10/11/2025
স্বাধীনতা, সমতা ও উন্নতির পাশ্চাত্য ধারণার সাথে নারীবাদী আন্দোলনের সম্পর্কটা সুস্পষ্ট। ফেমিনিস্টদের দাবির প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাদের প্রতিটি দাবির পেছনেই এই বিশ্বাসগুলো কাজ করে।
নারীবাদ সৃষ্টির পেছনে ইউরোপের বর্বরতার ইতিহাস থাকলেও পাশ্চাত্য বিশ্বাসই এটাকে স্বতন্ত্র মতবাদ কিংবা ইজমে রূপান্তরিত করেছে।
ইউরোপের খ্রিষ্টানসমাজে নারী নির্যাতনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। খ্রিষ্টানসমাজের নারীরা এই নিপীড়নমূলক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেদের বিকৃত ধর্মে এর সমাধান খোঁজে। সেখানে কোনো সমাধানের অস্তিত্ব তারা পায়নি। নিজেদের মূল্যায়ন ও উল্লেখযোগ্য কোনো অধিকারেরও সন্ধান পায়নি তারা খ্রিষ্টধর্মে। তখন তারা মুক্তির জন্য পাশ্চাত্যের ঘোষিত মূলনীতি বেছে নেয়। গ্রহণ করে পাশ্চাত্যের স্বাধীনতা, সমতা আর উন্নতির বস্তাপচা ধারণা।
পুরো নারীবাদকে আমরা ৩টি দাবি কিংবা স্লোগানের ভেতর দিয়ে দেখতে পারি। চলুন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করি।
▐ || প্রথম স্লোগান ||
""নারী তোমার উপর থাকতে পারবে না কারো কর্তৃত্ব, তুমি স্বয়ংসম্পূর্ণ, তোমার কারো প্রয়োজন নেই। স্বামী, সন্তান, পরিবার— সবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিষয়।""
নারীবাদীদের এমন স্লোগানের মূলে রয়েছে পাশ্চাত্য স্বাধীনতার দর্শন। কি ধর্ম, কি পরিবার আর কি সমাজ, কারো বেঁধে দেওয়া ভালো-মন্দে নারী বিশ্বাসী হতে পারে না। সে যা ভালো মনে করবে, তা-ই করবে।
নারী যখন এই পাশ্চাত্য স্বাধীনতাকে গ্রহণ করতে চাইবে তখন ঘরে অবস্থান, পরিবার পরিচালনা, পুরুষের অভিভাবকত্ব গ্রহণের মতো আল্লাহপ্রদত্ত বিষয়গুলো পরাধীনতা কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বোঝাই মনে হবে। পর্দার বিধানকে সে শেকল, আর বস্তাবন্দি বলে আখ্যায়িত করবে। আর এভাবেই সে আল্লাহপ্রদত্ত কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে পাশ্চাত্যের দাসত্বে প্রবেশ করে আর নিজেকে কথিত স্বাধীন ভাবতে শুরু করে।
তাই তাদের সকল সমস্যা নারীর আল্লাহপ্রদত্ত মাতৃত্ববোধের সাথে। পরিবারকে খুশি রাখা, সংসারের প্রতি মনোযোগী হওয়া, সন্তান প্রতিপালন করার ব্যাপারে সিরিয়াস থাকাই তাদের কাছে পরাধীনতা; অথচ এগুলো নারীর সহজাত-প্রাকৃতিক ভূমিকা। তাদের কাছে একজন নারীর স্বাধীনতা হলো নগদ আর্থিক বিনিময় প্রাপ্তি, এমনকি যদি তা হয় দেহসর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেও।
▐ || দ্বিতীয় স্লোগান ||
""নারী! একজন পুরুষ কখনোই তোমার আস্থার জায়গা হতে পারে না ! এজন্য তুমি তার উপর নির্ভর না করে বরং তার প্রতিদ্বন্দ্বী হও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও। তাল মিলিয়ে চলো, এগিয়ে যাও তাকে পেছনে লেগে।""
এই স্লোগানটি দেখবেন পাশ্চাত্য সমতার সাথে সম্পৃক্ত। ভালো নির্ধারণ করার যখন সবার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা রয়েছে, তখন একজন নারী কেন তার স্বাধীনতা (নিজের ভালো-মন্দ নির্ধারণ করার ক্ষমতা) ভোগ করবে না? কেন এখানে নারী-পুরুষের ব্যবধান সৃষ্টি করা হবে? পুরুষ কেন উত্তরাধিকার সম্পত্তি নারীর চেয়ে বেশি পাবে? পুরুষ বাইরে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারলে নারী কেন পারবে না?
