02/10/2025
সূফী কবি রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা
এই গীতিকাব্য নিয়ে সামাণ্য ব্যাখ্যা।
****************************
কৈলাসে ভোলা কাঁদে একেলা,
ছিরে গেছে গাথা মালা গলার বাঁধন,
হবে প্রতিমা বিসর্জন...।
ছেরে গেছে নবমী আসিয়াছে দশমী।
হবে প্রতিমা বিসর্জন...।
বানাইয়া চালি চাঙ্গে তুলি,
রঙ তুলিতে তারে করিয়া বরণ,
শত ঢাক বাড়ি, নাড়ু চিড়া মুড়ি,
আহা মরি মরি করি পূজার আয়োজন।।
সপ্তমী সাদরে পূজার মন্দিরে,
করেছিলে যারে তুমি চরণে চুম্বন,
তারে ফেলে যমুনায় কাদিলে কি হায়,
ছেড়ে গেছে মা আমার কৈলাশ ভুবন।।
গেল নাচানাচি শত আতসবাজি,
ঢাকির ঢাকবাজি, আজ বিদায়ী লগন,
নাই নাই বেলা, ভেঙ্গে গেছে খেলা,
কাঁদে অবলা মাতাল রাজ্জাকের মন।।
লেখক:- সূফী কবি বাউল
মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান।
এটিকে একটি গভীর আত্মতত্ত্বমূলক গান হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, যেখানে দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্যকে মানুষের জীবনচক্র ও আধ্যাত্মিক যাত্রার রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আত্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা:-------
গানটির প্রতিটি অংশ মানব জীবনের বিভিন্ন ধাপ এবং নশ্বরতার ধারণাকে তুলে ধরে:
১. কৈলাসে ভোলা কাঁদে: (বিচ্ছেদ ও শূন্যতা)
'কৈলাসে ভোলা কাঁদে একেলা,
ছিঁড়ে গেছে গাঁথা মালা গলার বাঁধন,
হবে প্রতিমা বিসর্জন...':
ভোলা' বা মহাদেব এখানে বিচ্ছেদ-কাতর আত্মার প্রতীক। দেবী দুর্গা হলেন শক্তির প্রতীক, যা জীবাত্মার ভেতরের দিব্য চেতনা বা পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষা। দেবী চলে যাচ্ছেন মানে আত্মা তার পূর্ণতা বা ঐশ্বরিক শক্তিকে হারিয়ে ফেলছে। 'ছিঁড়ে গেছে গাঁথা মালা' হলো জীবনের বন্ধন, সম্পর্ক এবং ক্ষণস্থায়ী সুখের ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এই বিচ্ছেদই শূন্যতা ও কান্নার কারণ।
'ছেড়ে গেছে নবমী আসিয়াছে দশমী।
হবে প্রতিমা বিসর্জন...':
নবমী হলো পূর্ণতা ও আনন্দের প্রতীক,
যখন সাধনা পূর্ণ হয়। দশমী হলো সেই আনন্দের পরিসমাপ্তি, অর্থাৎ মৃত্যু বা পার্থিব জীবনের শেষ। এই অংশটি জাগতিক সবকিছুর নশ্বরতা এবং চিরন্তন সত্য—'যা আসে, তা যায়'—তাকে নির্দেশ করে।.
