
18/08/2025
আমরন_চেয়েছি_তোমায়
লেখায়_সুরাইয়া_নওশিন
008
ফযরের নামায পরে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে সারা। কিছু ভেবে তড়িৎ গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামে সারা। শায়লা বেগম ট্রে তে করে বাদাম, ওটস, কিশমিশ আর হালকা গরম লেবুর পানি সাজিয়ে নিয়ে আসছেন রান্না ঘর থেকে। সারাকে এই সময় নিচে দেখে কৌতূহল নিয়ে বলে,,
" কি রে মা তুই এখানে।"
সারা একটু ভেবে বলে,,
" আজ সকাল সকাল কফি খেতে ইচ্ছে করছে আমার। তাই নিতে এলাম। কিন্তু আপনি এসব এতো কিছু নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন"
" আর বলিস না মা। ডাক্তার ছেলে আমার। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ সকাল সকাল এসব খান আর ভোর সকালের কি সব ইয়োগা টিয়োগা করে। বাদ দে এসব,তুই দাঁড়া আমি কফি করে দিচ্ছি তোর রান্না ঘরে কোন কাজ নেই।"
সারার এসব দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। এ সত্যি ভিন্ন এক গ্রহের মানুষ। যার সাথে তার কোনো স্বভাবই মিলে না। সে তো এই সব স্বাস্থ্য সচেতনতার "স্ব" শব্দ টুকু গুরুত্ব দেয় না। সারা নিজেকে শান্ত করে আর বেশি কিছুক্ষণ ভাবলে সত্যি সে পাগলের খাতায় নিজের নাম লিখাবে। সারা কিছু ভেবে বলে,,
" ঠিক আছে করে দেন। আর ট্রে টা আমাকে দিন। আমি দিয়ে দিবো সানি ভাইকে। আপনি কফি করে দিন, কফি খাওয়াও হবে আপনার ডাক্তার ছেলের ইয়োগা টিয়োগা পাগলামো দেখা যাবে।
শায়লা বেগম হাল্কা শব্দ করে হেঁসে বলে,,
" দাঁড়া দু মিনিট আমি নিয়ে আসছি।"
সারা মনে মনে আওড়ালো,,
" বাপরে এমন স্বাস্থ্য সচেতন ডাক্তার বর কপালে জুটলে পুরো জীবন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন রুটিনের তালিকায় পরে যাবে। আর তুই এই মানুষটার উপর উষ্ঠা খেয়ে ছোঁচার মতো ক্রাশ খেয়েই যাচ্ছিস খেয়েই যাচ্ছিস। "
সারা ভাবনায় মাঝে কফি নিয়ে চলে আসেন শায়লা বেগম। ট্রে তে কফির মগ রেখে বলে,,
" নিয়ে যা"
" ঠিক আছে যাচ্ছি।"
" সানি কিন্তু ছাঁদে"
সারা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে ছাঁদে চলে যায়। ছাঁদে উঁকি দিতেই সারার চোখ কপালে। রসালোর মতো গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রয়েছে। সাদা রঙের টি শার্ট পরা আর নেভি ব্লু রঙের টাওজার পরে ধ্যান করার মতো বসে রয়েছে সানি। এই ইয়োগা ফেসবুকে, ইউটিউবে অনেক বার চোখে পরেছে তার। তবে এসবে কোনো আগ্রহ নেই তাই গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি কখনও। সারা ফিঁক করে হেঁসে দেয়। ফোন আনলে ছবি তুলতে পারতো। মিস করে ফেললো সে। সারা নিশব্দে হাঁসছে। সানির ভয়ে শব্দ করে হাঁসতেও পারছে না। এসব ইয়োগা তার কাছে পাগলামো লাগে। সারা পা টিপেটিপে হেঁটে গিয়ে সানির সামনে দাঁড়ায়। সানি চোখ বন্ধ করে বলে,,