পাশ্চাত্য সমতাকে স্ট্যান্ডার্ড মেনে নিলে এরকম নানান জায়গায় প্রশ্ন আসবে, যেখানে নারী-পুরুষের বিধান ও অধিকারের মাঝে ব্যবধান রয়েছে। কারণ ইসলাম সমতাকে মানদণ্ড মানে না। ইসলাম সর্বদা ইনসাফের পক্ষে থাকে, সমতার সাথে নয়। কারণ প্রচলিত সমান অধিকারের ধারণা সব জায়গায় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষ তা এক পক্ষের উপর জুলুম বয়ে আনে।
▎ সবাইকে সব দেওয়াই ন্যায় নয়। যার যা প্রয়োজন, এবং যার সাথে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ– তাকে তা প্রদান করাই হলো ন্যায়।
পুরুষকে স্ত্রী, মা, বাবাসহ পরিবারের সবার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামে নারীকে কারো ব্যয় বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এই দায়িত্ব আল্লাহকর্তৃক নির্ধারিত। কাজেই নারী যা পাবে, সবটাই তার সেভিং। সেখানে কারো প্রাপ্য অংশ নেই। ফলে পুরুষের টাকার প্রয়োজন বেশি এবং উপার্জন ও খাদ্যযোগানের জন্য তাকে আবশ্যিকভাবে নিয়মিত বাইরে যেতে হয়। এজন্য তাকে বেশি ভাগ দেওয়া হয়েছে এবং তাকে বাহির সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আবার বাহির সামলানোর দায়িত্ব নারীর নয়। তার দায়িত্বের জায়গা পরিবার। ফলে তাকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করাকে ফরজ করা হয়েছে স্বামীর উপর। আর বাবার সম্পত্তি তার জন্য অতিরিক্ত সম্পত্তির ভাগে তাকে কম দেওয়াটা অন্যায় নয়; বরং ন্যায়সঙ্গত। স্বামী যদি তার দায়িত্ব পালন না করে তাহলে স্ত্রীর অধিকার আছে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার।
▎ নারী-পুরুষ কেউই সমান নয়, বরং একজন আরেকজনের জন্য পরিপূরক, দুজনে মিলেই সম্পূর্ণতা৷
আধুনিক সময়ে এসে নারী পুরুষের এই সমতার প্রশ্ন শুধু বিধান এবং অধিকারেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন সৃষ্টিগত এবং জিনগতভাবেই নারী-পুরুষের সমতার দাবি তোলা হচ্ছে। নারীবাদ ও তার পৃষ্ঠপোষকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নারী-পুরুষের পার্থক্য নিছক একটি সামাজিক নির্মাণ বা সোসাল কন্সট্রাক্ট (জেন্ডার ধারণা)! আদতে এখানে বায়োলজিক্যাল কোনো ব্যবধান নেই। সমাজে প্রচলিত বৈষম্যের ফলেই একজন মেয়ে কোমল, ঘরের কোণে থাকতে পছন্দ করা, মাতৃত্ব ইত্যাদি গুণসম্পন্ন মানবীতে পরিণত হয়! নতুবা সেও ছেলেদের মতো বহির্মুখী ও পুরুষালি গুণাবলির অধিকারী হতো!
আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই মিথের পক্ষে পশ্চিমা রিসার্চ পেপারও পাওয়া যায়! বড় অদ্ভুত তাদের গবেষণা! আদতে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ বিজ্ঞান আর গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো চলে ক্ষমতা আর মিথ্যাচারের উপর। পৃথিবীর অধিকাংশ কর্মকাণ্ড একসেট মিথ্যাচারের উপর ভিত্তি করে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য পরিচালিত হচ্ছে। মিডিয়া, বিজ্ঞান, অর্থনীতি সবকিছু। পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা রক্ষার জন্য পাশ্চাত্য পক্ষপাতদুষ্ট গবেষণা ও ফল প্রকাশ করে তারা। এটা তারা করে আসছে যুগ যুগ ধরে। নতুবা ডোনেশনের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে বেশ্যাবৃত্তির মতো এই অদ্ভুত বিজ্ঞানচর্চা! বিস্তারিত বইতে।
এজন্যই বলি, বিজ্ঞান দিয়ে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে বিজ্ঞানের সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে নিশ্চিত করে নেওয়া দরকার। বিজ্ঞান অকাট্য কোনো বিষয় নয় যে তার সবকিছু চিরসত্য হবে, নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যাবে। কিন্তু ইসলাম চিরসত্য এবং অকাট্য।
▐ || তৃতীয় স্লোগান ||
""নারী! তোমার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাই তোমার সম্মানের একমাত্র উপায়। অন্যের আয়ের উপর নির্ভরশীল হলে মানে তুমি নিজের সম্মান হারালে। এজন্য তোমাকে নিজস্ব অর্থনৈতিক আয়ে স্বাবলম্বী হতে হবে।""
নারীবাদীদের এই স্লোগানটির সম্পর্ক পাশ্চাত্য আকিদার তৃতীয় বিষয় তথা উন্নতির সাথে, যেখানে উন্নয়নকে মাপা হয় কেবল জিডিপি আর জিএনপির স্কেলে। ফলে পরিবারের আঙিনায় নারীর ভূমিকার মূল্যায়ন করা হয় না পাশ্চাত্য সমাজে। নারীকে ঘর থেকে বের করে কর্মস্থলে আনতে পারাটাই যেন দেশের উন্নয়ন এবং নারী অধিকারের বাস্তবায়ন। এগুলোকে উন্নয়ন তখনই মনে হবে যখন পাশ্চাত্যের উন্নতিকে বিশ্বাস করা হবে।
উন্নতির ইসলামি স্কেল দিয়ে দেখলে আপনি নারীর সামাজিক ও পরিবারিক অধিকার, তার মাতৃত্বের সংরক্ষণ, পরিবার গোছানো সন্তান প্রতিপালন এবং শিশুর সুস্থতা ও পূর্ণাঙ্গ মানসিক বিকাশের মাঝেই উন্নতি খুঁজে পাবেন। নারীর মূল ক্যারিয়ারের সম্পর্ক তার মাতৃত্বের সাথে, নারীত্বের সাথে, মাথাপিছু আয় বাড়ানোর সাথে নয়। মাতৃত্ব-ই নারীর মূল ক্যারিয়ার, নারীত্বের সাথে যা সম্পৃক্ত। মুখে স্বীকার না করলেও এটাই প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত। আল্লাহর দেওয়া বিশ্বজনীন নিয়ম।
▎ এই পুঁজিবাদী বিশ্বে নারীর 'পারিবারিক ভূমিকা'র কোনো বাজারমূল্য নেই। বস্তুগত বিনিময় না থাকায় দিন-রাত চবিশ ঘন্টা ঘরের কাজে ব্যস্ত গৃহিণীও পুঁজিবাদের দৃষ্টিতে বেকার, নারী ঘরের কাজ নিজে করলে তার কোনো হিসাবই যোগ হয় না জিডিপিতে, ফলস্বরূপ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণে ঘরের কাজের নেই কোনো মূল্য! নেই পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এর কোনো হিসাব। কিন্তু ইসলামে এর কোনো বিকল্প নেই। পুঁজি দিয়ে সমাজ ও পরিবারের প্রতি নারীর এই অবদান ক্রয় করা সম্ভব নয়।
