21/06/2025
১-
৫ আগস্টে হাসিনার পতনের খবর যখন জেলখানায় আসল তখন জেলের কয়েদীরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। সবাই আনন্দ উল্লাস করছিল। যে যাকে দেখছে কোলাকোলি করছিল। মনে হয় যে আজ ঈদ। অনেকে আনন্দে শ্লোগান দিচ্ছিল। অনেকে আল্লাহর দেয়া এই নেয়ামতের জন্য সিজদাহ করছিল। অনেকে আনন্দে কান্না করছিল। ঠিক ঐ সময়ে মাহীন তার সেলে বসে অঝোর ধারায় কান্না করছিল। অন্যান্যদের মত মাহীনের কান্না আনন্দের ছিল না। মাহীনের কান্নাটা ছিল দুঃখের, শোকের। তার হাতে একটা কাগজ ছিল। কাগজটা ছিল তার ডিভোর্স পেপার ও তার স্ত্রী সায়মার শেষ চিঠি।
৮ বছর আগে মাহীন গুম হয়েছিল। তারপর ৬ মাস পরে জেলে পাঠানো হয়েছিল। গুম হবার সময় মাহীনের বিয়ের বয়স ছিল মাত্র ৩ মাস। মাহীন বিরোধী দলের রাজনীতি করত। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছিল। ৩ টা মামলায় মাহীনের অলরেডি ১১ বছরের সাজা হয়েছিল। আরো ৩ টা মামলা বিচারাধীন। সেগুলোতেও নিস্তার হবে না। মাহীনের ও তার পরিবারের ধারনা ছিল হাসিনা যতদিন বেঁচে থাকবে মাহীনের ততদিন মুক্তি মিলবে না। পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল হাসিনা মরবে না, তার ক্ষমতাও আজীবন থাকবে। তাই মাহীনের পরিবারের মত মাহীনের শশুরবাড়ীর পরিবারের লোকজনও মাহীনের মুক্তির ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তারা মাহীনের স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়ার ব্যাপারে চাপ দিচ্ছিল। স্বামীর জন্য কয়েক বছর অপেক্ষা করে সায়মা মাহীনকে ডিভোর্স দেয়।
২-
অক্টোবরের শেষের দিক। ধুলোমাখা, বিবর্ণ কাপড়ের একটি লোক গ্রামের মেঠো পথ ধরে হেঁটে আসছে। তার শরীর জুড়ে দীর্ঘ ক্লান্তির ছাপ, চোখের কোণে জমা হয়েছে না ঘুমানোর কালি। শেষের কয়টা দিন মুক্তির উত্তেজনায় মাহীনের ঘুম আসত না। আটটি বছর! দীর্ঘ আটটি বছর পর মাহীন তার গ্রামে ফিরে এসেছে।
গ্রামের পথঘাট তেমন বদলায়নি, তবে মাহীনের চোখে সবকিছু যেন কেমন অচেনা লাগছে। পরিচিত বটগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে, তবে তার চারপাশে যেন নীরবতার চাদর বিছানো। বুকের ভেতর একটা চাপা উত্তেজনা আর অজানা আশঙ্কা নিয়ে মাহীন তার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
কিছুদূর যেতেই থমকে দাঁড়ায় মাহীন। যেখানে তাদের পুরনো বাড়িটা ছিল, সেখানে এখন ইটের গাঁথুনির একটা নতুন দোতলা বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। তার বাবার হাতে লাগানো আম গাছটা কোথায়? মায়ের ফুলের বাগান? কিছুই তো নেই! মাহীনের বুকটা ধক্ করে ওঠে।
মাহীনের পিছনে এই কয় বছরে অনেক টাকা ঢেলেছিল তার পরিবার। জমি জামা অনেক বেচতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কি ভিটাও বেচে দিয়েছে?
দুই বছর আগে মাহীনের মা ও তিন বছর আগে মাহীনের বাবা মারা যায়। মাহীনের বৌ ছেড়ে চলে গেছে। বাড়ীতে এসে দেখে ভিটার উপরে দোতলা বাড়ী। এসব নিয়ে মাহীনের চিন্তা নেই এখন। ডাইনিটা চলে গেছে আর মাহীন মুক্তি পেয়েছে এটাই এখন অনেক বড় প্রাপ্তি। তার যদি মুক্তি না হতো তাহলে কী হতো এই জমি দিয়ে?