" ফ্লোরে রেখে দিন । এতো সকাল সকাল এমন সারপ্রাইজ। আপনি আনলেন যে, মা আসলেন না।"
সারা বিস্মিত হয়ে সানির দিকে তাকিয়ে বলে,,
" আমি এসেছি আপনি জানলেন কিভাবে। "
সানি চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবে,
"তোমার আগমন আমার শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরা জানান দেয়।তোমার উপস্থিতি, আমার জীবনের আভাস।তোমার আগমন, হৃদয়ে সুর তোলে।
সানি তার মনের কথা মনে রেখে চোখ মেলে তাকালো। এরপর স্বাভাবিক ন্যায় বলে,,
" মানুষ যখন চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির হাওয়া অনুভব করে তখন সেই মুহুর্তে তার শ্রবন শক্তি বৃদ্ধি পায়। আমি তোর পায়ের শব্দ শুনেছি। মা, মামীরা আসলে কিছু না কিছু বলতেন কিন্তু আপনার নিরবতায় বুঝতে পারলাম আপনি এসেছেন।"
" ওহ আচ্ছা।"
" জ্বি ম্যাম। এখানে আপনার আগমনের কারন।"
সারা মেঝেতে ট্রে রেখে সানির মুখোমুখি বসতে বসতে বলে,,
" আপনার কোনো সমস্যা হলো।"
" না না আমার কেন সমস্যা হতে যাবে।"
সানি ট্রে দিকে তাকিয়ে বলে,,
" কফি কার।"
সারা জিহবা কামড় দিয়ে বলে,,
" ঠান্ডা মনে হয় হয়ে গেলো কফিটা। আমার জন্য এনেছিলাম।"
" ভোর সকালে কফি না খেয়ে খালি পেটে হালকা গরম লেবুর পানি নয়তো মধুর শরবত খাবেন। এসব অভ্যাস ত্যাগ করুন। কাল থেকে এসব খাবেন ঠিক আছে।"
সারা বিরবির করে বলে,,
" শুরু হয়ে গেলো ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখা। আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো।"
সারা নিজের মনের কথা মনে হজম করে জোরপূর্বক মুখে হাঁসি এনে বলে,,
" এতো স্বাস্থ্য সচেতন থেকে কি লাভ সানি ভাই। আজ না হয় কাল মানুষকে তো মরতে হবেই। এসব তো আর আয়ু বাড়াতে পারে না।"
" মানুষ মরণশীল এ কথা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকা আর অসুস্থ হয়ে বেঁচে থাকায় পার্থক্য রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য সচেতন থাকলে মানুষ যে অসুস্থ হবে না এমনটা নয়। ভাগ্যে থাকা আর নিজের বয়ে আনায় পার্থক্য রয়েছে ম্যাম।"
সারা বুঝতে পারলো এই মানুষটার সাথে যুক্তিতে পারবে না সে। কিন্তু সানির এমন সব সময় তাকে আপনি বলে সম্মোধন করায় একটু ভাবালো এখন সারাকে। সারা সানির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,
" আপনি আমাকে আপনি বলে কেন সম্মোধন করছেন?"