বাজারমূল্যের চেয়েও অনেক ঊর্ধ্বের বিষয় এই ভূমিকা, যাকে পরিমাপ করার মতো ভারী কোনো মানদণ্ড নেই পাশ্চাত্য সমাজে। অথচ আল-কুরআন ছোট একটি বাক্যে কত সুন্দর মূল্যায়ন করেছে। ইরশাদ হয়েছে, "তোমরা একে অন্যের পরিপূরক। একজনের কমতিকে আরেকজন পূরণ করো, এভাবেই তৈরি হয় পরিপূর্ণতা।" [২:১৮৭]
▎ নারীবাদীদের উপরোক্ত স্লোগানের বাস্তবায়নই হচ্ছে নারীদের পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্তি! কেবল অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের জন্য যা যা করা প্রয়োজন তাই করতে শেখায় নারীবাদ। ফলশ্রুতিতে শুরু থেকেই এই নারীবাদ বিয়েপ্রথার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। যেকোনো মূল্যে, যেকোনো প্রোপাগান্ডায় নারীদের বিয়ে থেকে মুখ ফেরানো, বিয়ে বা পরিবার গঠনে অনাগ্রহী করে তোলা, এবং পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্ত করাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। কারণ একটাই— অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের এই পাশ্চাত্য মাপকাঠি! যা একজন নারীকে পরিণত করে পুঁজিবাদের দাসিতে।
আপনি যদি পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতে শ্রেষ্ঠ নারী খোঁজেন তাহলে খাদিজা, আয়েশা, ফাতেমা (রাঃ)-দের মতো উন্মাহর আদর্শ মেয়ে, স্ত্রী ও মায়েদের শ্রেষ্ঠ হিসাবে আবিষ্কার করতে পারবেন না। তাদেরকে আপনার কাছে সেকেলে, বস্তাবন্দি, পরাধীন, অসহায়, নিগৃহীত, ও ব্যর্থ মনে হবে। অথচ এই পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন নারী।
একজন নারী যতই মমতাময়ী ও সাংসারিক হোক, আদর্শে চরিত্রে-গুণে যতই উন্নত হোক, পাশ্চাত্যের মানদণ্ডে সে ব্যর্থ নারী, যদি না সে টাকা কামাই করছে! বস্তুগত ভোগের সক্ষমতা অর্জন করছে!
কাজে-কর্মে আত্মবিশ্বাসী একজন সফল গৃহিণীও এই মানদণ্ডে ব্যর্থ ও অসফল। এখানে ভোগবাদী ও বস্তুবাদী অর্থনৈতিক ক্যারিয়ারই সবকিছু। এজন্য দেহ বিক্রি করে, হাজারো পুরুষের মনোরঞ্জন করে যেসব নারী কথিত ক্যারিয়ার গড়ছে, নারীবাদীদের দৃষ্টিতে তারাও সফল। তারাই ফেমিনিস্টদের আইডল। তাদের মতে ভোগের সক্ষমতা লাভ ও অর্থ উপার্জনই নির্ধারণ করবে নারীর মূল্যমান। আর এই মানদণ্ডই পুঁজিবাদের ফাদ, ও সেবক৷
▐ সমাধান কোন পথে?
নারীবাদীরা নারীত্বকে ঘৃণা করে, নারীর সত্তাকে ঘৃণা করে। পুরুষত্বকে মনে করে নারীত্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। তাই তারা তাদের নিজস্ব প্রকৃতি ছেড়ে পুরুষের প্রকৃতি গ্রহণ করতে চায়। নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্জন করে পুরুষের অনুকরণ করতে চায়। এখানে কোনো স্বকীয়তা নেই, নেই কোনো অনন্যতা। একজন নারীবাদী নারী তার স্বামীকে খদ্দেরের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারে না, যেখানে কারেন্সি বা বিনিময়ই মুখ্য। প্রেম, ভালোবাসা, মমতা ও দায়িত্ববোধের সেখানে কোনো বালাই নেই। অর্থই সব, ভোগই জীবন!