২. বানাইয়া চালি চাঙ্গে তুলি:
(সৃষ্টি ও আসক্তি)
'বানাইয়া চালি চাঙ্গে তুলি,
রং তুলিতে তারে করিয়া বরণ...':
'প্রতিমা' হলো মানুষের শরীর, মন ও অহংকারের প্রতীক। মানুষ যত্নে নিজের শরীরকে তৈরি করে, লালন করে (রং তুলিতে বরণ), জাগতিক সুখ-সম্পদ দিয়ে সাজায়। 'চালি চাঙ্গে তোলা' হলো পার্থিব আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তির উচ্চ স্থানে স্থাপন করা।
'শত ঢাক বাড়ি,
নাড়ু চিড়া মুড়ি,
আহা মরি মরি করি
পূজার আয়োজন।।':
এটি জীবনের উৎসর্গ, কর্ম ও উৎসবের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। আমরা কত আড়ম্বর করে জীবন যাপন করি, কতো অনুষ্ঠান করি—কিন্তু সবই ক্ষণস্থায়ী।
৩. সপ্তমী সাদরে পূজার মন্দিরে:
(ক্ষণস্থায়ী ভালোবাসা ও মোহ)
'সপ্তমী সাদরে পূজার মন্দিরে,
করেছিলে যারে তুমি চরণে চুম্বন...':।
এখানে বোঝানো হচ্ছে, আমরা জীবন ভরে যাকে ভক্তি করি, ভালোবাসি, তার প্রতি মোহ তৈরি করি; সেই 'মা' বা দিব্য শক্তি বা প্রেম মাত্র কয়েক দিনের জন্য আসে।
'তারে ফেলে যমুনায়
কাঁদিলে কি হায়,
ছেড়ে গেছে মা আমার
কৈলাশ ভুবন।।':
যমুনায় ফেলে দেওয়া হলো জাগতিক আসক্তি বা শরীরকে ত্যাগ করা বা বিসর্জন দেওয়া। বিসর্জনের পর যে কান্না, তা হলো মোহভঙ্গ ও শূন্যতার কান্না। সাধক বলছেন, তুমি যাকে এত আদর করে ডেকেছিলে, সে তো তোমার জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে তার চিরন্তন ধামে (কৈলাশ ভুবন/মোক্ষ) ফিরে গেছে। এটি ইঙ্গিত করে যে পার্থিব আকর্ষণগুলো ছেড়ে আত্মা তার উৎসের দিকে ফিরে যায়।
৪. গেলো নাচানাচি শত আতসবাজি:
(বিদায় ও বৈরাগ্য)
'গেল নাচানাচি শত আতসবাজি,
ঢাকির ঢাকবাজি,
আজ বিদায়ী লগন...':।
এটি জীবনের আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়, যশ-খ্যাতির প্রতীক, যা সময় ফুরালে স্তব্ধ হয়ে যায়। বিদায়ী লগন হলো জীবনের অন্তিম মুহূর্ত।
'নাই নাই বেলা,
ভেঙ্গে গেছে খেলা,
কাঁদে অবলা মাতাল
রাজ্জাকের মন।।':
ভেঙে গেছে খেলা' হলো জীবনের মায়া-খেলার সমাপ্তি। কবি নিজেকে 'অবলা মাতাল' বলছেন, যার অর্থ তিনি মোহমুক্ত, ঈশ্বরের প্রেমে বিভোর কিন্তু একই সঙ্গে এই নশ্বরতার সত্য উপলব্ধি করে বেদনাগ্রস্ত। রাজ্জাক দেওয়ানের এই কান্না জাগতিক দুঃখের নয়, বরং পরম সত্য উপলব্ধির পর ক্ষণস্থায়ী মায়ার জন্য এক প্রকার বৈরাগ্য ও আকুতি প্রকাশ করে।
মূল আত্মতত্ত্ব:-------
গানটির মূল আত্মতত্ত্ব হলো নশ্বরতা, বৈরাগ্য ও প্রেমের বিচ্ছেদ-বেদনা। দেবী দুর্গা প্রতিমা রূপে আমাদের জীবনে আসেন (জন্ম), আমরা তাঁকে নিয়ে মেতে উঠি (জীবন), তারপর তাঁকে বিসর্জন দিতে হয় (মৃত্যু)। এটি জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন-বিচ্ছেদের চিরন্তন খেলা। সাধক এই খেলার শেষ পরিণতি দেখে শোকাহত, কারণ তিনি জানেন এই মায়া ক্ষণস্থায়ী এবং সবকিছুর শেষ গন্তব্য হলো শূন্যতা ও কৈলাশ।
সাধন তত্ত্বে (দেহতত্ত্ব) ব্যাখ্যা:-----
এই গানে ব্যবহৃত প্রতিটি প্রতীককে দেহের অভ্যন্তরের শক্তি, চক্র ও সাধন প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়:
১. কৈলাস ও ভোলা: সহস্রার ও যোগী
'কৈলাসে ভোলা কাঁদে একেলা...': 'কৈলাস' হলো মানব দেহের সর্বোচ্চ চক্র - সহস্রার (সহস্রদল পদ্ম)। 'ভোলা' বা শিব হলেন এই সহস্রারের অধিপতি, যা পরমাত্মা বা স্থির চেতনার প্রতীক।
