18/09/2025
দ্বিতীয় স্ত্রী সিগ্ধাকে নিয়ে মহা সুখে আছে বজলু চৌধুরী। তার কাছে মনে হয় জীবনটা রঙিন করে দিয়েছে সিগ্ধা। স্নিগ্ধা যা বলে সব কিছু অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সে। ওর পছন্দ অপছন্দের দিকে সব সময় বিশেষ নজর রাখে বজলু। মনে মনে সে খুব আফসোসও করে তার বয়সটার জন্য, তার মনে হয় ইস্ বয়সটা যদি কম করা যেতো কোনভাবে! অথবা কেন যৌবনকালে স্নিগ্ধার মতো মেয়ের সাথে তার পরিচয় হলোনা! তার তো টাকার অভাব নেই, বয়স কমানোর কোন উপায় থাকলে নিশ্চয়ই সেটা করতো বজলু। স্নিগ্ধা আয়নার সামনে বসে সেই কখন থেকে সাজগোজ করছে, বজলুর তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে, স্নিগ্ধা একের পর এক দিচ্ছে আইলাইনার, আইশ্যাডো, লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন আরো কত কি! এই কয়দিনে অনেক কিছুর নাম জেনে গেছে বজলু।
তবে বয়সের ভাবনায় এসে তার মনে পড়ে এক সময় সেও তো কম বয়সী ছিলো, বিয়ে করেছিলো সে ছাব্বিশে, প্রথম স্ত্রী সাবিহার বয়স ছিলো তখন উনিশ। সময়টা তখন সুখেই কেটেছে, তবে সেই সুখ কি আর সুখ? কোথাও যেতে বললে কাজের দোহাই দিতো সাবিহা, বাজে টাকা খরচ হবে বলতো, খুব হিসেবি ছিলো সে। আসলেই তখন কাজের লোক রাখা, বাড়তি খরচ করার সামর্থ্য ছিলো না বজলুর। নতুন ব্যবসা, মূলধন বাড়ানো সেই সব নিয়ে বজলুর চিন্তা দেখে সাবিহা এক টাকাও অযথা খরচ হতে দিতো না। তবে বজলু সেই সব মানে না তার মতে সাবিহা কখনো তাকে খুশি করার চেষ্টা করেনি, সব ছিলো ওর বাহানা, কোন প্রেমিকের কথা ভাবতো কে জানে? তার পিছে পিছে কত কি করে বেরিয়েছে অথচ তাকে দেখলেই তার কত ক্লান্তি আর ঘুম! যাক সেই সব কথা, এই সব মনে করে এখনকার সুন্দর সময়টা নষ্ট করতে চায় না বজলু। স্নিগ্ধাকে নিয়ে ডিনারে যাবে, সে রেডি হয়ে বসে আছে আধ ঘণ্টা ক্রশ করে গেছে কিন্তু সিগ্ধার রেডি হওয়া শেষ হচ্ছে না।
অথচ সাবিহার সময় ধৈর্য বলতে কিছুই ছিলোনা তার। একদিন এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াতে যাওয়ার সময় বজলু রেডি হয়ে দাঁড়াতেই হাঁক দিতে লাগলো, এত দেরি হয় কেন সাবিহার, অস্থির হয়ে ঘড়ি দেখছিলো, সাবিহা পাঁচ মিনিটের মাথায় দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছিলো। রিকশায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে বজলুর মনে হয়েছিলো, ওর শাড়িটা বড্ড বেমানান, একদম সিম্পল। একটা ভালো শাড়ি কিনতে বলেছিলো সে কিন্তু সাবিহার ঐ এক কথা একটা শাড়ি কিনলে এই মাসে সংসার খরচে টান পড়বে তার উপর গিফটও তো কিনতে হলো। একটু সাজার জন্যও সময় নেই তার! সাবিহাকে দেখে খুব রাগ লাগছিলো তখন।
স্নিগ্ধা ড্রেস ঠিক করতে করতে বলতে লাগলো ঐ ড্রেসটা নিলেই হতো এটার চাইতে মাত্র পাঁচ হাজার বেশি ছিলো, এখন এটা পরে ভালো লাগছে না, আমাকেই মনে হয় সব চাইতে বিশ্রী দেখা যাবে।