সানির সেই স্মিত হাঁসি রেখে বলে,
" কেন ভালো লাগছে না। "
সারা একটু সংকোচ নিয়ে বলে,,
" তেমন কিছু নয়। আপনি তো আগে আমাকে তুই বলে সম্মোধন করতেন।"
" আর আপনি আমাকে কি বলে সম্মোধন করতেন। "
সারা এবার আরও বেশি সংকোচে পরে গেলো। মাথা নিচু করে বলে,,
" আসলে আপনি তো আমার বড় আর অনেক বছর পর কথা বলা তাই আর কি। এই জন্য কি আপনি আমাকে সবসময় আপনি বলে সম্মোধন করবেন।"
" নাহ এই জন্য আমি আপনাকে আপনি বলে সম্মোধন করছি না। সম্মানিত ব্যাক্তি তাই সম্মান করছি।"
সারা অবাক হয়ে সানির দিকে তাকায় বিস্মিত কন্ঠে বলে,,
" মানে।"
" এই বাড়িতে আপনি সবার উপর হুকুমচালান। স্বয়ং রায়খান পর্যন্ত আপনার জেদ সহ্য করেন। তাহলে আপনি কি সম্মানিত ব্যাক্তি নন।"
সারা মুচকি হেঁসে কফির কাপ হাত নেয়। সানি সারার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,,
" আমি তোমাকে সম্মানের সর্বোচ্চ চূড়ায় রাখতে চাই।
যেখানে অসম্মান, দুঃখ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।"
সানি লেবুর পানি হাতে নিতে নিতে বলে,,
" কাল থেকে ভোর ৫-৩০ টায় ছাদে আসবেন। আর সঙ্গে এসব খাবার নিয়ে আসবেন আমাদের দুজনের জন্য ঠিক আছে। "
সারা বিস্মিত হয়ে বলে,,
" মানে।"
" মানে হলো আপনাকেও ইয়োগা করতে হবে। খুব বেশি নয় ১০ মিনিট ইয়োগাটা করতে হবে। এ ইয়োগা শক্তি বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এর সব থেকে ভালো গুন হলো মানসিক চাপ কমায় এবং মনোযোগ বাড়ায় শরীরের পাশাপাশি মনকেও শান্ত করে।"
সারার এবার মাথা ঘুরছে। এসেছে পর্যন্ত জ্ঞ্যান শুনেই যাচ্ছে। এই লোকটার সাথে সময় কাটালে বিনা সার্টিফিকেট এ অর্ধেক ডাক্তার হয়ে যাবে সে। আর কি কি রুটিন ধরিয়ে দেয় কে জানে। এসব ইয়োগা তাকেও করতে হবে, ভাবতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। সারা বির বির করে বলে,,
" আরও খাঁ ডাক্তার বেডার উপর ক্রাশ। প্রেম পত্র লিখবে প্রেসক্রিপশনে আর বলবে দু'জন মিলে ভোর সকালে ইয়োগা করার জন্য আমার তোমাকে চাই। অসহ্য,,,।"
সারার বেশ বিরক্ত লাগছে সানির উপর। মানুষ এতো সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভাব নিয়ে কিভাবে থাকতে পারে। এতো নিয়ম কানুন মেনে কিভাবে চলে। তার দ্বারা এই ভাবে চলা অসম্ভব। সারার খুব জানতে ইচ্ছে করছে এরপর কি করবে। তাই কৌতূহল নিয়ে বলে,,
" এরপর কি করবেন সানি ভাই।"
" জিম করবো। এরপর কলা আর ডিম খাবো। তবে আপনার এসব করতে হবে না। আপনি ইয়োগা আর এসব খাবার টুকু খেলেই চলবে।"
সারা নিজের মাথা ঝাঁকালো কয়েকবার। সানি ঠোঁট চেপে হেঁসে বলে,,
" আপনি কি করবেন এখন।"
" আমি এখন একটু পড়তে বসবো। এরপর একটু ঘুমাবো। তারপর ভার্সিটি আবার বাসায়। বোরিং লাইফ।"
মনমরা হয়ে কথা গুলো শেষ করলো সারা। সানি নিশব্দে হাঁসলো,,,
" বিকালে হাঁটতে পারেন তো। ভালো লাগবে। "
