05/06/2025
শাহীনের ফোনে সকাল সকাল একটা মেসেজ আসলো। কেউ একজন ওর বিকাশে তের হাজার পাঁচশো টাকা পাঠিয়েছে। একাউন্টও চেক করে দেখলো, টাকা ঠিকঠাক ই জমা হয়েছে৷ শাহীন বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কে টাকা দিতে পারে? এমন কেউ তো নেই, যার ওকে টাকা পাঠানোর কথা। তাছাড়া বাসা থেকে টাকা পাঠালেও না জানিয়ে কেন পাঠাবে৷ তারপরও শিওর হওয়ার জন্য সে বাড়িতে ফোন করল, দুয়েকজন বন্ধুবান্ধব এবং ও একটা কোচিংএ কিছুদিন ক্লাস নিয়েছিলো, ওদের কাছেও খোজ নিলো। না, কেউ ই টাকা পাঠায়নি। তার মানে নির্ঘাত কেউ ভুল করে ওর নাম্বারে টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছে। ইয়েস, খুশি হয়ে উঠলো শাহিন৷
না, আপনারা যা ভাবছেন তা না৷ টাকাটা মেরে দেয়ার কোনো ইচ্ছা ওর নেই। শাহিন খুশি হয়েছে নিজেকে মহান এবং ভালোমানুষ প্রমাণ করা যাবে এই আনন্দে। শাহীন অবশ্যই টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবে৷ অন্যকারো টাকার প্রতি লোভ নেই ওর, তার ওপর মাত্র সাড়ে তের হাজার টাকা৷ এই টাকা মেরে দিয়ে কিইবা করবে ও। অথচ হতে পারে এটা কোনো দরিদ্র মানুষের বহু কষ্টের উপার্জন। লোকটা এখনো ফোন দিচ্ছে না কেন, ভাবতে ভাবতে ঘন্টাখানেক কেটে গেল৷ তারপরও ওদিক থেকে কোনো ফোন আসলো না৷
শেষমেশ অধৈর্য হয়ে যে নাম্বার থেকে টাকাটা এসেছে ঐ নাম্বারে কল দিলো শাহীন।
'হ্যালো, কে বলছেন?'
ওপাশ থেকে কেউ একজন বিরক্ত গলায় বললো, 'আপনি ফোন করেছেন আপনি জানবেন কার কাছে ফোন করেছেন।'
'দেখুন, আমি আপনার উপকার করার জন্য ফোন করেছি, আপনার বিকাশ থেকে কিছু টাকা...!'
শাহীন কথা শেষ করার আগেই ওপাশের লোকটা চিৎকার করে বললো, 'ওরে খানকির পোলা, তুই আমারে ভোদাই পাইছস। তুই আমারে চিনস? আমার লগে বিকাশ ফ্রড করতে আসছোস মাদার*দ। তোর মত ফ্রড পোলাপানরে ধইরা যদি আমি কুত্তা দিয়ে না...!'
'এক্সকিউজ মি, আপনি ভাষা সংযত করে কথা বলুন। আমি আপনার উপকার করার জন্য ফোন দিয়েছি, আর আপনি মুখ খারাপ করছেন।'
'ওরে হারামজাদা, তোর উপকার আমি তোর পাছার ভেতর দিয়ে ভইরা দিমু। আমারে চিনোনাই। ঘুঘু দেখছো, ঘুঘুর ফাদ দেখোনাই সোনামনি।'
এবার শাহীনও রেগে গেল, বললো, 'আরে ভাই, আপনি তো কথাই শুনতেছেন না, আপনার বিকাশ থেকে আমার একাউন্টে তের হাজার পাঁচশো টাকা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। মনে হয় ভুল করে চলে এসেছে।'
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, 'তওবা তওবা, স্যরি ভাই, না বুঝে অনেককিছু বলে ফেলছি। কিছু মনে করবেন না৷ আমি স্যরি। বুঝেনই তো, আজকাল খালি ফ্রড ঘুরে।'
শাহীনের রাগ কমলো লোকটার স্যরি শুনে। শান্তমুখে বললো, 'ঠিক আছে, সমস্যা নাই। আপনি ভাববেন না আমি টাকা মেরে দিব৷ আমি অন্যদের মত না। আপনার টাকাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এই নাম্বারে পাঠাবো?'