বজলু বলে উঠলো, একদমই না, তুমি তো এমনিতেই সুন্দর এখন আরো সুন্দর লাগছে। চল তাড়াতাড়ি।
রাস্তায় স্নিগ্ধা বার বার ঐ ড্রেসের কথা বলছিলো দেখে বজলু বললো সমস্যা নেই কাল গিয়ে ওটাও কিনে নিও।
স্নিগ্ধার এত খাবার অর্ডার করা দেখে বজলু বুঝতে পারলো না এত খাবার তারা কিভাবে খাবে। একটু পরেই ক্লিয়ার হলো ব্যাপারটা। স্নিগ্ধা বললো এত মজার খাবার ছোট ভাই বোন দু'টো খেতে পারবেনা এই ভেবে ওর নিজের ভালোভাবে খাওয়া হবেনা তাই অতিরিক্ত খাবারগুলো প্যাক করে ওদের বাড়িতে দিয়ে যাবে।
বজলুর খারাপ লাগলো এই ব্যাপারটা, দুইজনে যেই টাকায় খাওয়া হতো সেখানে তিনগুণ টাকা বেশি লাগছে! আর অর্ডার দেয়ার আগে বজলুকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করলোনা স্নিগ্ধা! খাওয়া শেষে স্নিগ্ধাদের বাড়িতে গেলে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। একটু কষ্টই হলো বজলুর মুখটাতে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে। এখন যদি বজলুর মুখ ভার দেখে উল্টো স্নিগ্ধা গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।
অথচ সাবিহা কত চেষ্টা করে বজলুর রাগ ভাঙাতো। সে রেগে যাবে এমন কোন কাজ সে পারত পক্ষে করতোনা। কাঁটা চামচ নাড়াচাড়া করতে করতে খুব মনে পড়ছে সাবিহার মুখটা। অথচ বেঁচে থাকতে ভালো করে তাকাতোও না বজলু। সাবিহার জীবন কেটেছে সংসারের টানাপোড়েনে, এর পরে যখন একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখা শুরু হলো তখন সাবিহা শুরু করলো সংসার গুছানো, সংসারের জিনিস কেনাকাটা, সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ততা আর নামাজ- রোজা। এ ছাড়া কোন দুনিয়া তার গড়ে উঠেনি।
স্নিগ্ধা খলখলিয়ে হেসে উঠলো, সে কি বলেছে বজলুর কানে ঢুকেনি সে কথা, হাত বাড়িয়ে বজলুর হাতটা ধরে বললো, তুমি রাগ করনিতো আমি বাড়ির জন্য অতিরিক্ত খাবার অর্ডার দিয়েছি বলে?
বজলু একদম গলে যায়। গদগদ হয়ে বলে-
–আরে না, রাগ করবো কেন?
স্নিগ্ধাদের বাড়িতে খুব ঘন ঘনই যেতে হয়, ওর বায়না ফেলতে পারে না বজলু। প্রথম দিকের কয়েক দিন জামাই আদর পেয়েছে। এখন শুধু কথা দিয়ে চিড়ে ভেজায় শশুর। নিজের বয়সী শশুরকে সন্মান দেখাতে গিয়ে গলে পড়ে বজলু। শত হলেও শশুর তো। কথা বলতে বলতে ফজলুর তন্দ্রার মতো আসে।
সাবিহার বাবার বাড়ির ডাইনিং টেবিলে ভর্তি নানা রকম খাবার দেখতে পায় বজলু। সাবিহার মা জামাই আদরের কোন অপূর্ণতা যেন না থাকে প্রত্যেকবার তটস্থ থাকে। বজলু তবুও দোষ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে, কিসে ঝাল বেশি, লবণ কম। খুঁজে পায়না, শাশুড়ির রান্না আসলেই খুব ভালো। সে হঠাৎ বলে, আম্মা আপনার মেয়েকে তো রান্না শেখাতে পারেননি, ওর রান্না মুখে দেয়া যায়না। মা মেয়ের মুখের দিকে তাকায়, সাবিহার মুখ অপমানে লাল হয়ে উঠে। মা আমতা আমতা করে বলে, ওর রান্নার হাত তো ভালো এখন তাহলে কি হলো! এই সাবিহা কিরে মনোযোগ দিয়ে রান্না করিসনা?
