু আগে বেরোলে হেঁটেই যাওয়া যাবে।”
ওর মন খারাপ হয়ে গেল। স্ত্রীও অভিমান করল, "এমন করলে কেনো?"
আমার জবাব ছিল না।
সেদিন সন্ধ্যায় ছেলে বলল, “বাবা, জানো? আমার এক বন্ধু শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমিও...”
আমি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, বলো তো—স্কুল ভালো হয়, না ছাত্র?”
"ধরো, আমি তোমাকে ওই স্কুলে দিলাম। তুমি যদি ফেল করো, তখন কি বলবো—তুমি ফেল করেছো, না স্কুল?”
সে মাথা নিচু করে বলল, “বুঝেছি, বাবা।”
আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, “তোমার ক্লাসে আজ পর্যন্ত কেউ তোমাকে টপকাতে পারেনি। তুমি ফার্স্ট বয়। তুমি যেখানে যাবে, সেখানেই সেরা হবে।”
ও আর কোনোদিন সেই কথা বলেনি।
এক বিকেলে বলল, “বাবা, একজন এক্সট্রা টিউটর দরকার। ম্যাথ আর ইংলিশে একটু সমস্যা হচ্ছে।”
আমি বললাম, “বাবা, একটু কষ্ট করতে হবে। আমি যখন রাত ৯টা-১০টায় বাড়ি ফিরবো, তখন আমার কাছেই পড়তে হবে।”
ছেলে বলল, “তুমি তো ক্লান্ত থাকো, বাবা।”
আমি হেসে বললাম, “আমার সামর্থ্য নেই আলাদা টিচার রাখার। বরং আমি কষ্ট করবো। কি বলো?”
সে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো দশটা টিউটর রাখতে পারো। তাহলে এমন করো কেনো?”
আমি বললাম, “আমি চাই, ও বুঝুক—আরামে কিছু পাওয়া যায় না। অভাব আসলে কীভাবে লড়াই করতে হয়, সেটা শিখুক।”
তিনি চুপ হয়ে গেলেন।
আমার ছেলে আর আমি মাঝে মাঝে ফুটপাতে হাঁটি। পথশিশু, দরিদ্র মানুষ—ওকে দেখাই। বলি, “পৃথিবী ভাবনায় যতটা সুন্দর, বাস্তবে ততটাই কঠিন।”
আমি কখনো চাওয়া মাত্র কিছু দেইনি।
একদিন ও বলল, “বাবা, তুমি এমন কেনো?”
আমি বলেছিলাম, “সময় হলে বুঝবে।”
দু-তিন দিন আগে ইলিশ আর মাংস-পোলাও খেতে চাইল।
বললাম, “টাকা কম। তোমার কাছে কিছু আছে?”
ও পঞ্চাশটি দশ টাকার নোট বের করল। আমি অবাক!
বলল, “না বাবা, খরচ করিনি। আমার এক বন্ধু স্কুলে না খেয়ে আসে। মা যা দেন, তা আমার যথেষ্ট। কিছু মানুষ সামান্যটাও পায় না। তাই টাকা জমাই।”
আমি তাকিয়ে রইলাম। তারপর ইলিশ কিনে নিয়ে এলাম। তাকে ইলিশ আর মাংস পোলাও খাওয়ালাম।
ইচ্ছে করেই অভাব দেখাই, যাতে জীবনটা বোঝে।
ঈদের সময় মার্কেটে গিয়ে বললাম, “সাধ্যের মধ্যে নিও।”
সে শুধু একটা প্যান্ট নিল। বলল, “তোমার জন্য পাঞ্জাবি, মায়ের জন্য শাড়ি নিয়েছি।”
আমি হেসে উঠলাম। সে শিখে ফেলেছে টাকা খরচের মূল্য।
একদিন বলল, “বাবা, সায়নটা মানুষ হলো না, অথচ তার বাবা যা চেয়েছে সবই দিয়েছে।”
আমি বললাম, “আমি কি তোমাকে কিছু দেইনি?”
সে মাথা রেখে বলল, “তুমি যা দিয়েছো, তা সবার ওপরে। তুমি শিখিয়েছো, অভাবে যেন চরিত্র নষ্ট না হয়। তুমি শিখিয়েছো, কীভাবে অভাবকে ভালোবাসতে হয়। তুমি ছাড়া তোমার কিছু নেই, এটা জানি। আর বাকিটা আমাকে গড়ে নিতে হবে।”
“আমি জানি আমি কে, তাই সাধারণ জামাকাপড়েও হীনমন্যতায় ভুগি না, বাবা।”
তার কথা শুনে আমি নিশ্চিন্ত।
কয়েক বছর পর নিজের রোজগারে প্রাইভেট কার কিনল।
হাসতে হাসতে বলল, “পাঁচ বছরে টিফিন আর বোনাসের টাকা জমিয়েছি।”
তখন বুঝলাম, আমার ছেলে শুধু সঞ্চয়ী নয়, মানুষও হয়েছে।
এক সপ্তাহ পর আমি সব সম্পত্তি ওর নামে লিখে দিলাম।
সে দলিল ফেরত দিয়ে বলল, “তোমরা পাশে থাকো, আর কিছু লাগবে না।”
আমি স্ত্রী নীলিমাকে বললাম, “দেখেছো, আমি ভুল করিনি। আমি আমার ছেলেকে মানুষ বানাতে গিয়ে বাবার দেওয়া জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাই দিয়েছি। আমি ওকে শিখিয়েছি, অভাবে যেন মাথা নিচু না হয় বরং আরো শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হয়।”