30/07/2024
আমাদের একটা বিশিষ্ট ধর্ম আছে — সেই ধৰ্ম্মই আমরা অনুসরণ করি।যাহা নূতন , যাহা সরস , যাহা অনাস্বাদিন—তাহারই উপাসক আমরা।আমরা আনিয়া দিই পুরাতনের মধ্যে নূতনকে , জড়ের মধ্যে চঞ্চলকে , প্রবীণের মধ্যে নবীনকে এবং বন্ধনের মধ্যে অসীমকে । ( আমরা অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা সব সময়ে মানিতে প্রস্তুত নই । ) আমরা অনন্ত পথের যাত্রী বটে কিন্তু আমরা অচেনা পথই ভালবাসি - অজানা ভবিষ্যৎই আমাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয় । আমরা চাই “ the right to make blunders , ” অর্থাৎ “ ভুল করিবার অধিকার।" তাই আমাদের স্বভাবের প্রতি সকলের সহানুভূতি নাই , আমরা অনেকের নিকট সৃষ্টিছড়া ও লক্ষ্মীহারা । ইহাতেই আমাদের আনন্দ ; এখানেই আমাদের গর্ব ।
আর যৌবন সর্বকালে সৰ্ব্বদেশে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীহারা । অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার উন্মাদনায় আমরা ছুটিয়া চলি — বিজ্ঞের উপদেশ শুনিবার পর্যন্ত অবসর আমাদের নাই । ভুল করি , প্রমে পড়ি , আছাড় খাই , কিন্তু কিছুতেই আমরা উৎসাহ হারাই না বা পশ্চাৎপদ হই না । আমাদের তাণ্ডবলীলার ‘ অন্ত নাই , কারণ আমরা অবিরামগতি।
আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করিয়া থাকি । আমরা শাস্তির জল ছিটাইতে এখানে আসি নাই । বিবাদ সৃষ্টি করিতে , সংগ্রামের সংবাদ দিতে , প্রলয়ের সুচনা করিতে আমরা আসিয়া থাকি ।যেখানে বন্ধন,যেখানে গোঁড়ামি,যেখানে কুসংস্কার,যেখানে সঙ্কীর্ণতা সেইখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই ।
মনুষ্য জীবন আমাদের নিকট একটা অখণ্ড সত্য । সুতরাং যে স্বাধীনতা আমরা চাই — সে স্বাধীনতা ব্যতীত জীবনধারণই একটা বিড়ম্বন — যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগে যুগে আমরা হাসিতে হাসিতে রক্তদান করিয়াছি — স স্বাধীনতা সৰ্বতােমুখী। জীবনের সকল ক্ষেত্রে , সকল দিকে আমরা মুক্তির বাণী প্রচার করিবার জন্য আসিয়াছি । কি সমাজনীতি , কি অর্থনীতি , কি রাষ্ট্রনীতি , কি ধৰ্ম্মনীতি — জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা সত্যের আলােক , আনন্দের উচ্ছ্বাস ও উদারতার মৌলিক ভিত্তি লইয়া আসিতে চাই । অনাদিকাল হইতে আমরা মুক্তির সঙ্গীত গাহিয়া আসিতেছি । শিশুকাল হইতে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত । জন্মিবামাত্র আমরা যে কাতরকণ্ঠে ক্রন্দন করিয়া উঠি সে ক্রন্দন শুধূ পার্থিব বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানাইবার জন্য।শৈশবে ক্রন্দনই আমাদের একমাত্র বল থাকে কিন্তু যৌবনের দ্বারদেশে উপনীত হইলে বাহু ও বুদ্ধি আমাদের সহায় হয়।আর এই বুদ্ধি ও বাহুর সাহায্যে আমরা কি না করিয়াছি , -ফিনিসিয়া , এসিরিয়া , ব্যাবিলােনিয়া , মিসর , গ্রীস , রোম , তুরস্ক , ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ,জার্মানি ,রুশিয়া , চীন , জাপান , ভারতবর্ষ— যে কোনও দেশের ইতিহাস পড়িয়া দেখ — দেখিবে যে ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায়,প্রত্যেক সোনালী পাতায়,আমাদের কীর্তি জ্বলন্ত অক্ষরে লেখা আছে।আমাদের সাহায্যেই,সম্রাট সিংহাসনে আরােহণ করিয়াছেন,আবার আমাদেরই আঙ্গুলিসঙ্কেতে সভয়ে সিংহাসন ত্যাগ করিয়া তিনি পলায়ন করিয়াছেন ।
