19/07/2025
গল্প: “স্বপ্নে ফিরে আসে সে”
পর্ব - ১২
রাত তখন একটায় গড়িয়ে দুটোর দিক ছুঁই ছুঁই। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু ছাদে টুপটাপ শব্দ এখনো কানে বাজে। নীরা বিছানায় ঘুমোতে পারছে না। বুকের ভেতরে একটা চেপে থাকা অনুভূতি—অজানা, অজস্র, অপূর্ণ।
হঠাৎ মনে পড়ে, ক্লাউড ব্যাকআপে সে একসময় কিছু ভয়েস নোট সংরক্ষণ করে রেখেছিল। ফোনের সেটিংসে গিয়ে খুঁজে বের করতেই শুনতে পেল সেই ভয়েস ক্লিপটি—
“তুমি জানো, আমি হয়তো ভালোবাসতে জানতাম না… কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কল্পনাও করতাম না, নীরা…”
রেদোয়ান।
তার কণ্ঠ, তার স্বর… এই শব্দগুলো কত বছর বাদে আজ আবার শোনা গেল, অথচ স্মৃতি কখনো পুরনো হয় না। আবার মনে পড়ল সেই বিকেল, যেখানে নীরা একা বসে কাঁদছিল রেলস্টেশনে। তখনো জানত না, রেদোয়ান আর আসবে না। সে তখন এক ধনীর মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছিল।
নীরা সেইদিন একা কেবল স্টেশনে অপেক্ষা করেনি—সেইদিন সে তার সমস্ত নির্ভরতা হারিয়ে ফেলেছিল।
---
সকালে নীরার ঘুম ভাঙল তনুর ডাকে।
“আম্মু, আমার রং শেষ হয়ে গেছে, স্কুলে নিয়ে যাব কী করে?”
“আম্মু, তূর্জ আমার বোতল নিয়ে নিচ্ছে!”
এই দুই কণ্ঠই যেন বাস্তবের হাতছানি। নীরা ঘুম জড়ানো চোখে জেগে উঠে পড়ে।
দুটো ছেলেমেয়ের মুখে যেন তার পৃথিবী গঠিত।
তানভীর দ্রুত অফিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। যাওয়ার সময় হঠাৎ থেমে বলে,
“আজ অনেকদিন পর তোমাকে একটু হাসতে দেখলাম, জানো?”
নীরা অবাক হয়ে তাকায়।
তানভীর হেসে বলে, “সকালে তোমার হাতের এক কাপ চা না খেলে কেমন যেনো অপূর্ণ থেকে যায় সারাটাদিন
তানভীর সবসময় এমন নয়। সে কখনো রোমান্টিক কিছু বলে না, ফুল আনে না, ‘ভালোবাসি’ বলেনা।
তবুও তার আচরণে এক ধরনের নির্ভরতা থাকে।
---
বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে ফিরে এসে নীরা বসে থাকে জানালার পাশে। হঠাৎ তার মন চায়, পুরনো ডায়েরিগুলো পড়বে।
আলমারির নিচ থেকে বের করে, পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে সে দেখে এক পৃষ্ঠা যেখানে লেখা—
> “রেদোয়ান, আমি জানি, তুমি কোনোদিন আমায় ফিরে চাইবে না।
কিন্তু আমি সবসময় চাইবো, তোমার ভালো হোক।
আমি তোমাকে অভিশাপ দিইনি কোনোদিন, কেবল প্রতিদিন একটু করে মরেছি তোমার অভাবে।”
নীরা ডায়েরি বন্ধ করে। চোখ ভিজে ওঠে। কিন্তু সেই ভিজে থাকা চোখে এখন আর অপেক্ষা নেই, নেই প্রার্থনা।
শুধুই স্মৃতি।
---
একটু পর ফোনে মেসেজ আসে—সাইফ।
“তুমি আজ কি লেখনি কিছু? আজকাল তোমার পোস্ট না দেখলে মনে হয়, তুমি ঠিক আছো কিনা জানি না।”
নীরা পড়ে, কিন্তু উত্তর দেয় না।
এই ছেলেটার একরকম নীরব উপস্থিতি আছে নীরার জীবনে। সে ভালোবাসে, কিন্তু দাবি করে না।
একটা সময় ছিল, সাইফ ক্লাসে নীরাকে এক পলক দেখেই সারাদিন চুপ থাকত। বলতো না কিছু, কিন্তু বুঝিয়ে দিত অনেক কিছু।
এখনো তার কথায় সেই শ্রদ্ধা আছে।
নীরা সাইফকে ভালোবাসে না, কিন্তু সম্মান করে।
---
বিকেলে তানভীর হঠাৎ অফিস থেকে ফোন করে।
“আজ কি তুমি আমার সঙ্গে একটু হাঁটতে যাবে?
নীরা চমকে যায়। “তুমি তো হাঁটতে চাও না কখনো!”
তানভীর বলে, “আজ চেয়েছি। কারণ আমি বুঝেছি, তোমার পাশে থাকা মানে কেবল ঘরের চার দেয়ালে বাঁচা নয়।”
এই কথাটুকু যেন অনেক বছরের অবহেলার জবাব।
সেই রাতে তারা ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। হালকা বাতাস, আকাশে ভাসমান মেঘ।
তানভীর বলে, “আমি হয়তো ভুল করেছি অনেকবার। তোমাকে সময় দিইনি, বোঝার চেষ্টা করিনি। কিন্তু আমি চাই এখন থেকে শিখি, কিভাবে পাশে থাকা যায়।”
নীরার চোখে পানি আসে। সে শুধু একটা কথা বলে—
“তুমি পাশে থাকলেই হয়, বাকি সব আমি ঠিক করে নিবো।”
---
রাতে নীরা ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে—
> “রেদোয়ান, তুমি কষ্ট পাও—জানি।
তুমি হয়তো এখনো ভালোবাসো—জানি।
কিন্তু আমি আজ জানি, তুমি আর আমার জীবনের কেউ নও।
সাইফ, তুমি শ্রদ্ধার এক নাম।
কিন্তু তানভীর, তুমি আমার সময়ের বাস্তবতা।
আর তনু আর তূর্জ—তারা আমার ভবিষ্যৎ।
অতীত আমাকে কাঁদায়, বর্তমান আমাকে গড়ায়।”
#চলবে ……
🪡গল্প-কবিতার শহর
#বাংলা_গল্প #ফেসবুক_গল্প