'না ভাই, এই নাম্বারে পাঠানোর দরকার নাই৷ আমি আরেকটা নাম্বার দিচ্ছি, ওটাতে একটু পাঠান।'
'ঠিক আছে, নাম্বার বলেন।'
'নাম্বার তো আমার মুখস্ত নাই, দেখে বলতে হবে। আপনাকে আমি হোয়াটসঅ্যাপে নাম্বারটা লিখে দিচ্ছি। আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দেন।'
'আমি যে নাম্বারে কল করেছি, এটাই হোয়াটসঅ্যাপ।'
'ঠিক আছে। আমি নাম্বার দিচ্ছি।'
লোকটা ফোন কেটে দিলো। শাহীন ওয়াইফাই কানেক্ট করে বসে রইলো, কখন আসবে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ। কিন্তু কিসের কি, দেড় দুই ঘন্টা হয়ে গেল, কিন্তু কোনো মেসেজ আসলো না। এদিকে টাকাটা ফেরত দেয়ার আগ পর্যন্ত শাহীনের শান্তিও হচ্ছে না৷ সে বাধ্য হয়ে আবার কল করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো না। শাহীন দেখলো যে নাম্বারে কথা হয়েছে, ঐ নাম্বারেই হোয়াটসঅ্যাপ আছে দেখাচ্ছে। সে হোয়াটসঅ্যাপে নক দিলো। লিখলো, 'হ্যালো, আমাকে চিনেছেন?'
কয়েক মিনিট পর রিপ্লাই আসলো, 'আপনি কোন দেশের মন্ত্রী না মিনিষ্টার যে আপনাকে চেনা লাগবে?'
শাহীনের আবার রাগ হলো। এই লোক তো মহা ঝামেলা। সে অনেক কষ্টে রাগ কন্ট্রোল করে শান্তভাবে মেসেজ দিলো, 'দেখেন, আপনি বলেছিলেন হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে বিকাশ নাম্বার দিবেন।'
'কই, আমি তো এমন কিছু বলিনি। আপনি কি বিকাশে ফ্রড করেন নাকি। কিসের বিকাশ নাম্বার দিব। এইসব ধান্ধা কতদিনের?'
'এক্সকিউজ মি, আপনার সাথে আমার একটু আগে ফোনে কথা হলো এই নাম্বারেই।'
ওপাশ থেকে অনেকক্ষণ রিপ্লাই আসলো না। তারপর একটা ভয়েস মেসেজ আসলো, এক মহিলা বলছে, 'ভাই, এই নাম্বার আমার হাজবেন্ডের ফোনে। এটার হোয়াটসঅ্যাপ আবার আমার ফোনে খোলা।'
'ও আচ্ছা, আপনার হাজবেন্ডের সাথে আমার কথা ছিলো। উনাকে বলেন ফোন করতে আমাকে।'
ওপাশ থেকে আবার ভয়েস মেসেজ, 'দেখেন ভাই, সে কি করে না করে আমি সেসবের মধ্যে নাই। আপনাদের ভেতরে কি হইছে আপনারাই বুঝেন৷ এই লোক বাসায় আসেনা এক সপ্তাহ হইছে। বাড়িতে একটা টাকাও পাঠায় না৷ আপনি তারে বলবেন সে যেন আমার ফোন ধরে। আমার কথা নাহয় না ভাবলো, তার দুইটা সন্তানের কথা সে ভাববে না। কেমন বাপ বলেন তো। মেয়েটা আব্বা আব্বা বলে কানতেছে।'
শাহীন কি বলবে ভেবে পেলো না৷ সামান্য একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে সে কি ঝামেলায় পড়লো! কোনোমতে এই মহিলাকে মেসেজ দিলো, 'আন্টি, আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।'