যে পথের আহ্বান আমি করিতেছি সে পথে পাবে শুধু দুঃখ , কষ্ট , অনাহার , দারিদ্র্য ও কারাযন্ত্রণা । যদি এই সব ক্লেশ ও দৈন্য নীরবে নীলকণ্ঠের মত গ্রহণ করতে পার — তবে তােমরা এগিয়ে এসাে , তােমাদের সবার আজ প্রয়ােজন আছে ।
আর যদি এই পথে এসে স্বদেশসেবার পুণ্য প্রচেষ্টায় ইহ - লীলা ত্যাগ করতে হয় , তবে মৃত্যুর স্বর্গের দ্বার তােমাদের সম্মুখে উদঘাটিত হবে । তােমরা যদি প্রকৃত বীর সন্তান হও তবে এগিয়ে এসাে ।
হে আমার তরুণ জীবনের দল , তােমরাই তো দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করেছ । আজ এই সারাদেশে ব্যাপী জাগরণের দিনে চিরায়ত আখাংকার বাণী যখন চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে তখন কি তােমরা ঘুমিয়ে থাকবে ?
তােমরাই তাে চিরকাল “ জীবন - মৃত্যু ” কে “ পায়ের ভৃত্য করে রেখেছ — তােমরাই ত সকল দেশে আত্মদানের পুণ্য ভিত্তির উপর জাতীয় মন্দির নির্মাণ করেছ — তােমরাই ত যাবতীয় দুঃখ অত্যাচার সানন্দে গ্রহণ করে প্রতিদানে সেবা ও ভক্তি অর্পণ করেছ । লাভের আকাঙ্ক্ষা তােমরা রাখনি , ভয় তােমাদের হৃদয় স্পর্শ করেনি , স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বীর সৈনিকের মত তােমরা হাসতে হাসতে মরণকে আলিঙ্গন করেছ । তােমাদের শৌর্য , বীৰ্য্য ও চরিত্রবল দেখে সংয়ং জননী নিজ হাতে তােমাদের শুভ্র ললাটে জয় - টীকা পরিয়ে দিয়েছেন ।
ওগাে বাঙ্গলার যুবক সম্প্রদায় , স্বদেশ - সেবার পুণ্য যজ্ঞে আজি আমি তােমাদের আহবান করছি । তােমরা যে যেখানে যে অবস্থায় আছ , ছুটে এসো । ঐ যে পূৰ্বগগনে বাংলাদেশের ভাগ্য - দেবতা তরুণ তপনের রূপে দেখা দিয়েছেন । স্বাধীনতার পুণ্য আলােক পেয়ে চীন , জাপান , তুরস্ক , মিসর,আমেরিকা যেখানে উন্নতির চরম শিখরে,সেখান স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও আমাদেরকে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে।
বাঙ্গালী সুন্দরের উপাসক হয়েছে । সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা জন্মভূমির অন্নজল সেবন করেই বাঙ্গালী কাব্যে ও সাহিত্যে এমন অপূর্ব সৃষ্টি - কৌশল দেখাতে পেরেছে । বাংলাদেশে জাতীয়তার স্রোতে আবার প্রবল বন্যা আসবে ।সে বন্যার স্পর্শে বাংলার প্রাণ আবার জেগে উঠবে । বাঙ্গালী সৰ্বস্ব পণ করে আবার স্বাধীনতার জন্য পাগল হয়ে উঠবে ; দেশ আবার স্বাধীনতা লাভের জন্য বদ্ধপরিকর হবে।
এই নব জাগরণের স্বরূপ কি হবে তা কে বলতে পারে? এই নব যজ্ঞের পুরােহিত কে হবে তা কে বলতে পারে? যে ভাগ্যবান পুরুষ এই যজ্ঞের পৌরহিত্য - ব্রত গ্রহণ করবেন তিনি এখন কোথায় বা কিরূপ সাধনায় তিনি এখন মগ্ন আছেন তা কে বলতে পারে?
