30/05/2025
মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ, ডাক নাম গালিব (গালিব অর্থ সর্বোচ্চ) এবং (পূর্বের ডাক নাম) আসাদ অর্থ সিংহ (ডিসেম্বর ২৭, ১৭৯৭ — ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৮৬৯) ভারতবর্ষে মোঘল-সম্রাজ্যের শেষ ও ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের একজন উর্দু এবং ফার্সি ভাষার কবি। সাহিত্যে তার অনন্য অবদানের জন্য তাকে দাবির-উল-মালিক ও নাজিম-উদ-দৌলা উপাধি দেওয়া হয়।
তার সময়কালে ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য তার ঔজ্জ্বল্য হারায় এবং শেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা পুরোপুরিভাবে মোঘলদের ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করে, তিনি তার লেখায় এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মহাবিদ্রোহের সময়কার তার লেখা সেই দিনলিপির নাম দাস্তাম্বু। তিনি জীবনকালে বেশ কয়েকটি গজল রচনা করেছিলেন যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জন বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন ও গেয়েছেন। তাকে মোঘল সম্রাজ্যের সর্বশেষ কবি হিসেবে ও দক্ষিণ এশিয়ায় তাকে উর্দু ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বলে মনে করা হয়। আজ শুধু ভারত বা পাকিস্তানে নয় সারা বিশ্বেই গালিবের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
“হাতের তালুর রেখায় ভাগ্য দেখতে যেও না গালিব, ভাগ্য তাদেরও আছে যাদের হাত নেই।"
- মির্জা গালিব।
খুব সম্ভবত ভারতের ইতিহাসে মির্জা গালিবের মতো প্রভাবশালী কবি দ্বিতীয়টি নেই। তার লেখা অজস্র গজল, শায়েরি, রুবাইয়াতে বিহ্বল হয়েছে সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ থেকে পরিণত পণ্ডিত পর্যন্ত। উর্দু সাহিত্যের বিশ্বখ্যাত গবেষক ও গালিব বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রশিদ আহম্মদ সিদ্দিকী বলেছেন, “মোগলরা হিন্দুস্থানকে তিনটে জিনিস দিয়েছেন- উর্দু, তাজমহল এবং গালিব।”
এমনকি, উর্দু সাহিত্যের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই কবিকে নিয়ে Ralf Rasel বলেছেন, “গালিব যদি ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে গণ্য হতেন।” শেষ মুঘল সম্রাট আবদুল জাফর সিরাজুদ্দিন বাহাদুর শাহের মৃত্যু হলে গালিব আরও নিঃসঙ্গ ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ এই সম্রাট শুধু তার শাসকই ছিলেন না, ছিলেন বন্ধু ও সহযাত্রী-কবি।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯ সালে মির্জা গালিব যখন মারা যান তখন তিনি নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন ও প্রায়-বিচ্ছিন্ন একজন গুটিয়ে যাওয়া মানুষ। সম্ভবত জীবন থেকে চলে যাওয়ার অপেক্ষাই তার একমাত্র অবলম্বন আর স্রষ্টার প্রযত্নেই তার একমাত্র আশ্রয় ছিল।
১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরবেলা তাঁকে সুলতানজী’তে কবরস্থ করা হয়। এটি ছিল সেই পবিত্র তীর্থস্থান যা ফকির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কবরের কাছে, লোহারু বংশের পারিবারিক কবরখানা। তার অন্তিমযাত্রার খরচটুকু বহন করে নবাব জিয়াউদ্দিন খান।
গোল বাঁধল, শেষকৃত্যের নিয়মগুলি নিয়ে। অর্থাৎ, শিয়া না সুন্নি কোন মতে মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিবকে গৌর করা হবে ! শেষে নবাব জিয়াউদ্দিনের কথামতো উর্দু সাহিত্যের এই দূতকে সুন্নি মতেই কবর দেওয়া হয়। যতকাল পৃথিবীতে প্রেম থাকবে, মির্জা গালিবও মিশে থাকবে প্রতিটি মানবিক স্নায়ুতে ! নিজের মৃত্যুশয্যায় গালিব লিখেছিলেন,
"বিপদ বিধ্বস্ত গালিবের অভাবে
কোনো কাজই কি থেমে থেকেছে?
এত কান্নাকাটির প্রয়োজন নেই
প্রয়োজন নেই উচ্চস্বরে বিলাপ করবার।"
মির্জা গালিব এর কয়েকটি উক্তিঃ
১। ধর্মকে বাদ দিয়ে নৈতিক হওয়া সম্ভব নয়।
২। পৃথিবীর সব চেয়ে বেশি মিথ্যা বলা হয় ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে,
যেটা আদালতে।
আর সব চেয়ে বেশি সত্য বলা হয় মদ ছুঁয়ে,যেটা পানশালায়।
৩। সব সম্পর্ক ছিন্ন করো না, বন্ধু;
আর যদি কিচ্ছু না থাকে
তো শত্রুতাই থাক।
৪। তোমার দরজার সামনেই ঘর বানিয়ে নিয়েছি আমি, এবারও কি বলবে আমার ঘরের ঠিকানা জানোনা তুমি।
৫। কিছু এমন ভাবে আমার জীবনকে সহজ করে নিয়েছি ,
কারো কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি , আবার কাউকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
৬। জীবন বড়ই বিচিত্র: সন্ধ্যা কাটেনা অথচ দিব্যি বছর কেটে যাচ্ছে !
৭। লক্ষ্য এক থাকলে সৌন্দর্যও ইবাদতে পরিণত হয়,
ধর্মহীনই শুধু প্রতিদিন তার কিবলা পরিবর্তন করে।
৮। আমাকে মদ খেতে দাও
এই মসজিদে বসেই
নইলে এমন জায়গা দেখাও
যেখানে আল্লাহ নেই।
৯। কেই বা তাকে চিনতে পারে সেই অলঙ্ঘ্য একক একাই
দুইয়ের ছিটেফোঁটাও থাকলে হয়তো কিছু চেনা হতো।
১০। কিছুই যখন ছিল না, তো খোদা ছিল।
কোনো কিছু না হলেও তো খোদা হতো।
হয়ে যাওয়াই ডুবিয়ে দিল বন্ধু আমায়,
নাই বা যদি হতাম কী ক্ষতি আর হতো ?