তারপর আবার ফোনে কল করলো লোকটাকে। প্রথমবার রিসিভ হলো না৷ দ্বিতীয়বার ফোন কেটে দেয়া হলো ওপাশ থেকে। শাহীন এবার নাছোড়বান্দা। ফোন দিতেই থাকলো। চতুর্থবার ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে লোকটা রাগী গলায় বললো, 'আরে ভাই, সমস্যা কি আপনার। বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করছেন কেন? আমি ব্যস্ত আছি, আপনার জ্বালায় দেখি শান্তিমতো কোনো কাজই করার উপায় নাই। বারবার ফোন কেটে দিচ্ছি বুঝতেছেন না। তারপরও ফোন দিয়ে বিরক্ত করেই যাচ্ছেন। কমনসেন্সের আজকাল এতো অভাব।'
'দেখুন, আপনার টাকা আমার কাছে, আপনি এমন ব্যবহার করতে পারেন না।'
'টাকা আছে তো কি মাথা কিনে নিছেন নাকি। বললাম নাম্বার দিব। আজকালকার ছেলেপেলের ধৈর্যের এতো অভাব। নাম্বার দিতে সময় লাগবে৷ এখন একটা কাজ করতেছি। বিরক্ত কইরেন না প্লিজ।'
শাহীন কিছু বলতে গেল৷ কিন্তু ওপাশ থেকে লোকটা ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে।
শাহীন রাগে দুঃখে বিরক্তিতে হতাশায় ভাষা হারিয়ে বসে রইলো।
বিকালে শাহীনের মেসে আসলো ওর বন্ধু রায়হান৷ এসেই বললো, 'দোস্ত, তোর বিকাশে টাকা আছে? আমাকে হাজারখানেক টাকা বিকাশ কর। নেক্সট উইকে দিয়ে দিব।'
শাহীন জানে এই ছেলে টাকা নিলে সহজে দিবে না৷ তাছাড়া ওর কাছে এইমুহুর্তে দেয়ার মত টাকাও নেই৷
সে বললো, 'টাকা নেই রে দোস্ত। আব্বা এখনো টাকা পাঠায়নি এইমাসের৷ বিকাশ ফাকা।'
'মিথ্যা বলিস না।'
'কসম টাকা নাই।'
'ঠিক আছে, তোর বিকাশ এপ খুলে দেখা। আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।'
শাহীন পড়ে গেল ঝামেলায়৷ বিকাশে তো সাড়ে তের হাজার টাকা আছে৷ কিন্তু এই টাকা ওর না৷ সেটা রায়হানকে কিভাবে বোঝাবে।
'কি ব্যাপার, দেখা। পারবি না জানতাম৷ কারণ তোর বিকাশে টাকা আছে।'
শাহীন আমতা আমতা করে বললো, 'হ্যা, টাকা আছে, কিন্তু টাকাটা আমার না। অন্য একজনের।'
'ও আচ্ছা, তাই না? তুমি তো বিকাশের এজেন্ট খুলছো। মানুষ তোমার ফোনে টাকা রেখে গেছে।'
'আরে ভাই, একজনের টাকা ভুল করে চলে এসেছে।'
'তো তাকে ফেরত দিসনাই কেন?'
'দিব, কিন্তু কোন নাম্বারে দিব জানিনা।'
'বাহ, ভালোই নাটক সাজাইছিস৷ টাকা দিবি না বললেই হয়৷ এতোগুলা মিথ্যা কথা বলার কি আছে৷ বাদ দে, তোর কাছে টাকা আশা করাও আমার উচিত হয়নাই।'
শাহীন রায়হানকে বোঝানোর জন্য ওর সামনে আবার সেই লোকটাকে ফোন দিলো। কিন্তু এবারো ফোন রিসিভ হলো না।
রায়হান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, 'থাক তুই। ভালো থাকিস৷ কখনো হেল্প লাগলে জানাইস৷ আমি তোকে বন্ধু ভাবি এখনো। হেল্প না করতে পারি, অন্তত মিথ্যা কথা বলবো না।'
রায়হান চলে গেল রাগ করে৷ শাহীন কি করবে ভেবে পেলো না। ঐ লোক ফোন দিলো রাত এগারোটার দিকে। বললো, 'ভাই, কেমন আছেন?'
