10/10/2024
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের চাকুরীর এনট্রি লেবেলে আমি নবম গ্রেড দেওয়ার কথা কেন বলি?
তার আগে ক্লিয়ার করে বলে রাখি। শিক্ষকতা এমন একটা একই সাথে পেশা ও মিশন যার সাথে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। কারণ শিক্ষা সব রকমের উন্নয়ন বলেন কিংবা ভাল কিছু বলেন তার মুল। শিক্ষায় উন্নত হলে রাষ্ট্র ও সমাজের অন্য সব কিছুতে যেমন তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, ঠিক তেমনই শিক্ষায় গলদ থাকলে অন্য সবকিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।
আর ভাল শিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা বা এক কথায় আধুনিক দুনিয়ায় উন্নত মানের শিক্ষা বলতে যা বুঝায় তার জন্য ভাল ভাল শিক্ষক দরকার। আর ভাল শিক্ষক পাওয়ার জন্য মেধাবী মেধাবী ছেলেমেয়েদের এই পেশায় নিযুক্ত করা প্রয়োজন। এখন কথা হল ভাল বেতন ভাতা ও সুযোগ সুবিধা না দিলে কেন মেধাবী ছেলেমেয়েরা এই পেশায় আসবে। এটা একেবারেই অবাস্তব কথা। এ কারণেই দুনিয়ার সব দেশে এমনকি এই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের দিকে তাকান তারা শিক্ষা খাতে তাদের জিডিপির সর্বোচ্চ বরাদ্দ করে। তাদের শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও সুযোগ সুবিধা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
একজন শিক্ষক যে লেভেলেরই হন তিনি শিক্ষক। আর আমাদের দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক এই বার ক্লাস হচ্ছে মৌলিক ভিত্তি। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এই বার ক্লাস তার জীবনের ভিত্তি তৈরী করে দেয়। সে কোন দিকে যাবে, কোন ফিল্ডে কাজ করবে, কেমন নীতি নৈতিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে এটা ব্যাপকভাবে নির্ধারিত হয় মুলত এই স্তরে। আন্ডারগ্রাড বা গ্রাড লেবেলে হয়ত উচ্চতর বিজ্ঞান ও দর্শন কিংবা বিভিন্ন দক্ষতা শেখানোর থাকতে পারে, কিন্তু সে সবের যে বেসিক ইনগ্রেডিয়েন্টস সাথে জীবনের জন্য মূল্যবান যে নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ তা উচ্চ শিক্ষা স্তরে শেখানো যায় না। সুনাগরিকের আসল দীক্ষা মূলত একটি ছেলে বা মেয়ের আধুনিক হিসাবে আঠার বছরের আগেই হয়।
কাজেই এই আঠার বছরের মধ্যে যে শিক্ষকগণ পাঠদান করেন তাদের আর্থিক সামাজিক সামর্থ্যের দিকটা উপেক্ষা করে ভাল এডুকেশন আউটপুট আশা করা যায় না।
এখন প্রশ্ন হল এন্ট্রি লেবেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি নবম গ্রেড পান তাহলে মাধ্যমিক, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোন গ্রেড পাবেন? তারাও নবম গ্রেড পাবেন। অসুবিধা কী? এতে কি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইজ্জত চলে যাবে? শিক্ষকদের মধ্যে আবার ইজ্জতের উচু নিচু নিয়ে ব্যবধান করার কী আছে? শিক্ষক তো শিক্ষকই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক--এই কারণে তাকে নিচে রাখতে হবে? তার ইজ্জত নিচু স্তরের? এই ধরনের শ্রেণীভিত্তিক অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক চিন্তা কাঠামো অন্তত শিক্ষায় থাকতে পারে না। এটা এক ধরনের ব্যাধি। তবে পরবর্তি ধাপগুলিতে কোন স্তরের শিক্ষক কোন ধাপ পর্যন্ত যেতে পারেন তা নিয়ে কথা থাকতে পারে, সেখানটায় ব্যবধান থাকতে পারে। কিন্তু এন্ট্রি লেভেলে সব স্তরের শিক্ষকেরই প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থাকাটাই ন্যায়বিচার।
কেউ কেউ আবার বলছেন যে সিভিল সার্ভিসের অফিসাররা চাকুরীর এন্ট্রি লেভেলে প্রথম শ্রেণীর মানে নবম গ্রেডের বেতন ভাতাদি পান। তাহলে প্রাথমিক শিক্ষকদের নবম গ্রেড দিলে তাদেরকেও বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে। কি অদ্ভুত এবং শ্লেষাত্মক কথাবার্তা। কী পরিমাণ অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং অহংবোধ থাকলে এমন কথা কেউ বলতে পারে। একজন শিক্ষকের মর্যাদা এবং ভৃমিকার দিকে গুরুত্ব আরোপ না করে তার বাছাই প্রক্রিয়ার দিকে আবার কিনা বিসিএস বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। এই দেশে বিসিএস কোয়ালিফাই মানেই যেন সব এক একজন আইনস্টাইন আর নিউটন। বিসিএস কোয়ালিফাই করলেই যেন এক্কেবারে সমাজের উচু তলায় পা রাখল। এই ধরনের মনোবৃত্তি নিতান্তই সমস্যাবহুল। বিসিএস একটা বাছাই পরীক্ষা মাত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমেই নিয়োগ দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই বাছাই প্রক্রিয়াটা ফেয়ার হলো কিনা। বিসিএস এর মাধ্যমে যদি ফেয়ারলি সিলেকশন হয় আর এর বাইরে অন্যভাবে ফেয়ার সিলেকশন হয় তাহলে কোনটা উত্তম আর কোনটা অধম? তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লক্ষ লক্ষ শিক্ষকদের পিএসসি বাছাই করার সক্ষমতা রাখে? যদি রাখে তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ করতে কোন অসুবিধা থাকার কথা না। কিন্তু পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ করলে সবাই ব্রাহ্মণ আর বাকী সকলে এক প্রকার নমশুদ্র এই জাতীয় চিন্তা অযৌক্তিক ও অন্যায্য।
