
27/06/2025
গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের খুব কম অফিসে কম্পিউটার ছিল। যেসব অফিসে কম্পিউটার ছিল, তাদের ভাবই ছিল আলাদা।
যদিও তারা সাধারণত কেবল টাইপরাইটারের বিকল্প হিসেবে কম্পিউটার ব্যবহার করত।
সেই কম্পিউটার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখতে হতো, যার মেঝেতে কার্পেট বিছানো থাকত এবং সেই ঘরে জুতো খুলে প্রবেশ করতে হতো।
কারও সর্দি-জ্বর হলে সেই ঘরে ঢুকত না, পাছে কম্পিউটার 'ভাইরাস আক্রান্ত' হয়ে পড়ে!
ঐ সময়ে দেশে প্রথম কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (CSE) স্নাতক পর্যায়ে পড়ার সুযোগ হয়।
প্রতিবছর মাত্র ৩০ জন সেই সুযোগ পেত, ফলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বড় অংশের ধ্যানজ্ঞান ছিল সিএসইতে পড়া।
যারা এসএসসি বা এইচএসসিতে বোর্ডের মেধা তালিকায় থাকত, সাংবাদিকেরা তাদের জিজ্ঞেস করত, বড় হয়ে কী হতে চাও?
তারা গর্বের সাথে উত্তর দিত, কম্পিউটার বিজ্ঞানী/প্রকৌশলী হতে চাই।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে কম্পিউটার খুব দুর্লভ ছিল না, তবে খুব সহজলভ্যও ছিল না।
সেই সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনফ্রেম কম্পিউটারে যৎসামান্য কাজ করতে পেরেছিলাম, যেখানে মাত্র তিন নাকি পাঁচ লাইন প্রোগ্রাম লেখা যায় এমন আকারের মনিটর।
সেখানে একটা কাজ করে প্রিন্ট কমান্ড দিলে তিন দিন পরে কম্পিউটার ল্যাবের বিশালাকৃতির একমাত্র প্রিন্টার থেকে ডট প্রিন্টারে কাগজের রোলে প্রিন্ট পাওয়া যেত।
সেখানে কাজ করে সোয়া পাঁচ ইঞ্চির ডিস্কেট অথবা সাড়ে তিন ইঞ্চির এইচডি বা ডিডি ফ্লপি ডিস্কে করে বাসায় নিয়ে আসতে হতো।
সেই ডিস্কের ধারণক্ষমতা ছিল ১.৪৪ মেগাবাইট!
১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে জীবনে প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পেলাম।
ঘটনাক্রমে অফিসের একমাত্র ইন্টারনেট সংযোগটি আমার কম্পিউটারে দেওয়ায় আমার ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হলো।
কম্পিউটারকে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত করার জন্য একটি ডেটা কেবল দিয়ে মডেমের সাথে যুক্ত করতে হতো।
মডেমকে আবার টেলিফোন লাইন আর পাওয়ার লাইনের সাথে যুক্ত করতে হতো। মডেমের সুইচ টিপে চালু করে কম্পিউটারে Trumpet Winsock নামের একটি প্রোগ্রাম দিয়ে dialup network-এর সাথে যুক্ত হবার চেষ্টা করতে হতো।
মডেম যখন ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে থাকত, তখন অদ্ভুত এক আওয়াজ করত। সেই আওয়াজ আমার মাথায় চিরস্থায়ী হয়ে গেছে।
মডেমে অনেকগুলো লাল আলো জ্বলে-নেভে, যেটা দিয়ে কানেকশনের অবস্থা বোঝা যায়।
একটা বিশেষ আলো লাল থেকে সবুজ হওয়ার মানে হচ্ছে কম্পিউটার ১৯,২০০ বিট/সেকেন্ডের (০.০১৯২ এমবিপিএস!) ইন্টারনেট লাইনের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে।
কাজ শেষ হলে মডেমের সুইচ টিপে বন্ধ করে রাখা হতো। প্রতি মিনিট ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য দুই প্রকারের বিল দিতে হতো।
এক, আইএসপিকে তাদের সেবা ব্যবহার করার জন্য; দুই, টিঅ্যান্ডটিকে তাদের টেলিফোন লাইন ব্যবহার করার জন্য।
আমাদের সার্চ ইঞ্জিন ছিল মূলত Yahoo! এর বাইরে Lycos, Altavista, AskJeeves-এসবও ব্যবহার করতাম। তবে Yahoo! বেশি পছন্দের ছিল। মাথায় যে শব্দ আসত, সেটা দিয়ে খুঁজতাম এবং বেশির ভাগ সময়ে কিছুই মিলত না।
আমাদের ধারণা ছিল, অমুক নামের শেষে .com লিখলেই সেটার ওয়েবসাইটে পৌঁছে যাওয়া যায়।
সেটা কখনো কখনো যে মিলত না, তা নয়, তবে বেশির ভাগ সময়ে কিছু মিলত না।
cricinfo. org নামের একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ পাওয়া গেল, যেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেট ম্যাচের বল টু বল খবর প্রায় সাথে সাথে পাওয়া যায়।
যেহেতু টেলিভিশনে সব খেলা দেখাত না, তাই আমরা এই সাইটের মাধ্যমে ক্রিকেটের খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম।
১৯৯৭ সালের মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশ যখন মালয়েশিয়াতে আইসিসি কাপ খেলতে গেল, তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন খেলা সম্প্রচার করছিল না।
'রেডিও বাংলাদেশ' (বাংলাদেশ বেতারের তখনকার নাম) খেলার চলতি ধারাবিবরণী স¤প্রচার করলেও অফিসে বসে সেটা শোনার উপায় ছিল না।
ফলে এই ওয়েবসাইটের সাহায্যে আমরা খেলার মোটামুটি সর্বশেষ খবর পেয়ে গেলাম।
সেবার বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আইসিসি কাপ জিতে ক্রিকেট বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
mIRC নামের একটি ইন্টারনেট রিলে চ্যাট ক্লায়েন্ট ছিল (আসলে এখনো আছে)। সেটা দিয়ে অনলাইন চ্যাটের যুগ শুরু হলো।
এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে গেল। ই-মেইলের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা বিশেষ শোনা না গেলেও mIRC-এর চ্যাটের মাধ্যমে প্রেম হওয়ার ঘটনা আকছার ঘটতে থাকল।
এক বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, যেখানে পাত্র-পাত্রীর পরিচয় ও প্রেমের শুরু mIRC-এর চ্যাটের মাধ্যমে। অন্য রকমের ঘটনাও ছিল।
আমাদের এক পুরুষ বন্ধু আমাদেরই আরেক পুরুষ বন্ধুর সাথে নারী সেজে টানা কয়েক মাস চ্যাট চালিয়ে যায়।
তাদের আলাপ 'প্রেমালাপের' দিকে মোড় নিতে থাকে। এই প্রকারের ভার্চ্যুয়াল ভুয়া নারীকে বলা হতো 'ছাইয়া' (মাইয়া থেকে ছাইয়া)।
একসময়ে ছাইয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সাবধানী লোকজন পরিচয়ের গোড়ার দিকেই ফোনে কথা বলে নিতেন।
লেখা: জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ (TBS)