সানির এ কথা সারার খুব পছন্দ হলো। সকালে সে না হয় তার জন্য ইয়োগা করলো আর বিকেলে তার জন্য সে হাটলো। মন্দ হয় না বিষয় টা। ভাবতেই মনে আনন্দ লাগছে। সারা তো আর সরাসরি আবদার করতে পারে না। তাই একটু ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা করলো,,
" একা একা হাটতে ভালো লাগে। সেই তো বোরিং এর মতো হয়ে গেলো। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত আমাকে নিয়ে যাওয়ার মতো কারও কি সময় আছে। "
" তা অবশ্য ঠিক। বাসায় সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। সকলেরই কর্ম রয়েছে। তবে মাঝে মাঝে সময় বের করা যায়। আর সময় বের করা উচিত নিজের লোকদের সময় দেওয়া জরুরি। আমি বলে দিবো সাফি ভাই আর আয়াদকে। এছাড়াও আপনি এক কাজ করতে পারেন আপনার বান্ধবী আরহি ওকে নিয়ে এই বাড়ির আশেপাশে হাঁটতে পারেন। দুজন দূরে যাওয়া অবশ্যই যাওয়া যাবে না। এই আশেপাশে হাঁটতে পারেন আপনার বান্ধবী তো ভালো আছে, ভালো সম্পর্ক আপনাদের দুজন হাটলে আর বোরিং লাগবে না। "
সানির মুখে নিজের বান্ধবীর প্রশংসা শুনে বেস্ট ফ্রেন্ডকে সতিন মনে হচ্ছে তার। বিষয়টি হজম করতে পারলো না সারা। মনে মনে বলে,,,
" আমার বান্ধবী ভালো আমি ভালো চোখে পরে না। পরে খুলিতে নজর। এদিকে তার জন্য ইয়োগা করবো আর সে আমার সাথে মাঝে মাঝে বিকেলে হাটতে পারবে না। মন চাচ্ছে বোমা মেরে উড়িয়ে দেই ডাক্তার বেডাকে।"
সারাকে চুপ থাকতে দেখে সানি আবারও বলে,,
" আমি সময় পেলে নিয়ে যাবো ঘুরতে তখন।"
সারা এবার মনের মতো জবাব পেয়েছে। খুশিতে আৎখানা হয়ে গেলো মেয়েটা। হাঁসি মুখে জবাব দেয়,,
" থ্যাংকস। "
সানি ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হাঁসে। দুজন মিলে আর কিছু সময় গল্প করে চলে যায় যে যার কক্ষে।
~~~~~~~~
সকালে নামায পরে আবারও ঘুমিয়ে পরেছিলো আরহি। ইদানীং ঘুম খুব বেশি পায় (লেখিকার মতো🤭) আরহির। ঘুমেই যেন অজস্র শান্তি লুকিয়ে আছে তার। আড়মোড়া দিয়ে উঠে ফোনটা হাতে নিলো আরহি৷ অনলাইন আসতেই নোটিফিকেশন সাফি মেহতাব খান এক্সেপ্ট ইউর ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট। সকাল সকাল এতো বড় ধাক্কা নিতে কষ্ট হলো। দুম করে উঠে বসলো।এক হাতে চোখ কচলিয়ে নিলো কয়েকবার। কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। এরপর মেসেঞ্জার এ পর পর ৭ টা মেসেজ। তাও আবারও সাফি মেহতাব খান এর। আরহি এবার বিশাল বড় রকমের ধাক্কা খেলো। ভয়ে ভয়ে মেসেজ সিন করলো সে। ৭ টাই ক্লাসের ভিডিও। আরহি মুখ বাঁকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,,
" এনার থেকে এগুলোই আশা করা যায়। এই সারা শা*কচুন্নি কেন যে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে দিলো। ভয়ে তো শান্তিতে অনলাইন এ যেতে পারবো না। পোস্ট ও করতে পারবো না শান্তিতে। এই গুলো ক্লাসের ভিডিও পড়া তো আবার ধরবে না। উফ সকালটাই এতো জঘন্য গেলো বাকি পুরো দিন এখনও পরে আছে।"
আরহি বাধ্য হয়ে মেসেজ দিলো " থ্যাংকস স্যার।"
