28/05/2025
“ আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি, অসহায় মুসলিম দেশগুলোর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর দুর্দশার করুণ চিত্র। এই যে আমাদের বিপর্যয়গুলো একের পর এক দীর্ঘায়িত হচ্ছে, এখানে আল্লাহ তাআলার কি হিকমাহ রয়েছে, এইটা হয়তো আমরা সেভাবে ভেবে দেখি না।
বাস্তবেই এখানে আল্লাহ তাআলার এক বিরাট হিকমাহ রয়েছে।
কি সেটা?
— আল্লাহ তাআলা চান না যে, তাঁর বান্দারা শুয়ে-বসে বিজয় অর্জন করে ফেলুক।
তিনি চান না — তাঁর বান্দারা এর মাধ্যমে আত্ম প্ররোচিত-দাম্ভিক হয়ে যাক, রবের নিয়ামত-বিস্মৃত অকৃতজ্ঞ হয়ে যাক।
অনেক সময় তো এমনও হয় যে, বিজয়ের নেশায় মত্ত বিজেতা আগাগোড়া এক রক্তচোষা স্বৈরাচারী হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা এমন বিজয় দিতে চান না তাঁর মুমিন বান্দাদের।
এই জন্যই বিজয়ের পূ্র্বে আহকামুল হাকিমীন তাঁর বান্দাদের কষ্ট-নির্যাতনে ফেলেন, বিপর্যয় আর ভোগান্তিতে ফেলে পরীক্ষা করেন; যাতে করে বান্দারা নিজেদের দুর্বলতা, অক্ষমতাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
যাতে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবন করতে পারে যে — বিজয় একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই, আমাদের কোনো ক্রেডিট নেই।
একটু ভেবে দেখুন তো, কুরআনের কোন আয়াতে এই কথাগুলোর ইঙ্গিত আছে!
আল্লাহ তাআলা বলছেনঃ
‘আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে অপদস্থ।’
[ সূরা আলে ইমরান, ৩ঃ১২৩ ]
লক্ষ করুন, আল্লাহ বলছেনঃ ‘তোমরা ছিলে অপদস্থ।’
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ
‘আল্লাহ যখন বান্দাদের পরীক্ষা করেন, তখন তারা প্রথমে অপমানিত-অপদস্থ হয়, পরাজিত ও ব্যর্থ হয়।
এরপরই আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান এবং বিজয় পাওয়ার উপযুক্ত হয় তারা।
কারণ, বিজয়ের পতাকা উত্তোলিত হয় ব্যর্থতা আর পরাজয়ের ধ্বংসস্তূপ ভেদ করেই।
আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের তারবিয়াত দেওয়ার এইটাও একটা হিকমাহ।
বিপরীতে হুনায়নের যুদ্ধের ব্যাপারে কি বলেছেন, দেখুনঃ
‘আল্লাহ তোমাদের অনেক স্থানে সাহায্য করেছেন এবং ( সাহায্য করেছেন ) হুনায়নের যুদ্ধের দিন। যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোনো উপকারে আসেনি।’
[ সূরা তাওবা, ৯ঃ২৫ ]
তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যখন তাঁর বান্দাদের সাহায্য করতে চান, বিজয় দিতে চান;
তখন বিজয়ের আগে তাদের পরাজয় আর ব্যর্থতার পথ মাড়িয়ে আনেন।
এবং এই বিজয় আর সাহায্য আসেও পরাজয়ের আনুপাতিক হারে।’
[ যাদুল মাআদঃ ৩/১৯৮ ]
হুনায়নের যুদ্ধের দিন মুসলিমরা তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে আত্ম-অহমিকায় ভুগছিল। নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য মোহাবিষ্ট করে ফেলেছিল তাদের।
কিন্তু এসব তাদের কোনো উপকারে তো আসেইনি, উল্টো তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে যুদ্ধের প্রথম দিকে। এরপর অল্প কিছু মুসলিম সৈনিক জড়ো হন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পাশে।
আল্লাহ তাদের জনবল ও সম্পদে যে তিক্ততা ঢেলে দিয়েছিলেন, সেটার স্বাদ তারা হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকেন।
বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই মুমিনদের সাহায্যকারী নয়। শেষমেশ আল্লাহ তাআলা এই অল্প সংখ্যক লোকের মাধ্যমেই বিজয় দান করেন।
পক্ষান্তরে বদরের ঘটনা পুরো বিপরীত।
তখন মুসলিমরা ছিল অল্প। যুদ্ধের সরঞ্জাম বলতে তেমন কিছুই নেই। মুহাজিরগণ তো সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ন সয়ে দেশছাড়া। আনসার সমাজও নতুন এই পরিস্থিতিতে টালমাটাল। এতটা দুর্বল অবস্থায় অহমিকা, গর্ব আর শ্রেষ্ঠত্বের চিন্তা করা তাদের পক্ষে সম্ভবই ছিল না।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা এই হীন-দুর্বল অবস্থায়-ই তাদের সাহায্য করলেন, বিজয় দান করলেন।
‘আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে অপদস্থ। অতএব আল্লাহকে ভয় করো, যাতে কৃতজ্ঞ হতে পারো।’
[ সূরা আলে ইমরান, ৩ঃ১২৩ ]
পুরো বিষয়টি সাজিয়ে বললেঃ
মুসলিমরা ব্যর্থ-অপদস্থ হয়ে আল্লাহর কাছে নত হবে।
এরপর যখন আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন, বিজয় দান করবেন, তখন বিজয়ের খুশিতে আত্মহারা হয়ে অহমিকা আর আত্মতুষ্টিতে ডুবে যাবে না তারা। বরং নিজেদের দুর্বলতা আর অযোগ্যতার কথা স্মরণ করবে।
বুঝবে যে, বিজয়ের কৃতিত্ব আল্লাহরই প্রাপ্য। এইটা তার অনুগ্রহ। অবনত মস্তকে শুকরিয়া আদায় করবে রব্বে কারীমের কদমে। নিজেদের পূর্বের বিপর্যয় আর লাঞ্ছনার কথা স্মরণ করে সদয় হবে বিজিত জাতির উপর। তাদের উপর যুলুম-অত্যাচার করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে।
এই হচ্ছে মুসলিমদের ওপর দীর্ঘায়িত বিপর্যয়ের ব্যাপারে আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ রব্বুল আলামিনের হিকমাহ।
এই জন্যই ভাই আমার!
‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।’
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর লাঞ্ছনা-গঞ্জনার আঁধার কাটিয়ে বিজয়ের সূর্যকে ত্বরান্বিত করুন। আমিন। ”