আল্লাহ নারী-পুরুষ সত্তাকে সৃষ্টি করেছেন স্বকীয়, অনন্য, ও একক বৈশিষ্ট্য দ্বারা। এক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে কেউ কারো উপরে নয়! দুজনে মিলেই এক সত্তা রূপে বিবেচিত। এখানে অপরের থেকে কেবল ভোগ নয়, একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতেও শিখায় ইসলাম। আর এদিক দিয়ে নারীবাদ হলো সম্পূর্ণ বিপরীত।
▎ নারীবাদ হলো চরম ভোগবাদী চিন্তাভাবনা। মেকআপ, ড্রেসিং, দেহ, ইনকাম, ভোগের সামর্থ্য অর্জন আর বিচরণ স্বাধীনতার মাঝেই আটকে আছে তাদের পরিচয়। তারা মনে করে এগুলো করতে পারাই একজন নারীর সফলতা! যা মূলত সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভোগবাদী-বস্তুবাদী মানসিকতার ফল।
এই ফেমিনিজমের মোকাবিলায় পাশ্চাত্যের এই বিশ্বাসগুলোতে আঘাত করার পাশাপাশি আমাদের ইসলামপ্রদত্ত নারী অধিকার সমাজে বাস্তবায়ন করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে, এই জায়গাটায় আমাদের চরম পর্যায়ের অবহেলা রয়েছে...।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পার্শ্ববর্তী শিরকি সমাজের প্রভাবে এবং ইসলাম পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণে যুগ্ধ যুগ ধরে আমাদের সমাজে নারীদের সাথে এমন কিছু বিষয় জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ইসলামে অনুমোদিত নয়। অথচ সাধারণ মুসলিমরা এগুলো ইসলামি নির্দেশনা বলে বিশ্বাস করে আসছে। যেমন মোহর আদায়ে গড়িমসি করা, সম্পদের মিরাস ও পারিবারিক অধিকার যথাযথরূপে আদায় না করা, এবং সামগ্রিক জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলামপ্রদত্ত নারীর অধিকার গুলো ধামাচাপা দেওয়া।
▎ পশ্চিমা নারীবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করা অনেকেই ভুলে যান, আমরা যখন পশ্চিমা নারীবাদের বিরুদ্ধে কথা বলব তখন ইসলামপ্রদত্ত নারীর অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া একপ্রকার ভণ্ডামি।
বর্তমান মুসলিম সমাজে নারীরা যে প্রাপ্যগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে, তা হলো মোহর, উত্তরাধিকার সম্পত্তি, এবং আর্থিক ভরণপোষণের নিশ্চয়তা। নারীদের মিরাস চাওয়াকে নির্লজ্জতা এবং ঘৃণার চোখে দেখা হয়। ভাইয়েরা ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে দায়সারাভাবে কিছু টাকা দিয়ে বোনদের এই অধিকার কেড়ে নেয়। তাদেরকে বঞ্চিত করে প্রাপ্য অধিকার থেকে। আর স্বামীরা মোহরকে অঘোষিতভাবে রহিতই করে দিয়েছে সমাজ থেকে। মহর এখন কাগুজে সংখ্যা ছাড়া কিছুই না। অনেকে তো সারাজীবন স্ত্রীর ভরণ পোষণকেই মোহর হিসেবে গণ্য করে থাকে। অথচ স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও বাসস্থান স্বামীর উপর আলাদা ওয়াজিব। মোহরের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
নারীর আর্থিক ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পুরুষের উপর ন্যস্ত (ফরজ) থাকলেও আজ তারা এই ব্যাপারে গাফেল, আবার সমাজে বাড়ছে ডিভোর্সের হার, ফলশ্রুতিতে এই অনিশ্চয়তায় পশ্চিমা নারীবাদী ক্যারিয়ারিজমের ধারণায় প্রবেশ করতে বাধ্য হয় অসংখ্য মেয়ে! মূলত সুস্থ মস্তিষ্কের সাধারণ মেয়েরাও নারীবাদী চিন্তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে সমাজে থাকা এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যার ছিদ্রগুলো দিয়েই। এগুলোর সম্পূর্ণ শারঈ সমাধান না করে তাই নারীবাদী চিন্তার প্রসারকে দমানোর কোনো সুযোগ নেই।