সৌজন্যতার খাতিরে মেসেজটা দেওয়া। ফোনটা পাশে রেখে বিছানা থেকে উঠে যাবে তখনই মেসেঞ্জারে আবারও শব্দ হলো। আরহি বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিলো আরেকবার। আবারও বড় রকমের ধাক্কা খেলো সাফি মেহতাব খান এর মেসেজ৷ লেখা " ওয়েলকাম।"
আরহি মেসেজ দেখে ভয়ে ভয়ে ফোনটা রেখে দিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। উঠতে এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে ভার্সিটিতে যেতে হবে তার।
আজও সাফি দুজনকে ভার্সিটিতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু গাড়িতে কেউ কথা বলে নি সালাম আদান প্রদান ছাড়া।
সারা আর আরহি আস্তেধীরে দু একটা কথা বললেও সাফি চুপচাপ গাড়িয়ে চালিয়েছে।
ক্যাম্পাসে বসে আছে সারা আর আরহি। আরহি বিরক্ত হয়ে বলে,,
" তোর ভাইকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে আমার এতো বড় সর্বনাশ কেন করলি।"
সারা মিটিমিটি হেঁসে বলে,,
" ফেসবুকে একটা ছেলে একটা মেয়ের সর্বনাশ করতে পারে জানা ছিলো না তো।"
আরহি সারার কথার ইংগিত বুঝতে পেরে চোখ পাকিয়ে সারার দিকে তাকায় আরহি। আরহি এমন মুখ দেখে নিজের হাঁসি আটকিয়ে রাখতে পারে না। হাঁসতে হাঁসতে বলে,,,
" এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তুই তো বাংলা পুরোনো সিনেমার মতো বললি আমার এতো বড় সর্বনাশ করবেন না। দোহায় আপনার আমাকে ছেড়ে দিন।"
অভিনয় করে কথা গুলো শেষ করলো সারা। আরহি সজোরে গাট্টা মারে সারার মাথায়। এরপর রাগী স্বরে বলে,,
" তুই আমার বান্ধবী নাকি শত্রু বলতো।"
" আরে এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? ক্লাসের ভিডিও দিয়েছে তো, ওই সব আমাকেও দেয় সিন করে রেখে দেই। ভাইকি দেখতে আসছে কি না আমি পড়ছি। তুই ও রেখে দিবি। ভাই যেমন পড়াশোনায় এক্টিভ তার বোন তেমন ফাঁকিবাজ। মাঝে মাঝে আমাদের এতো অমিল দেখে মনে হয় আমার দুজন ভাই বোন নই। আবার ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে মনে হয়, না এ আমার রক্তের ভাই।"
আরহি বিরক্ত স্বরে বলে,,
" আমারও সন্দেহ হয়।"
" সন্দেহ করে লাভ নেই। ইহাই চিরন্তন সত্য। "
হুট করে সারা মন মরা হয়ে বলে,,
" জানিস জানু আজ সকালে কি হয়েছে।"
" না বললে জানবো কিভাবে। ওহ হ্যাঁ তুই তো সানি ভাইয়ের সাথে কথা বলেছিস কি কথা হলো আমাকে বল না শুনি।"
অনেক আগ্রহ নিয়ে কথা গুলো বলে আরহি। সারা মন মরা হয়ে আজ ভোরে ঘটে যাওয়া ঘটনা আরহিকে বলে সারা। আরহি হাঁসতে হাঁসতে গড়িয়ে পরার মতো অবস্থা। আরহি হাঁসতে হাঁসতে পেটে হাত রেখে বলে,,
" নাহ আমার পেট ব্যাথা হয়ে যাবে এবার। এ সকল ইউনিক পিচ তোদের খান বাড়িতে সব হতে হলো।"
" এহ এ শিকদার বাড়ির পিচ।"
" বড় হয়েছে তো খান বাড়িতে। আর সব সময় তোর ভাইয়ের সাথে ঘুরে এমন তো হবেই। তোর ভাইকে গুরু মানে না সে। "
" সব সময় আমার ভাইকে দোষারোপ করবি না তো। আমার ভাই এমন নয়।"
আরহি কিছু ভেবে চটজলদি বলে উঠে,,
" তোর ফোন দে তো। আমার ফোনে এমবি নেই।"
