01/08/2025
‘পাতানো নিয়োগে’ অধ্যক্ষ হতে যাচ্ছেন
পিএইচডি জালিয়াতি করা উপাধ্যক্ষ
উপাধ্যক্ষ হয়েছিলেন ভুয়া সনদ দিয়ে। পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন জালিয়াতি করে। এখন তিনি ‘পাতানো নিয়োগে’ অধ্যক্ষ হতে যাচ্ছেন। এমন ঘটনা ঘটছে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইসলামিয়া ফাজিল (স্নাতক) মাদ্রাসায়। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ মোহাম্মাদ ওয়ারেছ আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ হয়েছে। তদন্ত শুরু হয়েছে তার পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েও।
ভবানীগঞ্জ ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমান গেল জানুয়ারিতে অবসর নেন। এরপর থেকেই অধ্যক্ষ হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন উপাধ্যক্ষ ওয়ারেছ আলী। এ জন্য গত ২ জুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। তবে গভর্নিং বডির সভায় কোন আলোচনাই হয়নি। আলোচনা ছাড়াই অত্যন্ত গোপনে একটি রেজ্যুলেশন তৈরি করে পাতানো নিয়োগের আয়োজন চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গোপনে এভাবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা ঘিরে এলাকায় তীব্র বিতর্ক উঠেছে।
স্থানীয়রা জানান, সভা না করে নিয়োগের জন্য বাড়ি গিয়ে গভর্নিং বডির কিছু সদস্যের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। যারা স্বাক্ষর দিতে চাননি, তাদের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এ নিয়ে গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি আব্দুস সামাদ ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বাক্ষর জাল করে একটি রেজ্যুলেশন দাখিল করা হয়েছে। পাতানো নিয়োগ দিতে এটা করা হয়েছে।’
হাইকোর্টের এডভোকেট থেকে লিগাল নোটিশ
সম্প্রতি এই পাতানো নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করতে একটি লিগাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে হাইকোর্টের এডভোকেট এর কাছ থেকে। নোটিশে বলা হয়, উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যখন একাধিক অভিযোগ তদন্তাধীন, তখন তাঁকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি এবং নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। নোটিশে নিয়োগ প্রক্রিয়া অবিলম্বে স্থগিতের দাবি জানানো হয়েছে, নচেৎ হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলেও জানানো হয়।
স্থানীয়রা জানান, ওয়ারেছ আলী অনেক দিন ধরেই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের পদ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর তিনি তৎকালীন অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমানকে সরিয়ে দিতে তাকে অবরুদ্ধ করিয়েছিলেন কিছু শিক্ষার্থীকে দিয়ে। এভাবে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) হস্তক্ষেপে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জানুয়ারিতে জিল্লুর রহমান অবসরে গেলে এখন তিনি অধ্যক্ষ হতে তোড়জোড় করছেন। এভাবে নিয়োগ দিলে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট বলে মত স্থানীয়দের।
তারা জানান, ওয়ারেছ আলী ২০০৩ সালে খাটিয়ে উপাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। ২০০২ সালের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী, ফাজিল মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য প্রয়োজন ফাজিল স্তরের কোনো প্রতিষ্ঠানে নূন্যতম ৬ বছরের প্রভাষক পদে অভিজ্ঞতা, অথবা আলিম মাদ্রাসায় ৭ বছরের অভিজ্ঞতা, অথবা কামিল পাসসহ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় ডিগ্রি। অথচ ওয়ারেছ আলী কখনোই কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেননি এবং তাঁর প্রকৃত কামিল পাস সনদও ছিল না। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ থেকে পাস করেছিলেন। যোগদানের সময় তাঁর প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছিল না। কামিল পাস না থাকায় বেতন-ভাতার অনুমোদন না পেয়ে তিনি ভুয়া কামিল সনদ জমা দিয়ে এমপিওভুক্ত হন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী বিরুদ্ধে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনে গুরুতর জালিয়াতিরও অভিযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী উপাচার্যের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে দাবি করেন, ওয়ারেছ আলী ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই ২০০৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অভিযোগ অনুযায়ী, তাঁর গবেষণাপত্রের ৯০ শতাংশের বেশি অংশ বিভিন্ন প্রকাশনা ও গবেষণা থেকে হুবহু কপি করা হয়েছে। অনলাইন প্ল্যাগিয়ারিজম পরীক্ষায় বিষয়টি ধরা পড়ে বলে দাবি করা হয়। এছাড়াও গবেষণায় উপাত্ত ও ফলাফল ভুলভাবে উপস্থাপন, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং তৃতীয় পক্ষ দিয়ে থিসিস সম্পাদনার অভিযোগও রয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকিব বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন করছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একাডেমিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মাদ ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘আমার সনদ, পিএইচডি সব ঠিক আছে। জালিয়াতি, কপি কি পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব?’ তিনি বলেন, ‘আমি অধ্যক্ষ হতে চাই। সে জন্য মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। এটা কোন পাতানো নিয়োগ না।’ গভর্নিং বডির সহসভাপতির লিখিত অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখন নিয়োগ না দিলে সেটা অনেক দেরি হয়ে যাবে। তিনি ছিলেন না। তিনি না থাকলে তো আর সব থেমে থাকবে না।