▎ আমাদের সমাজে নারী নির্যাতন ও হেনস্তার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো যৌতুক। পূর্বনির্ধারিত কিংবা কাঙ্ক্ষিত অর্থ বা বস্তু না পেলে সারাজীবন বউয়ের উপর এর শোধ তোলে স্বামীর পরিবার। যৌতুকের জের ধরে বহু নারী অকালে ঝরে পড়ে। অসংখ্য নারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। আবার অনেকে সারাজীবন হজম করে যায় নানারকম ঘোটা ও কটু কথা।
নারীর উপর এই যৌতুকের বোঝা ইসলাম চাপিয়ে দেয়নি, দিয়েছে হিন্দুপ্রভাবিত সমাজ। ইসলামে যৌতুকের অর্থ সম্পূর্ণ হারাম। স্ত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় কোনো প্রকার উপটৌকন এসে গেলে ভিন্ন কথা। কিন্তু চুক্তি করে কিংবা পূর্বাকাঙ্ক্ষা থেকে সম্পদ না পেয়ে স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালানো কিংবা তাকে কটু কথা শোনানো সম্পূর্ণ জুলুম। ইসলামে এর কোনো বৈধতা নেই। একইভাবে নিকাহের ক্ষেত্রেও ইসলামে কনেপক্ষের কোন বাধ্যতামূলক খরচ নেই।
▎ জীবনদর্শন কিছুটা সেক্যুলার, কিছুটা ইসলামী, কিছুটা হিন্দুয়ানী টাইপ গোঁজামিল হলে নারীদের ক্ষেত্রে জুলুম হওয়াটাই স্বাভাবিক, তবে এর দায় ইসলামের নয়। ইসলামকে দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে, বার্ডস আই ভিউতে। ফল পেতে হলে বাস্তবায়ন করতে হবে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম, আধখেচরা ইসলাম থেকে হওয়া সমস্যার দোষ সম্পূর্ণ ইসলামের নয়।
নারী-পুরুষের ব্যাপারে যৌথভাবে ইসলামে যে নির্দেশনা রয়েছে, তাকে যদি কেউ একতরফাভাবে দেখে তা হলে সে ইসলামের ভারসাম্য বুঝতে পারবে না। যেমন : কেউ শুধু নারীদের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা দেখল তাদেরকে স্বামীর সন্তুষ্টি হাসিলের নির্দেশ করা হয়েছে, ঘরের ভেতরই তাদের মূল অবস্থান ছির করা হয়েছে ইত্যাদি; তখন সে ভাববে ইসলাম নারীদের অবহেলা করেছে এবং পুরুষদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
আবার কেউ একপাক্ষিক পুরুষদের প্রতি ইসলামের নির্দেশনাগুলো দেখলো : জান্নাতের অন্যতম শর্ত পুরুষদের চারিত্রিক সার্টিফিকেট স্ত্রীদের হাতে, নারীর ভরণ-পোষণ, আবাসন, ঘরোয়া কাজসহ সবধরনের অর্থনৈতিক দায়ভার বাধ্যতামূলকভাবে শুধু পুরুষদের কাঁধে, তখন সে মনে করবে ইসলাম পুরুষদের উপর জুলুম করেছে। অথচ ব্যাপার তা নয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ এবং সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা। তার পূর্ণতা ও সামগ্রিকতা বাদ দিয়ে খন্ডাংশ নিয়ে পড়ে থাকলে ফ্যাসাদ হবেই।
▎ ইসলাম সমতা, প্রগতি, ক্ষমতায়ন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ইত্যাদির দর্শন গুলোকে স্বীকার করে না। আর সামগ্রিকভাবে না দেখে দ্বীনকে আংশিকভাবে তুলে পাশ্চাত্য মানদণ্ড দ্বারা বিচার করলে ইসলামকে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়াই স্বাভাবিক! ইসলামের দিকে ছুড়ে দেওয়া 'নারী-সংশ্লিষ্ট' সমস্ত আপত্তির মূলে আছে এই সমস্যা।
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ কেউ প্রতিদ্বন্দ্বি নয়, বরং এক একজন অপরজনের পরিপূরক। তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা প্রতিযোগিতার নয়, ভালোবাসার। আল্লাহ বলেন,
"তোমরা একে অন্যের পোশাকস্বরূপ।" [২:২৮৬]
— সমাপ্ত —
লেখা : ইফতেখার সিফাত (হাফি.)
বিশিষ্ট ইসলামী লেখক, অনুবাদক, চিন্তক
প্রবন্ধঃ ফেমিনিজম বা নারীবাদ
অধ্যায়ঃ পাশ্চাত্যের কিছু মতবাদ
বইঃ "হিউমান বিয়িং : শতাব্দীর বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব"