
25/12/2024
আমার ছেলে আমার কথামতো চলে বলে আপনি আপনার মেয়ের বিয়ে আমার ছেলের সঙ্গে দিবেন না। এই কথা কি সত্য?
জি সত্য।
আপনি কি জানেন আমার ছেলে রাহিল একজন ইঞ্জিনিয়ার। সে খুব ভালো চাকরি করে। ছাত্র জীবনে সে কখনো দ্বিতীয় হয়নি। এবং তার এসব অর্জনের পেছনে আমার অবদান মুখ্য ছিলো।
জি আমি জানি। দেখুন আপনার এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। আমার মেয়ে মুন্নী অত্যন্ত ভালো মেয়ে। তার পড়াশুনার রেজাল্টও ভালো। আমার মেয়ে আপনার ছেলেকে অনেক ভালোবাসে। সে আমাকে বলেছে যে সে বিয়ে করলে রাহিলকেই করবে। কিন্তু এই বিয়েতে আমি রাজি নই, আমি শুধুমাত্র আমার মতামত দিয়েছি। আমি মনে করি একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে কিংবা মেয়ে তার নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা থেকে চলবে, অন্য কারো কথায় নয়।
আপনি কি চান যে আমার ছেলে আপনার মেয়ের কথা শুনে চলুক। বিয়ের পর সে কেন বউ এর কথা বাদ দিয়ে মায়ের কথা শুনবে তাতেই আপনার আপত্তি?
দেখুন আসলে আপনি ব্যাপারটাকে যেভাবে দেখছেন আমি ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখি না। আমি আপনাকে একটা গল্প বলতে চাই যদি আপনার সময় থাকে।
বলুন আপনার গল্প।
একটা মেয়ের ত্রিশ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। মেয়েটার যখন বিয়ে হয় সংসার নিয়ে মেয়েটার অনেক স্বপ্ন ছিলো। সে জীবনে কতবার চড়ুইভাতি খেলেছে। তার একটা ছোট ঘর হবে। সেই ঘরটাকে সে তার স্বপ্ন দিয়ে সাজাবে। তার যে জীবনসঙ্গী হবে। তার সঙ্গে সারারাত গল্প করবে, খুনসুটি করবে। বৃষ্টির দিন মেয়েটা তার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবে। ছেলেটা বেলি ফুলের মালা এনে মেয়েটার খোঁপায় পরিয়ে দিবে। তারা দুজন শহরের রাস্তায় হাঁটবে। নদীর ধারে বসে থাকবে। কোন কোন রাত তারা শুধু গল্প করে কাটিয়ে দিবে। কখনো দুইজন শুধু হাত ধরে বসে থাকবে। তাদের সন্তান হবে। তারা একসঙ্গে পার্কে যাবে। ছেলে, মেয়েরা যখন দৌড়াদৌড়ি করবে তখন তারা ভাববে তারা কত সুখী।
আচ্ছা।
মেয়েটা জানতো ছেলেটা ভীষণ মেধাবী চিকিৎসক। জীবনে সে কোনদিন দ্বিতীয় হয়নি। খুব উঁচু বংশের ছেলে। মেয়েটা যখন ছেলেটার ঘরে বউ হয়ে এলো তার স্বপ্নের সঙ্গে জীবন মিললো না। তার সেই অতি ব্যস্ত স্বামীর তার জন্য সময় নেই। তিনি এসেই মায়ের সঙ্গে গল্প করতে বসে যেতেন। তারা দুজন কখনো ঘুরতে যেতে পারতো না। কেননা তার মা বলতো জীবনে এত ঘুরে কি হবে? আমি আর তোর বাবা কি ঘুরেছি? তাদের রাত জেগে গল্প করা হতো না। মা শুধু ছেলের বউ এর দোষ ধরতো। ছেলেটা এসে বউটাকে কথা শুনাতো। অভিযোগের পর অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকলো। মেয়েটা তার সব স্বপ্ন বাদ দিলো। তার পূর্ণিমা দেখার স্বপ্ন, বেলি ফুলের স্বপ্ন। এমনকি নিজের বাসায় নিজের বাবা, মা-কে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর স্বপ্ন। ছেলেটা সমাজের চোখে খুব আদর্শ ছেলে। মায়ের কথা শুনা ছেলে। সে যে শুধু মায়ের কথা শুনতো তাই নয় তার বোনের কথাও শুনতো। বোন বলতো ভাইয়া ভাবি কিন্তু এই কাজটা ঠিক করেনি। অমনি ছেলেটা এসে নিজের বউকে দুইটা কথা শুনিয়ে যেতো। মেয়েটার সন্তানেরা কি করবে, কোথায় ভর্তি হবে, কোন টিচারের কাছে পড়বে সবকিছু ঠিক করে দিতো মা, বোন। মেয়েটা শুধুমাত্র একজন বউ ছিলো কিন্তু সংসারে তার কোন ভূমিকা ছিল না। তার কোন সম্মান ছিলো না। সবাই বলতো আপনার স্বামী কি মেধাবী মানুষ। কি দারুণ পরিবারে আপনার বিয়ে হয়েছে। আর মেয়েটার কাছে বাস্তবতা ছিলো পুরাই উল্টা। তার জীবনের সব স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু জীবনটা কোনভাবে কাটিয়ে দেয়া।
একদিন মেয়েটার ডাক্তার স্বামী মারা গেলেন। মেয়েটা পড়লো চরম বিপদে। শাশুড়ি, ননদ সব দূরে সরে গেলো। মেয়েটা তার দুই মেয়েকে নিয়ে তার জীবন-যুদ্ধ চালিয়ে গেলো।
কিন্তু এর মাধ্যমে আপনি কি বুঝাতে চান?
দেখুন একটা ছেলে তার মায়ের কথা শুনবে, বোনের কথা শুনবে এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু একটা ছেলে যখন কোন দায়িত্বে যাবে, স্বামী হবে, বাবা হবে তখন তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। বড় হওয়া কাকে বলে। বড় হওয়া মানে নিজের ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। নিজের বুঝার ক্ষমতা। সে যদি সাবালক হওয়ার পরও তার নিজের বিচার বুদ্ধি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা না থাকে। সে যদি অন্যের কথা শুনে প্রভাবিত হয়, অন্যের উপর নির্ভরশীল হয় তবে সে যতই মেধাবী হউক না কেন। কাউকে সুখী করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই ধরনের মানুষের মানুষ চেনার ক্ষমতা কিংবা বিচার বুদ্ধির ক্ষমতা থাকে না। আসলে এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন মানুষকে বড় হওয়া, স্বামী হওয়া কিংবা বাবা হওয়া এই ব্যাপারগুলো শিখানো হয়না। আপনি বয়সে বড় হতেই পারেন, মেধাবী ও হতে পারেন কিন্তু একজন মানবিক, চিন্তাশীল এবং বিবেকবান নাও হতে পারেন।
এই গল্পের মেয়েটা কে? আপনি?
জী। আমি সেই মেয়ে। যার খুব উঁচু বংশে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু এই উঁচু বংশ, মেধাবী স্বামী, দারুণ পরিবার, কোনকিছুই আমাকে সারাজীবন কোন সুখ স্মৃতি দেয়নি। বরং আমাকে সাগরের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছে। তাই তখন থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি জীবনে আমার সন্তানদের এমনভাবে বড় করবো যেন তাদের নিজেদের বিবেক বুদ্ধি হয়। তারা যেন শুধু বয়সে বড় না হয়। মননে, চিন্তায় বড় হয়। তাই যেদিন আমি শুনেছি আপনার ছেলে আপনার কথা মতো চলে সেদিন আমি আমার মেয়েকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছি। যে ছেলে এত বড় হয়েও নিজের বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী চলতে শিখেনি তার কাছে খুব বেশি আশা করার কিছু নেই। আমি, আপনি মা হতে পারি। কিন্তু আমাদেরও ভুল হতে পারে। আমরা ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে নিজের বিচার বুদ্ধি থাকতে হবে।
আপনার মেয়ে কি বললো?
সে বললো সে আপনার ছেলেকেই বিয়ে করবে। কেননা আপনার ছেলে তাকে বলেছে সে পরিবর্তিত হবে।
তাহলে আর সমস্যা কি?
পরিবর্তন কি এত সহজ। এতে সাধনার দরকার হয়। জীবনবোধ উপলব্ধির দরকার হয়। এটা অর্জন মানুষ সারা জীবনে পারে না, সে কিভাবে কয়দিনে পারবে?
তাহলে আপনি আপনার মেয়েকে কি শিখালেন?
ঐ যে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছি। আমার কথায় সে প্রভাবিত হয়নি। সে নিজেই তার নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তাকে তাই বলেছি। তোমার যেটা ভাল লাগবে তুমি তাই করবে। আমি শুধুমাত্র আমার অপিনিয়ন দিয়েছি।
জি আপনার মেয়ে তার সিদ্ধান্ত আমার ছেলেকে জানিয়ে দিয়েছে। এই বিয়েতে সে রাজি নয়। তাই আমি কৌতূহল-বশত জানতে আসলাম। এত পরিবার আমার ছেলের পেছনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা এমন কোন পাগল?
জি আমরা আসলেই পাগল। মাথায় সমস্যা আছে। তবে এইভাবেই আমাদের ভাবতে ভাল লাগে। পাগল হওয়া মন্দ নয়।
🌱সমাপ্ত
⛔জীবন-গল্প
🖊️Mohammad Aminul Islam