৩-
মাহীন বাড়ীতে প্রবেশ করলে বড় চাচা আবদুল্লাহ মুন্সী তাকে স্বাগত জানায়। ব্যাখ্যা দেয়ার ভঙ্গিতে বলেন “আইছো বাপ! আসলে তোমার বোন রিফার জন্য সম্মন্ধ আসছিল। ছেলে বিদেশ থাকে, হাতে সময় কম। গতকাল তারা একদিনের নোটিশে রিফাকে দেখতে আসছিল। তাই আমি যাই নাই বাপ।” রিফা মাহীনের চাচাতো বোন। এই রিফাকে মাহীন শেষ যখন দেখেছিল তখন রিফার বয়স ছিল এগার কি বারো।
“না গিয়ে ভালোই করেছেন। কোর্টের আদেশ আসতে একদিন দেরি হইছে। পরদিন সকালে ছাড়ার কথা বললেও ছাড়তে ছাড়তে বিকাল হয়ে গেছে। আমি ঢাকার এক পরিচিত লোকের বাসায় রাত ছিলাম। সেখান থেকে সকালের বাসে উঠছি।”
মাহীনের কন্ঠ শুনে দুই চাচী আসলেন। মিলনের আনন্দে আজ সবার চোখে পানি।
৪-
মা বাবার কবর জেয়ারত করা ছিল মাহীনের প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ ছিল গ্রামের বাজারে যাওয়া। কিন্তু কী মনে করে সে বাজারের দিকে গেলো না।
রাতে খেতে খেতে মাহীনের দুই চাচা ব্যাখ্যা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল “ভাইজান (মাহীনের বাবা) মারা যাওয়ার পরে মাহীনের মা একা হয়ে পড়েন। উনি পুরনো বাড়ীতে একা থাকতে পারতেন না। ভাবিকে আমাদের সাথেই রাখি। আমাদের বিল্ডিং করার দরকার হয়ে পড়ল। তাই ভাবির সাথে পরামর্শ করেই তোমার ভিটা ভেঙ্গে নতুন বাড়ী বানাই। তুমি যেহেতু আসছো তোমাকে সম পরিমান জমি দিয়ে দিব। সকালে তুমি দেখিয়ে দিবা, যে জমি তোমার পছন্দ সেটাই তুমি পাবা।”
“বাড়ী ঘর নিয়ে আমার আগ্রহ নাই চাচা। আমার একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার। আমি বেশিদিন গ্রামে থাকব না। শহরে চলে যাব। মাঝে মাঝে গ্রামে আসলে আমাকে একটু শোয়ার জায়গা দিবেন।”
“কী বলো বাবা, তোমার জায়গায় তুমি থাকবা না তো কে থাকবে?”
এই শনিবার রিফার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে, রবিবার বিয়ে, সোমবারে বৌভাত হবে। বিয়েতে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশি সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। মাহীন বুঝতে পেরেছে তার উপস্থিতি বিয়ে বাড়ির লোকজনকে স্বস্তি দিচ্ছে না। মাহীন চাচাকে বলল “আমার যে মুক্তি হয়েছে তা কাউকে জানাবেন না। আমি দীর্ঘদিন অন্ধকারে ছিলাম। এখন অন্ধকার ভালো লাগে। আমাকে একটা রুম দেন যেখানে আলো আসবে না। ছোট চাচার বাড়ির একটা রুমে মাহীনের জায়গা হলো।
৫-
“কে?”
“ভাইয়া, পানি।” একটা যুবতী মেয়ে একটা খালি গ্লাস ও একটা পানি ভর্তি জগ এনে মাহীন যে রুমে শুয়েছে সেখানকার একটা টেবিলে রাখল।
“তুই রিফা না?” মাহীনের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে রিফার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
“জ্বী ভাইয়া।” সলজ্ব কণ্ঠে রিফা বলল।
“তোকে সেই ছোট দেখেছি। মাশাল্লাহ অনেক বড় হয়ে গেছিস।”
“আজীবন কি তোমার বোন ছোট থাকবে?”
“তাও অবশ্য কথা। আমি বাড়ি এসেছি আর তুই শশুর বাড়িতে চলে যাবি।”
রিফা গ্লাসে পানি ঢালতে লাগল। মাহীনের মনে হচ্ছে রিফা মাহীনকে কিছু বলতে চায়। “কিছু বলবি?”
“না ভাইয়া, এমনিতে আসলাম।”
“তুই কিছু লুকাচ্ছিস, আমাকে বলে ফেল কিছু বলার থাকলে।”
রিফা মাহীনের পাশে বসল “ভাবি তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে।”
“মানে? তুই কার কথা বলছিস?”