শাহীন অভিমানী গলায় বললো, 'তা দিয়ে আপনার কি দরকার। আপনার ব্যস্ততা শেষ হইছে?'
'পুরুষ মানুষের ব্যস্ততা কি আর শেষ হয় ভাই। পুরুষের জীবন মানে হলো...!'
'ধুর মিয়া। আপনার বিকাশ নাম্বার দেন৷ টাকা পাঠাই দেই। আর ভালো লাগতেছে না।'
'আপনি তো দেখি টাকা পাঠানোর জন্য পাগল হয়ে গেছেন। এতো চাপ নিলে তো শরীর খারাপ করবে৷ আপনে লোক ভালো, আপনার সাথে চিন পরিচয় হওয়া দরকার। আমি মফিজ, ময়মনসিংহ বাসা৷ ছোটখাটো ব্যবসা করি।'
'আপনি কি টাকাটা নিবেন না?'
'নিব না কেন। অবশ্যই নিব৷ কিন্তু টাকাই কি সব নাকি ভাই। আপনার কথা বলেন৷ আপনার ওপর রাগ করছিলাম বলে সর্যি। আপনার নাম কি, কই থাকেন, কি করেন?'
'আমি শাহীন, ঢাকা থাকি। লেখাপড়া করি।'
'আচ্ছা খুব ভালো। ঢাকা কই থাকেন?'
'আজিমপুর।'
'বাহ, খুবই ভালো লাগলো শুনে। বলছিলাম কি ভাই, আপনি মিরপুর যান নাকি?'
'মানে?'
'মানে যদি ছোট্ট একটা উপকার করতেন। আমি টাকাটা ঢাকায় যাকে পাঠাতে চেয়ে আপনার নাম্বারে ভুল করে গেছে, সেই লোক আমার সাথে দুই নাম্বারি করছে। ফোন ধরে না। তার একটা মাল কিনে আনার কথা ছিলো আমার ব্যবসার জন্য৷'
'তো?'
'আসলে টাকা তো আপনার কাছে, আপনি যদি মিরপুর তের নাম্বারে গিয়ে মালটা এনে আপনার কাছে রাখেন, তাহলে খুব উপকার হয়। দেরি হলে আমি জিনিসটা আর পাবো না। আমার রিকুয়েস্ট, ভাইয়ের এই হেল্পটা করেন। আপনি মানুষ ভালো, এইটা আমি বুঝছি।'
লোকটার কথা ফেলতে পারলো না শাহীন। পরদিন লোকটার দেয়া ঠিকানায় গেল। একটা গোডাউনের সামনে গিয়ে রফিক নামে একটা লোকের খোজ করলো৷ রফিক আসার পর বললো, 'আমি মফিজ ভাইয়ের জিনিসটা নিতে আসছেন।'
'আপনাকে তো চিনলাম না। আপনি কি উনার নতুন পাটনার?'
'যেই হোই না কেন, জিনিসটা দেন।'
'কিভাবে নিবেন, ভ্যান কই?'
'মানে?'
'আরে ভাই, ভ্যান বা অটো কিছু ডেকে আনেন। মাল নিয়ে যান।'
'জিনিসটা কি আমাকে বলেন তো।'
রফিক আর আরো কয়েকজন মিলে ভ্যান ঠিক করে মালগুলো তুলে দিলো। ভ্যান ভর্তি লুঙ্গি আর গামছা। কয়েক বস্তা। মফিজের নাকি গ্রামের হাটে লুঙ্গি আর গামছার দোকান আছে।
মেসের আর সবার সন্দেহভাজন দৃষ্টি উপেক্ষা করে শাহীন ভ্যানওয়ালাকে দিয়ে তার রুমে সাড়ে তের হাজার টাকার পাইকারি লুঙ্গি আর গামছা এনে রাখলো। রুম প্রায় ভরে গেল।
কোথা থেকে খবর পেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে রায়হান আসলো। প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, 'দোস্ত তুই মিথ্যা বলছস আমি মেনে নিয়েছি৷ তাই বলে এভাবে বিট্রে করলি?'