'ছিঁড়ে গেছে গাঁথা মালা গলার বাঁধন...': এই বাঁধন হলো ষট্-চক্রের (মূলাধার থেকে আজ্ঞা পর্যন্ত) বন্ধন। যখন সাধক সাধনা করে কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগিয়ে সহস্রারে নিয়ে যান, তখন এই চক্রের বাঁধন শিথিল হয়।
কান্না বা বিচ্ছেদ: এটি সাধকের সেই আক্ষেপ, যখন তিনি জানতে পারেন যে জাগতিক 'মা' বা শক্তিতত্ত্ব (কুণ্ডলিনী) স্বল্পকালের জন্য ওঠে আবার নেমে যায়। পরমাত্মা (ভোলা) স্থির, কিন্তু শক্তি (দুর্গারূপ) স্থায়ী হয় না।
২. প্রতিমা বিসর্জন: শক্তির উত্থান ও পতন
'হবে প্রতিমা বিসর্জন... ছেড়ে গেছে নবমী আসিয়াছে দশমী।': 'প্রতিমা' হলো জাগতিক শক্তি বা মায়ারূপী শক্তি, যা কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ। সাধক মনে করেন, সাধনা করে তিনি শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন (নবমী), কিন্তু এই শক্তিকে ধরে রাখতে না পারার কারণে তা আবার সুষুম্না পথে নেমে যায় (দশমী/বিসর্জন)।
দেহতত্ত্বে পূজা মানে হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মন্ত্র জপ বা বিশেষ যোগক্রিয়া। যখন শ্বাস স্থির হয় (পূজার আয়োজন), তখনই শক্তির ক্ষণিক প্রকাশ ঘটে।
৩. চালি ও রঙ তুলি: নশ্বর দেহ ও মায়া
'বানাইয়া চালি চাঙ্গে তুলি, রং তুলিতে তারে করিয়া বরণ...': 'চালি' বা প্রতিমার কাঠামো হলো মানব দেহ (স্থূল শরীর)। সাধক এই দেহটিকে পূজার উপকরণ হিসেবে তৈরি করেন (যোগের মাধ্যমে শুদ্ধ করেন)। 'রঙ তুলি' হলো জাগতিক আসক্তি, কাম, ক্রোধ, অহংকার—যা দিয়ে মানুষ তার দেহকে সজ্জিত করে এবং এতে লিপ্ত থাকে।
'সপ্তমী সাদরে পূজার মন্দিরে...': 'পূজার মন্দির' হলো দেহের অভ্যন্তর। সাধক যে দিব্য আনন্দ বা প্রেমানুভূতি (চরণে চুম্বন) লাভ করেছিলেন সাধনার মাধ্যমে, তা ক্ষণস্থায়ী।
৪. যমুনা ও মাতাল মন: ইড়া, পিঙ্গলা ও স্থিরতা
'তারে ফেলে যমুনায় কাঁদিলে কি হায়...': যোগশাস্ত্রে ইড়া (চন্দ্র নাড়ি/বাম স্বর) এবং পিঙ্গলা (সূর্য নাড়ি/ডান স্বর) প্রধান। 'যমুনা' বা নদী সেই স্রোতের প্রতীক, যেখানে এই শক্তি প্রবাহমান। শক্তিকে যখন জাগতিক ভোগের পথে বিসর্জন দেওয়া হয় বা তা নিম্নমুখী হয়, সাধক তখন হতাশ হন।
'ভেঙ্গে গেছে খেলা, কাঁদে অবলা মাতাল রাজ্জাকের মন।।': 'মাতাল' শব্দটি এখানে জাগতিক মদে নয়, বরং ঈশ্বরের প্রেমরসে বিভোর হওয়াকে বোঝায়। 'খেলা ভেঙে যাওয়া' মানে হলো যোগভঙ্গ হওয়া বা সাময়িক সাধনার সমাপ্তি। সাধক রাজ্জাক দেওয়ানের অবলা মন তখন আক্ষেপ করে যে, এই দেহের মধ্যে স্থায়ীভাবে সেই দিব্য শক্তিকে ধরে রাখা গেল না।
মূল সাধন তত্ত্বের সারমর্ম:-----
সাধন তত্ত্বে এই গানটি মূলত সাধকের শক্তি জাগরণের চেষ্টা এবং তা ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতার হাহাকার। প্রতিমা বিসর্জন হলো যোগভ্রষ্ট হওয়া বা জাগতিক টানে আবার শক্তিতত্ত্বের অধোগমন। সাধকের চরম লক্ষ্য থাকে এই বিসর্জন প্রক্রিয়াকে থামিয়ে, শক্তিকে সুষুম্না পথে সহস্রারে (কৈলাস) স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
_________________________
সফর পা'গ'লা (এডমিন )
০২-১০-২০২৫ খ্রিস্টাব্দ