“তোমার বৌ, সায়মা ভাবি…”
“সে আমার বৌ না, সে এখন অন্যের বৌ। এছাড়া আমার খবর সে কীভাবে পেল? আমিতো সবাইকে নিষেধ করেছি আমার উপস্থিতির কথা যেন কেউ না জানে।” মাহীন একটু রেগে যায়।
“আমি বলেছি ভাইয়া” রিফা মাথা নীচু করে বলল।
“ক্যান বললি ? সে কি জানতে চেয়েছে?”
রিফা হাঁ সূচক মাথা ঝাকালো।
বুঝলাম না, আমি আসছি আজ দুপুরে। এলাকাতে বের হইনি। বাইরের কারো সাথে দেখা হয় নি। আমার কথা সায়মা পর্যন্ত গেল কীভাবে? তারা তো আর এখানে থাকে না।
“আমি ফোন করে বলেছি ভাইয়া।” রিফা ভয়ে ভয়ে বলল।
রিফার কথা শুনে মাহীন চুপ করে রইল। ঘটনার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। সায়মা বড় চাচার শশুরের দিকের আত্মীয়। সেই পরিচয়ে তাদের মধ্যে বিয়ে হয়। সায়মা সম্পর্কে রিফার মামাতো বোন হয়। সেই হিসেবে তাদের মধ্যে কথা বার্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রিফা কে আগ বাড়িয়ে বলতে গেল?
রিফা মনে হয় মাহীনের মনের কথা বুঝতে পেরেছে। তাই ব্যাখ্যা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল “৫ আগস্ট বিকালে সায়মা আপু আমাকে কল দিয়ে তোমার কথা বলে। হাসিনা যতদিন ছিল আমরা ভেবেছিলাম তোমাকে ছাড়বে না। যেহেতু সেদিন হাসিনা পালিয়ে গেছে তাই আমাদের মত সায়মা আপুও ভাবা শুরু করেছে একদিন না একদিন তোমার মুক্তি হবে। সে আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। তোমার মুক্তির খবর দুই দিন আগেই তাকে জানিয়েছিলাম। সে তো পারলে জেল গেইটে যায় কিন্তু সেটাতো আর বাস্তবে সম্ভব না।
“সায়মার বাচ্চা কাচ্চা কয়টা রে?”
“এক ছেলে এক মেয়ে”
“ওহ!”
“আরেকটা কথা ভাইয়া। আমার উপর রাগ করোনি তো?”
“ধুর, তোর উপর রাগ করব কেন? এতদিন পরে মুক্ত বাতাসে ঘুরছি এর চেয়ে শান্তি আর নাই। তুই শশুরবাড়ি চলে যাবি এজন্য একটু দুঃখ লাগছে। সবে তো বাড়ি আসলাম। তোর ভাই গুলো সব ঢাকায় সেটেল্ড। তুই একা বাড়িতে।”
“রাগ না করলে একটা কথা বলি।”
“আবার কী বলবি?”
“আমার গায়ে হলুদে সায়মা আপু আসবে। তুমি সেদিন আবার দূরে চলে যেও না।”
মাহীন চেয়েছিল সায়মা থেকে দূরে থাকতে। সে মনে মনে ভেবেছিল শুক্রবারই কোনো একটা উছিলায় ঢাকায় চলে যাবে। বিয়েতে সায়মা এলে তাকে দেখলে তার মন খারাপ হয়ে যাবে। রিফার বিয়ে হলেও সেও মনে হচ্ছে এখনো মাহীন ভাইয়াকে ভুলতে পারেনি।
“এ কথাটা কি সায়মাই তোকে শিখিয়ে দিয়েছে?”
রিফা হাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
রিফা যে আশংকা করেছিল শনিবার সেটাই হয়েছে। ভোরে হঠাৎ মাহীন বাড়ি ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। রিফা সহ চাচা চাচী সবাই ধারনা করেছিল গায়ে হলুদ বিয়ে এসময়ে মাহীন বাড়ি থাকবে না। প্রিয় স্ত্রীর আরেক জায়গায় বিয়ে হয়েছে, তার গর্ভে অন্যের সন্তান জন্ম হয়েছে এটা কোনো পুরুষ মানবে না। তার সাথে তো আর ঝগড়াঝাটি করে ডিভোর্স হয় নি!
-রাজশাহী তানোর নিবাসী ছাত্রশিবিরের জনৈক সাথী ভাইয়ের জীবন থেকে নেওয়া।