'মানে?'
'আমরা সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে দুইজন ঠিক করে রাখছিলাম একসাথে ব্যবসা করব। রেস্টুরেন্ট দিব, নাহয় অনলাইনে টিশার্ট বিক্রি করব। তুই আমাকে ছাড়াই শুরু করে দিলি? তাও লুঙ্গি আর গামছার ব্যবসা। কাজটা তুই ঠিক করলি? বন্ধুরে ধোকা দিয়ে জীবনে বিরাট উন্নতি করে ফেলবি তাইনা!'
শাহীন ওকে অনেক কষ্টে বুঝানোর চেষ্টা করলো এই জিনিসগুলো ওর না। এগুলো সেদিন বিকাশে যার টাকা এসেছিলো ভুল করে তার। বিশ্বাস করানোর জন্য মফিজকে ফোনও দিলো শাহীন। ফোন রিসিভ হলো না যথারীতি। রায়হান বেশ কিছু গালিগালাজ করে চলে গেল।
রাতে ফোন দিলো শাহীনের গার্লফ্রেন্ড শায়লা। রাগি গলায় বললো, 'এটা আমি কি শুনতেছি শাহীন।'
'কি শুনতেছ?'
'তুমি নাকি পাইকারিতে লুঙ্গি আর গামছা বিক্রির ব্যবসা শুরু করেছ? তোমার কাছে আমি এটা একদমই আশা করিনি। আমার বাবাকে কি বলব? ছেলে লুঙ্গি বিক্রি করে? তুমি জানো বাবা বিসিএস ক্যাডার না হলে রাজি হবে না। তুমি বলেছিলে সর্বোচ্চ ট্রাই করবা। এই তোমার ট্রাই?'
'দেখ জান তুমি যা ভাবছ তা না। এটা মিথ্যা।'
'ও আচ্ছা, পুরো ক্যাম্পাসের সবাই জানে তোমার ব্যবসার কথা, আর তারপরও বলছ মিথ্যা। তুমি আমাকে আর ফোন দিব না৷ থাকো তোমার লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে। লুঙ্গি পরে গামছা গায়ে দিয়ে বসে থাকো। বাই।'
শায়লা ফোন কেটে দিলো। কয়েকবার ফোন দেয়ার পরও রিসিভ করলো না। বিরক্ত হয়ে মফিজকে ফোন দিলো শাহীন৷ আবার যা তাই। ফোন কেটে দিচ্ছে৷ ছয়বার টানা ফোন দেয়ার পর মফিজ ফোন ধরে অনেক কষ্টে রাগ কন্ট্রোল করছে এমনভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, 'ভাই, এতোবার ফোন দেন কেন। আমি ব্যস্ত। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেছি।'
'আপনার লুঙ্গির বস্তা আনছি৷ এখন কি করব বলেন৷ আমার বাসায় রাখা ঝামেলা।'
'ভাই, আমি ব্যবস্থা করতেছি। আমাকে একটা দিন সময় দেন। আমি কাল জানাচ্ছি। প্লিজ ভাই৷'
মফিজ ফোন রেখে দিলো। শাহীন হতাশ হয়ে ঘুমুতে গেল৷ ঘুমানোর আগে ফেসবুকে ঢুকে দেখলো, রায়হান স্ট্যাটাস দিয়েছে, 'কিছু বন্ধু হয় সাপের মত৷ তারা সুযোগ পেলেই পেছন থেকে দংশন করে।'
