06/11/2025
সকালের রোদটা তখনও নরম। যাদবপুরের রাস্তায় তাড়াহুড়ো করে হাঁটছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা। বয়স হবে প্রায় ৮৫ থেকে ৯০। শরীরটা কেমন কাঁপছে, কাঁধের হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায়, তবুও দুই হাত শক্ত করে টানছেন রিকশার হ্যান্ডেল।
কৌতূহলবশত আমি কাছে গিয়ে বললাম —
“বাবা, আপনার তো বয়স অনেক হয়েছে, এখনো রিকশা টানেন?”
উনি প্রথমে কিছু বললেন না, চোখ নামিয়ে রইলেন।
একটু পর নিঃশব্দে বললেন,
“বাবা, অনেক কষ্টে আছি।”
আমি আরও জানতে চাইলাম,
“কেনো এমন কষ্টের কাজ করেন আপনি?”
উনি একবার মুখ তুললেন, তারপর নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—
“আমার কপাল বাবা… আমার কপাল।”
এই বলে চুপ করে গেলেন।
সেই নিঃশব্দ মুহূর্তটা যেন বুকের ভেতর একটা ছুরির মতো বিঁধল।
আমি কিছু না ভেবে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে উনার হাতে দিলাম।
কিন্তু উনি মাথা নেড়ে বললেন,
“না বাবা, আমি ভিক্ষা করি না, আমি কাজ করে খাই।”
সেই একটিমাত্র বাক্য —
“আমি ভিক্ষা করি না, কাজ করে খাই”
আমার পুরো দিনটাকে কাঁপিয়ে দিল।
আমি জোর করে উনার হাতে টাকা রাখতেই উনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
“আল্লাহ তোমারে ভালো রাখুক বাবা।”
তারপর একটু হাসলেন,
“আমার তিন ছেলে, এক মেয়ে — সবাই মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছে।
কিন্তু আমি আর আমার বউ… আমরা একসাথে আছি, রিকশা চালিয়ে খাই।
বৃদ্ধাশ্রমে যাব ভাবি নাই, ওখানে থাকার খরচই বা দিব কেমনে?”
আমি নির্বাক হয়ে গেলাম।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ মানুষ,
যে তার জীবনের সব দায়িত্ব শেষ করেও আজ নিজের ভাতের জন্য ঘাম ঝরাচ্ছে।
তাঁর মুখে ক্লান্তির ছাপ, তবুও একটা শান্তি আছে —
হয়তো সেই শান্তি আসে নিজের হাতে উপার্জনের গর্ব থেকে।
রিকশা চালাতে চালাতে তিনি চলে গেলেন,
আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম —
মাথার ভেতর শুধু ঘুরছিল তাঁর সেই কণ্ঠস্বরে বলা কথাগুলো—
> “বাবা, আমি ভিক্ষা করি না, কাজ করে খাই।”
হয়তো এই সমাজে এমন মানুষরাই সত্যিকারের সম্মানের যোগ্য।
যাদের শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন কখনো হার মানে না।
যাদের কপাল দুঃখে ভরা, কিন্তু আত্মসম্মান এখনো অটুট।
💔এই মানুষগুলোই আমাদের শেখায় —
মানুষ যত গরিবই হোক, নিজের ঘামের দামে খাওয়া ভাতই সবচেয়ে পবিত্র।
হে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার ছেলেরা,
তোমরা আজ হয়তো বড় অফিসে চাকরি করো,
নিজের ঘরে এসি চলে, গাড়ি আছে, ব্যাংকে টাকাও আছে।
কিন্তু তোমাদের বাবা — যিনি একসময় ঘাম ঝরিয়ে তোমাদের মুখে ভাত তুলে দিয়েছিলেন,
তিনি আজ ৯০ বছরের শরীরে রিকশা টানেন, শুধু যেন কাউকে বোঝা না হতে হয়।
তোমাদের লজ্জা হয় না?
যে মানুষটা তোমাদের স্কুলে পাঠাতে নিজের জুতো ছিঁড়ে ফেলেছিলেন,
আজ সে রোদে-ঘামে জ্বলছে, শরীর কাঁপছে, তবুও হাল ছাড়ছে না —
আর তোমরা শুধু চুপ করে আছো?
তোমাদের বাবা ভিক্ষা চাননি, করুণাও চাননি —
শুধু একটু ভালোবাসা, একটু আশ্রয় চেয়েছিলেন,
যেটা তোমরা দিতে পারোনি।
বাবা-মা বুড়ো হয়, বোঝা নয়।
তারা ভালোবাসার সবচেয়ে নির্মল রূপ —
যাদের ভালোবাসা একবার হারালে,
তারপর সারাজীবন কাঁদলেও ফিরে পাবে না।