
09/07/2025
গল্প: “স্বপ্নে ফিরে আসে সে”
পর্ব-০৮
রাতের শেষ প্রহর। জানালার ফাঁক গলে ফিকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে বিছানায়। ঘরের নিস্তব্ধতা শুধু মাঝে মাঝে ভাঙছে ঘড়ির টিকটিক শব্দে। হঠাৎই এক ঘোর ভাঙা স্বপ্ন থেকে চমকে উঠে বসল নীরা। বুক ধকধক করছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
স্বপ্নে আবার রেদোয়ান।
ঠিক যেন সেই কলেজ জীবনের ছাদ, চারপাশের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা। বলছে—“নীরার হাতে হাত রেখে -এখনো ভালোবাসো তো আমায়?”
নীরা রেদোয়ানের হাত শক্ত করে ধরে আছে, সেই একই অনুভূতি, ঠিক যেমন প্রথম যেদিন রেদোয়ানের হাতের স্পর্শে অন্যরকম এক অনুভূতি হয়েছিল নীরার। কিন্তু কোথাও যেন একটা অজানা কষ্ট বুকের ভেতর খচ করে উঠে। ঘুম ভাঙতেই চোখে জল টলমল করছিল। সে বুঝে উঠতে পারে না, কেন এই মানুষটা এখনো ফিরে আসে তার ঘুমে—যখন বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। স্বপ্ন নাকি সারাদিনের চিন্তার প্রতিফলন হিসবে রাতে আসে, তাহলে বাস্তবে তো কখনও নীরা রেদোয়ান কে নিয়ে এক মুহুর্ত ও ভাবে না, বরং তার প্রতি আছে এক রাশ ঘৃণা…
পাশে তাকাতেই দেখে, তানভীর শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে। আর দুই পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে তনু আর তূর্জ। ওদের নিঃশ্বাসে একরাশ প্রশান্তি মিশে আছে। ওদের মুখের দিকে তাকালে সব কিছু ভুলে যায় নীরা। এই দুই সন্তানই তো তার পৃথিবী।
তনু আর তূর্জ এখন স্কুলে যায়, বয়স পাঁচ। ইউনিফর্ম পরা মুখে যখন সকালবেলা স্কুলবাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তখন নীরার মনে হয় তার সমস্ত ক্লান্তি মুছে যায়। তাদের হাতে ছোট ছোট ব্যাগ, চোখে নতুন কিছু শেখার উচ্ছ্বাস—এসবই তো তার স্বপ্নপূরণের প্রতীক।
তানভীর অফিসে ব্যস্ত থাকলেও বাচ্চাদের সময় দেয়, যদিও নীরার প্রতি তার আচরণে মাঝে মাঝে একরকম উদাসীনতা ধরা পড়ে। কথা বলে কম, ছুঁয়ে দেয় না তেমন, একসাথে চা খাওয়ার অভ্যাসও ফিকে হয়ে গেছে বহুদিন। তবুও এই মানুষটার সঙ্গেই সে কাটিয়ে দিয়েছে দশটি বছর। সুখ-দুঃখ মিলিয়ে একছাদের নিচে চলেছে জীবন।
তবু মাঝে মাঝে যখন রেদোয়ানের স্বপ্ন আসে, নীরার ভেতরে এক অদ্ভুত কষ্ট জন্ম নেয়। শুধু এই প্রশ্নটা যেন তাকে ঘুমাতে দেয় না—“আমি কি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম?”
অথচ ভালোবেসেছিল সে নিঃস্বার্থভাবে। নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে, রেদোয়ানকে বিশ্বাস করে ছিল অন্ধভাবে। আর রেদোয়ান তাকে ছেড়ে বেছে নিয়েছিল এক ধনী পরিবারের মেয়েকে, প্রতিষ্ঠা আর সম্মানের মোহে।
নীরা জানে, সে নিজেকে শক্ত করেছে। আজ তার জীবনে রেদোয়ানের কোনো স্থান নেই। সে সবকিছু পেছনে ফেলেছে। কিন্তু মনের গভীরে যে প্রেম ছিল, তা কি একদিনে শেষ হয়ে যায়? যে অভিমান তাকে গেঁথে রেখেছে এতগুলো বছর, সেই অনুভূতিটাই কি শেষ না হওয়া ভালোবাসা?
তূর্জ হঠাৎ পাশ ফিরে মায়ের বুকের দিকে মুখ গুঁজে দেয়। নীরা তার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। তনুও আধঘুমে মুখ তুলে তাকায়, কেমন যেন নিশ্চিন্ত ভরসা মাখা দৃষ্টিতে।
এই দুই মুখেই সে নিজেকে খুঁজে পায়। এই ছোট ছোট দুটি প্রাণই তার পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তারা আছে বলেই সে আজও দাঁড়িয়ে আছে, ভাঙেনি।
সকালে উঠেই তাদের জন্য নাস্তা বানায় সে, ব্যাগ গুছিয়ে দেয়, চুল বেঁধে দেয়। স্কুলবাসে উঠতে উঠতে তারা দু’জন মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে। তখন তার মনে হয়—
যদি এই দুই ভালোবাসা আমার জীবনে না আসতো, তবে আমি আজও হয়তো রেদোয়ানের ভুলে ডুবে থাকতাম।
তানভীরের গলা শুনে সে বাস্তবে ফিরে আসে। বারান্দা থেকে ডেকে ওঠে, “নীরা, চা হবে একটু?”
নীরা হেসে বলে, “হবে, দিচ্ছি এখনই।”
এই ছোট ছোট অভ্যাসই তো সংসারের ভাষা। ভালোবাসা না থাকলেও, কাছাকাছি থাকা—এটাই আজ সবচেয়ে সত্য।
সে একাই জানে, রেদোয়ান যেন মৃত কোনো অনুভূতির মতো শুধু ঘুমে এসে মনে করিয়ে দেয়, ভালোবেসে ধোঁকা খাওয়ার চেয়ে বড় সত্য—ভুল মানুষকে বিশ্বাস করাই জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যথা।
কিন্তু সে এখন জানে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে। আর কার জন্য সে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
—
চলবে…..
🪡গল্প-কবিতার শহর
নতুন গল্প পেতে Like & Follow দিয়ে সাথেই থাকুন।
#গল্প_কবিতার_শহর #স্বপ্নে_ফিরে_আসে_সে #সংসার_বনাম_মন #বাংলা_ইমোশনাল_গল্প