ভার্সিটির মেসেঞ্জার গ্রুপে সবাই শাহীনকে মেনশন দিয়ে ওর ব্যবসার অবস্থা জানতে চাচ্ছে। ফ্রিতে লুঙ্গি গামছা দিবে নাকি জিজ্ঞেস করছে। বোঝা যাচ্ছে এরা ওর সাথে মজা নিচ্ছে। শাহীন রাগে আর হতাশায় ফোন বন্ধ করে দিলো।
পরদিন সারাদিন কেটে গেলো, মফিজ কোনো কন্টাক্ট করলো না। রাত বারোটার দিকে শাহীনের আব্বু এসে হাজির হলো কিশোরগঞ্জ থেকে। জরুরি একটা কাজে নাকি ঢাকা এসেছে। রুমে ঢুকে বস্তা বস্তা লুঙ্গি আর গামছা দেখে খুবই রেগে গেলো। বললো, 'আমি এতো করে বলেছি গ্রামে এসে আমার সিমেন্টের ব্যবসা দেখতে, তা না তুই নাকি বড় চাকরি করবি, আমার ব্যবসা নাকি ছোট ব্যবসা, তোর মান সম্মান থাকবে না দোকানে বসলে। আর এখানে লুঙ্গি আর গামছার ব্যবসা শুরু করেছিস। এটা খুব বড় ব্যবসা, তাইনা?'
'দেখ আব্বু, তুমি যা ভাবছ তা না। এগুলো আমার না।'
'তাহলে কার?'
'অন্য একজনের। আমি চিনিনা তাকে।'
'চিনিস না আবার তার জিনিস তোর কাছে। ফাইজলামি পাইছিস, মিথ্যা বলার আর জায়গা পাচ্ছিস না।'
আব্বুকে বিশ্বাস করানোর জন্য শাহীন ফোন দিলো মফিজকে। এতো রাতে সে ফোন ধরবে না বলেই ওর বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু শাহীনকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ফোন রিসিভ হলো। আব্বুকে শোনানোর জন্য সে ফোন লাউড স্পিকারে দিলো।
ওপাশ থেকে এক মহিলা কণ্ঠ শোনা গেল, 'হ্যালো কে আপনি? কাকে চান?'
'আপনার হাজবেন্ডকে ফোনটা দেন প্লিজ।'
'কি পাগলের মত কথা বলছেন। আমি আমার হাজবেন্ডকে কিভাবে ফোন দিবো। সে তিন বছর হলো সৌদি আছে।'
'ও স্যরি আন্টি। এটা কার ফোন।'
'মফিজের ফোন।'
'হ্যা, উনাকেই প্লিজ ফোনটা দেন।'
কিছুক্ষণ পর মফিজ ফোন ধরেই বললো, 'স্যরি ভাইজান, আমি বাথরুমে ছিলাম। ফোন ধরেছিলো আমার প্রতিবেশি। সালমার আম্মা।'
শাহীনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, 'এতো রাতে আপনার প্রতিবেশি আপনার ঘরে কি করে?'
ওপাশ থেকে কোনো কথা না বলে মফিজ হুট করে ফোন কেটে দিলো।
শাহীন আবার ফোন দিলো কিন্তু এবার আর ধরলো না।
আব্বা শাহীনের দিকে তাকিয়ে আগুনচোখে বললো, 'এইসব কোনধরনের লোকের সাথে তোর মেলামেশা? মান সম্মান চরিত্র সব শেষ করে বসে আছিস দেখছি। এই লোক তোর ব্যবসার পার্টনার?'