সারা আরহির হাতে ফোন দিতেই আরহি অনেক আগ্রহ নিয়ে ফেসবুকে যায়। এরপর সানি মেহরাজ শিকদার নাম দিয়ে সার্স দেয় আরহি। মুহুর্তে প্রথম সারিতেই ভেসে উঠে সানির ফর্মাল ড্রেস পরা প্রোফাইল। সারা এবার কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসে। সানির আইডি দেখে অবাক হয়ে বলে,,
" আরে জানু এতো সানি ভাইয়ের আইডি।"
" হুম এইটার জন্য ফোন হাতে নিলাম।"
সারা মনে মনে খুশি হলো কিন্তু আরহিকে বললো না। এই বুদ্ধি একবারের জন্যও মাথায় আসে নি তার। মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো আরহিকে। আরহি বিস্মিত হয়ে বলে,,
" দেখ জানু কত ফলোয়ার। অধিকাংশ মেয়ে দেখ।"
সারার এবার ভীষণ রাগ হলো। পরক্ষণেই শান্ত করলো নিজেকে এটা স্বাভাবিক বিষয়। মাথা গরম করলে চলবে না। সানি কভার ফোটো সাদা পাঞ্জাবী পরে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে বুঝা যাচ্ছে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলো। প্রোফাইল ছবি হাল্কা আকাশী রঙের শার্ট আর পরনে তাদের ডাক্তারের সাদা কোর্ট সোফায় বসে রয়েছে। প্রায় দুই বছর হয়ে গিয়েছে প্রোফাইলের ছবি পরিবর্তন করে নি। এদিকে ছাড়া মাসে দুবার পরিবর্তন করে প্রোফাইলের ছবি। সারা মনে মনে আওড়ালো,,
" পানসে লোক।"
দুজন মিলে পোস্ট দেখছে কিন্তু সব পোস্ট শিক্ষামূলক। অযথা একটা কোনো পোস্ট নেই। আরহি ফোন রেখে দিলো। সারা আর আরহি এক সাথে মাথায় হাত রেখে বলে,,,
" জড়বস্তু"
আরহি কিছুক্ষন পর আবারও কৌতূহল নিয়ে বলে,,
"এদের মাঝে কোনো অনুভূতি নেই। কোন গ্রহ থেকে আগত হয়েছে এই পৃথিবীতে এ দুজন।"
সারা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,,
" জানি না,,। তুই এতো টুকু দেখে অবাক হচ্ছিস। সানি ভাইয়ের কথা বলতে পারছি না। কিন্তু আমার ভাইয়ের কান্ড শুনবি। ছেলে মানুষ বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে সেজে গুজে থাকা মেয়েদের দিকে কিভাবে নির্লজ্জ,বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে। আর আমার ভাই এই জন্য বিয়ে বাড়িতেই যায় না। বলে বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের এসব আনাগোনা, চেঁচামেচি নাকি তার অসহ্য লাগে। একবার বিয়ে বাড়িতে একটা মেয়ে ভাইয়াকে প্রোপজ করেছিলো পরিবারের ভয় দেখিয়ে দশ মিনিট কানে ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে ছিলো। এতো সুন্দর মেকাপ কেঁদে কেঠে নষ্ট করেছিলো মেয়েটা। আমি কত বুঝিয়ে মেয়েটাকে বাঁচিয়েছি। একদিন আমার ঘরে বসে নেইলপালিশ দিচ্ছিলাম ভাইয়া ঘরে ঢুকে বমি করার মতো উপক্রম। কারন সে নেইলপালিশ এর গন্ধ নাকি সহ্য করতে পারে না। পরে সব নেইলপালিশ নিয়ে ডাস্টবিন এ বিনে ফেলে দিয়েছে। আমার সাধের নেইলপালিশ ছিলো সব।"
শেষের লাইনটা কান্না জড়িত কন্ঠে বলে সারা। আরহি নিজের মাথায় হাত রেখে বলে,,
" থাম আমার মাথা ঘুরছে। এখনি পরে যাবো আমি।
আর কিছু বলিস না তুই। এই দুইটাকে মিউজিয়াম রাখা উচিত। "
এদিকে ফাহমিদুল কে আসতে দেখে দুজনে চুপ হয়ে গেলো।
~~~~~~~~~