শশুর বাড়িতে আসার সময় দুই রকমের ফল নিয়েছে, সাবিহা বলার পরেও মিষ্টি কিনেনি বজলু। খাওয়ার পর দই মিষ্টি দেয়া হয় বজলুকে, শশুর মনে হয় কিনে এনেছে তার জন্য। বজলু মনে মনে খুশি হয়। মিষ্টি মুখের কাছে নিতেই নিচে পড়ে যায়,
বজলুর শরীরটা ঝাকুনি দিয়ে উঠে, চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করে সে কোথায়। এত বছর আগের স্মৃতি স্বপ্নে ফিরে এলো বুঝতে একটু সময় লাগলো। স্নিগ্ধা তার গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে থাকে বসে বসেই ঘুমিয়ে গেছ? স্নিগ্ধার ছোটবোন হেসে কুটিকুটি হয়ে যায়। যেন বসে বসে ঘুমের দৃশ্য সে আর কোনদিন দেখেনি। বজলু রাগ হয় কিন্তু প্রকাশ করেনা।
স্নিগ্ধার মা থেকে যেতে বললে, স্নিগ্ধা জানায় এখানে তো এসি নেই , এসি ছাড়া ঘুম আসবেনা তার। স্নিগ্ধা আদুরে গলায় বলে, এখানে একটা এসি লাগিয়ে দাও না, তাহলে এখানে এসে থাকতে কষ্ট হবেনা।
বজলুর অবাক হয়ে তাকানো দেখে, স্নিগ্ধা বলে, কম দামের হলেই হবে। তুমি আমি এসে থাকবো মাঝে মধ্যে। তুমি তো এখানে কখনো থাকো না, এসি লাগালে সমস্যা হবেনা থাকতে।
বজলু জানে এই বায়না না মেটালের স্নিগ্ধা রাগ করে কথা বলবে না, অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাবেন। তাই এই আবদারও মেটাতে হবে।
বজলুর ইদানিং খুব একা লাগে, হয়তো ভয়ও লাগে। স্নিগ্ধাকে বিয়ে করার আগে তার এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলো, মোটামুটি মানানসই বয়সের কাউকে বিয়ে করতে, এত কম বয়সী মেয়ে কি বজলুর শেষ বয়সের নিঃসঙ্গতা কাটাতে পড়ে থাকবে তার স্বভাবসুলতা ত্যাগ করে? বয়স তো অনেক বড় একটা ব্যাপার। বয়সের প্রত্যেক ধাপ ভিন্ন আর এর চাহিদাও সম্পূর্ণ আলাদা। তাই যখন যেই ধাপে যে চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত তা না করে অন্য কিছুকে গুরুত্ব দিলে বিরোধ তো বাধবেই।
তখন বজলু এই পরামর্শকে কানে নেয়ার মতো, এর গুরুত্ব বোঝার মতো অবস্থায়ই ছিলোনা, সে ছিলো মোহগ্রস্ত। সে ভেবেছে সবাই তার খারাপ চাইছে। তার টাকা আছে বলেই যা ইচ্ছা করতে পারে, এই টাকার জন্যই তো এত কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করতে পারছে আর এই পারাটাকে বন্ধু হিংসা করছে।
বজলু বারান্দায় বসে বসে ভাবছে তবে কি ভুল হলো? স্নিগ্ধাকে ঘরে থাকতে, একটু তার সঙ্গে সময় কাটাতে বলাই যায়না এখন। খুব বেশি দিন হয়তো সে বজলুর সঙ্গে থাকবেও না। সে স্নিগ্ধার প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে সন্তানদের ঠকিয়ে সম্পদের বড় অংশ স্নিগ্ধাকে দিয়েছে।
স্নিগ্ধার ব্যাংক ব্যালেন্স, গহনা বেশ ভারী হয়ে উঠেছে সেই সাথে সাভারে জায়গা,গুড়ানে ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটে অবশ্য স্নিগ্ধার বাবা মা, ভাই বোন থাকতে শুরু করেছে।
বজলুর ছেলে মেয়ের সাথে যোগাযোগ একদম বন্ধই বলা চলে। ওরা আর তাদের বাবার সাথে কথা বলতেও স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না। মাঝেমাঝে সন্তানদের সাথে কথা বলতে খুব করে মন চায় কিন্তু কি বলবে ভেবে ভেবে আর কল দেয়া হয় না। স্নিগ্ধাও খুব ব্যস্ত থাকে ওর আত্মীয় স্বজন, শপিং নিয়ে। কিছু বললেই রাগ দেখায়, চলে যাওয়ার কথা বলে।
বজলুর এখন সব সময় মনে পড়ে সাবিহার কথা। কি বোকা একটা মেয়ে ছিলো সে।
কখনো নিজের কোন শখ পূরণ করেনি। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী একটা দামী শাড়ি কিনেনি, দামী রেস্টুরেন্ট খায়নি, দূরে কোথাও বেড়াতে যায়নি। সংসারের প্রথম জীবনে টাকা কমের কারণে, সুন্দর করে সংসার পরিচালনা করতে কোন শখ মেটাতে পারেনি আর যখন টাকা হলো তখন হয়তো তার কোন শখ অবশিষ্টই ছিলোনা।
সংসারের কাজ কাজ করে, স্বামী সন্তানদের প্রয়োজন মেটাতেই ব্যস্ত থাকতো সারাক্ষণ। নিজের জন্য সময় বলতে তার কিছুই ছিলোনা। সাবিহার প্রতি কি বজলু কখনো আলাদা গুরুত্ব, যত্ন বা ভালোবাসা দেখিয়েছে? সাবিনার প্রতি কি অবহেলা পাহাড়সম ছিলোনা? সে মনে করতো তাকে ছাড়া এই সংসার চলবেনা, স্বামীর সমস্যা হবে, সন্তানদের কষ্ট হবে, তার সংসার ভেসে যাবে!
অথচ সব কিছু চলছে, খুব ভালো ভাবেই চলছে। সন্তানরা মাকে হয়তো মাঝে মধ্যে মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর স্বামী এতদিন পরে শেষ বেলায় এসে বুঝে তার গুরুত্ব, শুধু এতটুকুই।
©