'আমি লুঙ্গি আর গামছার ব্যবসা করতেছিনা আব্বু।'
'তাহলে কিসের ব্যবসা করতেছিস? ভাবসাব তো কিছুই ভালো লাগছে না আমার। তোকে ঢাকা পাঠানোই ভুল হইছে। কাল আমার সাথে বাড়িতে চল।'
'আমার পরীক্ষা সামনের সপ্তায়।'
'পরীক্ষা শেষ করেই বাড়ি আসবি। তারপর তোর বিষয়টা দেখতেছি।'
পরদিন আব্বু গ্রামে চলে যাওয়ার পর শাহীনের ধৈর্যের বাধ পুরোপুরি ভেঙে গেলো। এনাফ ইজ এনাফ৷ যথেষ্ট হয়েছে। সে আজ সবকিছু শেষ করবে। হয় মফিজ আজ জিনিস নিবে, নাহয় শাহীন সমস্ত লুঙ্গি গামছা ফেলে দিয়ে আসবে। ভালোমানুষি দেখানো অনেক হইছে। এই দেশে ভালোমানুষের জায়গা নাই।
এরকম একটা ইচ্ছাশক্তি নিয়ে শাহীন ফোন দিলো মফিজকে। ফোন রিসিভ হওয়ার পর রাগান্বিত গলায় বললো, 'আপনি পাইছেন কি, হা? আর কতদিন ঘুরাবেন আমাকে? আজকের মধ্যে আপনি মাল নেয়ার ব্যবস্থা করবেন, নাহয় আপনি আপনার জিনিস আর কোনোদিন পাবেন না।'
ওপাশ থেকে একটা মোটা গলা শান্ত কণ্ঠে বললো, 'তার মানে আপনি মফিজের বিজনেস পার্টনার?'
শাহীন কণ্ঠ শুনে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো, 'কে আপনি?'
'আমি ভালুকা থাকার এসআই মনোয়ার।'
'কিন্তু এই ফোন তো..!'
'হ্যা এটা আপনার পার্টনার মফিজের ফোন। গতকাল সে গাজা বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছে তার পরকীয়া প্রেমিকার বাসা থেকে৷ অনেক জেরা করেও তার পার্টনারের কোনো খবর সে দেয়নি। এখন দেখছি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। মাল কোথায়?'
'বিশ্বাস করেন আমি কিছু জানিনা। আমার কাছে শুধু লুঙ্গি আর গামছা আছে।'
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে গ্রেফতার করলো শাহীনকে। তার বাসায় রাখা লুঙ্গি আর গামছার বস্তার ভেতর থেকে উদ্ধার হলো দুই কেজি গাজা আর দেড় হাজার পিস ইয়াবা। পুলিশ শাহীনের ফোন চেক করে গত কয়েকদিন মফিজের সাথে নিয়মিত ফোনকলের হিস্ট্রি দেখে যা বোঝার বুঝে নিলো।
কোর্টে ওঠানোর পর ময়মনসিংহ দায়রা জজ শাহীনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলো।
পরের ঘটনা সামান্য। রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনেই শাহীন গাজা ও ইয়াবা ব্যবসার কথা স্বীকার করলো। তৃতীয় দিন জানালো সে কিভাবে নিজে গিয়ে বর্ডার থেকে জিনিস সংগ্রহ করে আনে এবং সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়। চতুর্থদিনে শাহীন শ্যামলিতে ছাত্রনেতা আজমল হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিলো। রিমান্ডের ষষ্ঠ দিনে সে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং রমনা বটমুলে গ্রেনেড হামলার সাথে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করলো। দেড় বছর মামলা চলার পর শাহীনের ফাসির আদেশ হলো। সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেও কাজ হলো না৷
শাহীনের কথা কোর্ট তো দূর, বাবা মা বন্ধুবান্ধব প্রেমিকা কেউ ই বিশ্বাস করলো না। সবার ই ধারণা ও এসবের সাথে জড়িত। ততদিনে রাগে দুঃখে হতাশায় শাহীন পাথর হয়ে গেছে।
২০২৩ সালের ১৯ এ ডিসেম্বর রাত বারোটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শাহীনের ফাসি কার্যকর করা হয়। ফাসির আগে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, 'আপনার শেষ ইচ্ছা কী?'
শাহীন বিরক্ত গলায় বলেছিলো, 'তাড়াতাড়ি ফাসি দেন তো বাল। এতো কথা শুনতে ভাল্লাগতেছে না।'