বিকেলে সানির চেম্বারে এসেছে সাফি আর আয়াদ। আজ প্রথম দিন তাই সুযোগ বের করে এলো হসপিটালে। সানিই আসতে বলেছিলো তাদের। তিন ভাই মিলে কফি খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। আয়াদ সানির দিকে তাকিয়ে বলে,,
" গুরু কথা তো বলেছে। অবশেষে তোমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। এবার আমাদেরও অপেক্ষার প্রহর শেষ করো। খান বাড়িতে একটু বিয়ের সানাই বাজাও। আমরাও আনন্দ করি।"
সানি কফি খেতে খেতে নিশব্দে মুচকি হেঁসে বলে,,
" সব কিছু এতো সহজ নয়। চাইলেই সব কিছু মন মতো কড়া যায় না। যদি এমনটাই হতো তাহলে অপেক্ষা, ধৈর্য্য নামক কোনো শব্দ সৃষ্টি হতো না।"
" কীসের অপেক্ষা। তুমি এটা ভাবছো না তো সারা তোমাকে আদৌ ভালোবাসে কি না। কনফার্ম তোমাকে ভালোবাসে তোমার দিকে সব সময় নজর সারা। তুমি তো বুঝতেই চাও না চোখের ভাষা।"
" মোহ আর মায়া দুটোই অনেক তফাৎ আয়াদ। আর এ তফাৎ বুঝার ক্ষমতা এখনও হয়নি তোর। তুই সারার মতো উড়নচণ্ডী স্বভাবের। আর বড় কথা হলো এসব নিয়ে আমি মোটেই ভাবছি না। "
" তাহলে কি ভাবছো শুনি। তোমার তো ভাবার কোনো কারন দেখি না, মেয়ের বড় ভাই তোমার পাশে রয়েছে। বড় আব্বুর কথা একদম ভেবো না সাফি ভাই দেখে নিবে সবটা।"
সানি কফি খেতে খেতে বলে,,
" বড় ভাই পাশে আছে এ কথা তোকে কে বললো শুনি।"
আয়াদ বড়সড় বিষম খেলো। চোখ বড় বড় করে তাকায় সাফির দিকে,,
" মানে।"
সানি চুপচাপ কফি খাচ্ছে। সাফি অনুরুপ কফি খেতে খেতে বলে,,
" ভালোবাসা দিয়ে কাওকে সুখী করা যায় আমি মানি। তবে মাঝে মাঝে ভালোবাসা দিয়ে কাওকে সুখী করা যায় না। কিছু কিছু অপূর্ণতা কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় সে সুখের মাঝে। আর আমি চাই না আমার বোন সে অপূর্ণতা পাক, সে কাটার আঘাত পাক। আমার বোন এমনি খুব নরম, খুবই আদরে বড় হয়েছে। আমার বোনের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলুক। আমি আমার বোনের গাঁয়ে আজ অবব্ধি হাত তুলি নি। আশা করি আর কেউ তুলবে না। আমি সানি সারার দুজনের ভালো চাই, আমি দুজনেরই বড় ভাই। তাদের ভালো মন্দ অবশ্যই আমাকে দেখতে হবে। আর সে ভালো মন্দের জন্য তাদের মাঝে যদি দাঁড়াতে হয় আমি সাফি মেহতাব খান দাঁড়াবো। তোর বয়স কত আর। আমি দেখেছি মামুনিকে পুড়তে। আমি বড় ভাই হিসেবে কখনও চাইবো না আমার বোন পড়ুক। আমি চাই দুজনে সুখে থাকুক। সানি যদি সবটা ঠিক করতে পারে তবেই আমি আমার বোনকে সানির হাতে তুলে দিবো অন্যথায় আমি হবো বড় বাধা।"
আয়াদ বিস্মিত হয়ে একবার সানির দিকে তাকাচ্ছে আর একবার সাফির দিকে তাকাচ্ছে। দুজনেই খুব স্বাভাবিক ভাবে কফি খেয়ে যাচ্ছে। দুজনের চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। সাফি কফি খাওয়া শেষ করে আয়াদ এর কাঁধে হাত রেখে বলে,,
" চল আয়াদ।"
আয়াদের কফি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। অবাক দৃষ্টি এখনও দুজনের দিকে। সাফি আয়াদের থেকে কফির মগ হাতে নিতে ঘোর কাটে আয়াদের। সাফি আবারও বলে,,