কেউ কেউ আবার বলছেন সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লক্ষ লক্ষ শিক্ষক। তাদেরকে নবম/দশম গ্রেড দিলে প্রচুর টাকার দরকার হবে। রাষ্ট্রের সেই সামর্থ আছে কিনা। এটা একটা ভাল পয়েন্ট। বাস্তব কথা। এ জায়গাতেই আমি বলতে চাই শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। কেবল প্রাথমিক নয়, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরে বাজেট বাড়িয়ে টাকা খরচ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে অন্যান্য উচ্চাবিলাশী মেগা প্রকল্প বাদ দিয়ে হলেও সেই টাকা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। ধরুন, আপনি মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠালেন, সমুদ্রের নিচ দিয়ে উন্নত জাপানের মত টানেল তৈরী করলেন। আর ওদিকে আপনি শতকরা একশ ভাগ ছেলেমেয়ের স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারলেন না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ভাল শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাদেরকে আকর্ষণীয় বেতন ভাতা ও সুবিধা দিতে পারলেন না। ভাল শিক্ষক পেলেন না। আবার যাদেরকেও পেলেন তাদেরকে গবেষণা ফান্ড দিতে পারলেন না। ছাত্রছাত্রীদের ভালভাবে থাকার জন্য আধুনিক মানসম্মত হল বা ডরমেটরি দিতে পারলেন না। তাদের স্কলারশিপ দিয়ে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারলেন না। তো কোনটা জরুরী এগুলি নাকি সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে টানেল বানানো কিংবা মহাশূণ্যে স্যাটেলাইট পাঠানো? আমি বলছি না এগুলি করা যাবে না। কিন্তু তার আগে প্রায়োরিটি ঠিক করা লাগবে। আমাদের শিক্ষার যে হাল তাতে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে এইসব উচ্চাকাঙ্খী বিলাশী প্রজেক্ট গরীবের ঘোড়া রোগের মত। আগে তো আপনি ঘর ঠিক করবেন। তারপর না ফ্রিজ, কম্পিউটার, এসি কিনবেন। আপনার ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে, আপনার ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য একটা টেবিল নাই আর আপনি এসি আর কম্পিউটার কিনছেন। শিক্ষা ঠিক করা হলো ঘর ঠিক করা। জাতিসংঘ জিডিপির সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করার সুপারিশ করছে। 1974 সালেও একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জিডিপির চার শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল। সেটা কমতে কমতে এখন দুই শতাংশের নিচে নেমে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত পাকিস্তানের কথা আর নাই বললাম, নেপাল ভুটান শ্রীলঙ্কা মালদ্বীপ এমনকি আফগানিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষা খাতে বেশী বরাদ্দ করে। ভারত পাকিস্তানের শিক্ষকরা কত বেতন ভাতা পান একটু তলিয়ে দেখুন। কাজেই একজন শিক্ষক সে যে লেভেলেরই হোক তাকে আপনি তৃতীয় শ্রেণী রেখে শিক্ষার উন্নয়ন করবেন? অসম্ভব! অন্যায্য।
একটা অভিযোগ প্রায়ই দেখি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রিডিং পড়তে পারে না। এটা একটা ভয়াবহ কথা। আমি নিজে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি। আমাদের সময়ে তো আমরা এমনটি দেখিনি। কেন গত তিন/চার দশকে এমনটি ঘটল? এখন শুনেছি শিক্ষকরা বেত নিয়ে ক্লাসে যেতে পারেন না। বেতের কালচার নেই। এমনকি কড়াভাবে ছেলেমেয়েদের শাসনও করতে পারেন না। এই পলিসিও কি এ ক্ষেত্রে আংশিক হলেও দায়ী কিনা ভেবে দেখা উচিত। কারণ আমাদের সময়ে যখন এই শাসন ছিল সব ছাত্রছাত্রীই কেবল রিডিং পড়া নয়, ভাল পড়াশোনা করত। আর জবাবদিহিতার কথা বললে শিক্ষকদেরও জবাবদিহিতা থাকতে হবে এবং সেটা আছে।
অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আমি শেষ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদেরকে এই সরকারি পে স্কেল বা গ্রেডে রাখার পক্ষে না। আমি মনে করি শিক্ষকদের সাথে অন্য কোন পেশার তুলনা হতে পারে না, থাকা উচিত না। একজন ইট ভাটার শ্রমিকের এক ঘন্টার শ্রম আর একজন বিজ্ঞানীর এক ঘন্টার শ্রম এক হয় না (নিশ্চয়ই শ্রমিকের শ্রম ও কাজ সম্মানিত হলেও)। আমি মনে করি প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তর পর্যন্ত শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ও উচ্চতর বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা উচিত যার সাথে অন্যদের কোন তুলনা হবে না।
আর সেটা না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে দশম গ্রেডের (আগের প্রথম শ্রেণীর বা নবম গ্রেড হওয়া উচিত আমার মতে) দাবী তা ন্যায্য মনে করি। প্রাথমিক শিক্ষকদের অবহেলিত রেখে রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
জনাব মোঃ নজরুল ইসলাম
অধ্যাপক, শাবিপ্রবি