এই আন্দোলনের নেতৃত্ব কে গ্রহণ করবেন অথবা কোন নূতন মনীষী তার আসনে বসবেন — তা আমরা জানি না।
এই সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য বসে থাকলে চলবে না । এই নব জাগরণের জন্য এখন থেকে আমাদের সকলকে প্রস্তুত হতে হবে । ধ্যান , ধারণা , চিন্তা , কর্ম , ত্যাগ , ভােগ — এই সবের মাঝখান দিয়ে আমাদের সাধনায় প্রবৃত্ত হতে হবে — যাতে ডাক এলে আমরা সাড়া দেবার জন্য প্রস্তুত থাকব । বঙ্গজননী আবার একদল'নবীন তরুণ সন্ন্যাসী চান । ভাই সকল , কে তােমরা আত্মবলির জন্য প্রস্তুত আছ , এসো ।
আমরা যেমন স্বপ্ন নিৰ্মাণ করিতে জানি , অপরদিকে রক্তস্রোতে ধরণীবক্ষও রঞ্জিত করতে আমরা অতি পটু।আমাদের সমবেত শক্তি লইয়া সমাজ , রাষ্ট্র , সাহিত্য কলা , বিজ্ঞান যুগে যুগে দেশে দেশে গড়িয়া উঠিয়াছে ; আবার রুদ্র করালমুর্তি ধারণা করিয়া আমরা যখন তাণ্ডব নৃত্য আরম্ভ করিয়াছি তখন সেই তাণ্ডব নৃত্যের একটা পদবিক্ষেপের সঙ্গে কত সমাজ ,কত সাম্রাজ্য ধুলায় মিশিয়া গিয়াছে তার খবর কম বেশি সবাই জানে।
এতদিন পরে নিজের শক্তি আমরা বুঝিয়াছি , নিজের ধর্ম চিনিয়াছি । এখন আমাদের শাসন বা শােষণ করে কে?কেই বা আমাদের দাবায়ে রাখে?
তাই এই নবজাগরণের মধ্যে সব চেয়ে বড় কথা , সব চেয়ে বড় আশা - তরুণের আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ ।
তরুণের প্রসুপ্ত আত্মা যখন জাগরিত হইয়াছে — তখন জীবনের মধ্যে সকল দিকে সকল ক্ষেত্রে যৌবনের রক্তিমবাগ আবার দেখা দিবে । এই যে তরুণের আন্দোলন - এটা যেমন সৰ্ব্বতােমুখী তেমনি বিশ্বব্যাপী। আজ পৃথিবীর সকল দেশে , বিশেষতঃ যেখানে বার্ধক্যের শীতল ছায়া দেখা দিয়াছে , তরুণ সম্প্রদায় মাথা তুলিয়া প্রকৃতিস্থ হইয়া সদর্পে সেখানে দণ্ডায়মান হইয়াছে । কোন দিব্য আলােকে পৃথিবীকে ইহার উদ্ভাসিত করিবে তাহা কে বলিতে পারে ? ওগাে আমার তরুণ জীবনের দল , তােমরা ওঠো , জেগে উঠো,উষার কিরণ যে দেখা দিয়াছে !
সবশেষে জেগে উঠো বাংলাদেশ❤️❤️❤️
তরুণের স্বপ্ন-সুভাষ চন্দ্র বসু অবলম্বনে।