" এমন অবাক হওয়ার কিছু নেই। চল এবার,,।"
সাফি উঠে দাঁড়িয়ে সানির কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেঁসে বলে,,
" আসি তাহলে।"
" আচ্ছা যাও।"
সাফি সানির কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,,
" আমি জানি তুই পারবি।"
দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসে। আয়াদ অনুরূপ অবাক হয়ে দাঁড়ায়। সাফি পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বলে,,
" চল এবার।"
আয়াদ অবাক সাফির পেছনে হাঁটছে। বিস্মিত কন্ঠে বলে,,
" সাফি ভাই তোমার কয়টা রুপ বলো তো।"
" এ রুপ ছাড়া ভিন্ন কোনো রুপ দেখেছিস।"
" তুমি গিরগিটির মতো রঙ পাল্টাও। এতো দিন কি সুন্দর সিনেমার কিউট বড় ভাইয়ের মতো বোনের ভালোবাসা মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আজকে হুট করে পালটে গিয়ে বোনের ভালোবাসায় ভিলেন হয়ে গেলে কেন?"
সাফি নিশব্দে হেঁসে উঠে,,
" তুই এমনটা ভাবছিস কারন তুই আদৌ আমাকে চিনতে পারিস নি তাই। কিন্তু সানি আমাকে ঠিক চিনে।"
" তোমাকে চেনার উপায় আছে। হুট করে রঙ বদলাও তুমি। কিভাবে সানির ভাইয়ের সামনে ওই গুলো কথা বলে চিন্তায় ফেলে দিলে। এতো দিন পর বেচারা একটু মন থেকে খুশি হয়েছে আর তুমি মাঝখানে রেড সিগনাল কেন দিলে।"
" আমি তাদের সম্পর্কে রেড সিগনাল নাকি গ্রিন সিগনাল সেটা সানি খুব ভালো করে জানে। তোর জানতে হবে না। সানি জানে ওর কি করতে হবে। আর আমি জানি সানি পারবে। একটি মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা থাকলে, সে পৃথিবীর যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে।"
আয়াদ সাফির দিকে তাকিয়ে বলে,,
" তাহলে তোমার ভালোবাসা কেন জয়ী হলো না।"
মুহূর্তে পা আটকে যায় সাফির। একটু থেমে আবারও হাঁটতে হাঁটতে বলে,,
" আমারই ত্রুটি ছিলো তাই জয়ী হয় নি।"
আয়াদ আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না। পুরোনো কথা তুলতে চাই নি সে। তবে কথার ফ্লোরে বেড়েই গিয়েছে মুখ থেকে। আয়াদ অনুতপ্ত হয়ে বলে,,
" সরি ভাই।"
সাফি মুচকি হেঁসে আয়াদের কাঁধে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিলো,,
" সরি বলার কিছু নেই এখানে। যা সত্য সেটাই বলেছিস।"
" আমি আসলে ওই ভাবে বলতে চাই নি।"
" আরে পাগল তুই এতো গিলটি ফিল করছিস কেন?আমি বিন্দুমাত্র মন খারাপ করি নি। আমার এসবে বিন্দুমাত্র মন খারাপ হয় না। এসব তুই ভাবিস না তো। বাদ দে এসব কথা। আমি জানি তুই ভাবচ্ছিস সানি মন খারাপ করছে, দুশ্চিন্তা করছে তাই না। সানি আমার কথায় বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা করছে না। আমি শুধু ওর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিলাম। সানি যদি মন খারাপ করতো সবার আগে ছুটে আসতো আমার কাছে। বরাবরই সবার আগে সানি আমার কাছেই আসে। এমনকি আমার আদরের বোনকে আঘাত করে কাঁদতে কাঁদতে সবার আগে সানি আমার কাছেই এসেছিলো। যেখানে জানে আমি আমার বোনকে কোন আঘাত করতে দেই না। "
চলবে____