
28/09/2025
"রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াক্বিনা আযাবান্নার।" এই দোয়ার অর্থ হলো: "হে আমাদের রব, আমাদের দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ দান করুন, আখিরাতের জীবনেও কল্যাণ দান করুন, এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন।" এই দোয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে এমন জীবনের আবেদন করি, যেখানে দুনিয়া ও আখিরাত - দুটোই কল্যাণ ও সাফল্যে পূর্ণ হবে।
এই 'হাসানা' বা কল্যাণকর কাজগুলো কী কী হতে পারে, তা এখানে তুলে ধরা হলো:
দুনিয়ার জীবনে হাসানা
দুনিয়ার জীবনে যেসব কাজ আমাদের শান্তি, সুখ এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসে, সেগুলোই হলো দুনিয়ার হাসানা। এগুলো শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, বরং সমাজ ও মানুষের কল্যাণেও গুরুত্বপূর্ণ।
জ্ঞান অর্জন: জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের জীবনকে উন্নত করতে পারি এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি।
সৎ উপার্জন: হালাল বা সৎ পথে অর্থ উপার্জন করা দুনিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাসানা। এতে জীবনের বকরত বা বরকত থাকে এবং মনে শান্তি আসে।
সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবন: সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে জীবনযাপন করা একটি বড় নিয়ামত। নিয়মিত শরীরচর্চা, ভালো খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করা দুনিয়ার হাসানা।
পরিবার ও সমাজের প্রতি কর্তব্য: নিজের পরিবারের খেয়াল রাখা, প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়ানো এবং সমাজে ভালো কাজ করা।
আখিরাতের জীবনে হাসানা
আখিরাতের জীবনে যেসব কাজ আমাদের আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের দিকে নিয়ে যায়, সেগুলোই হলো আখিরাতের হাসানা। এগুলো মূলত ইবাদত বা আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সম্পর্কিত।
সঠিক ঈমান: আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস, তাঁর প্রেরিত কিতাবসমূহে বিশ্বাস, নবী-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস এবং ফেরেশতা ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখা।
ফরয ইবাদত: আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (নামাজ) আদায় করা, যাকাত দেওয়া, রমযান মাসে সাওম (রোজা) পালন করা এবং সামর্থ্য থাকলে হজ্জ করা।
সৎ কর্ম: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা সকল সৎ কাজ, যেমন - অভাবীকে সাহায্য করা, এতিমের খেয়াল রাখা এবং মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা।
আল্লাহর যিকির ও দোয়া: সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করা এবং তাঁর কাছে নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য সাহায্য চাওয়া।
হাসানার মূল ধারণা:
'হাসানা' শব্দটি এসেছে আরবি 'হুসন' থেকে, যার অর্থ হলো সৌন্দর্য, কল্যাণ বা ভালোত্ব। ইসলামে এর ব্যাপক অর্থ রয়েছে, যা শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ। যখন আমরা 'দুনিয়া আখিরাতে হাসানা' বলি, তখন এর অর্থ হয় এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবন যা দুনিয়ার জীবনেও সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে এবং পরকালের অনন্ত জীবনেও মুক্তি ও জান্নাত লাভের পথ খুলে দেয়।
এই হাসানা অর্জনের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে, যা নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
১. ইবাদতের মাধ্যমে হাসানা
আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের জন্য হাসানা অর্জন করতে পারি।
সালাত (নামাজ): সালাত শুধু আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ নয়, এটি মানসিক প্রশান্তি ও শৃঙ্খলাবোধ তৈরি করে। নিয়মিত নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি জীবনের অস্থিরতা থেকে মুক্তি পান এবং এটি আখিরাতে তার জন্য জান্নাতের চাবি হয়ে দাঁড়ায়।
যাকাত ও সাদাকা: সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ দান করা (যাকাত) বা স্বেচ্ছায় দান করা (সাদাকা) দুনিয়াতে সম্পদের বরকত বাড়ায় এবং অভাবীদের কষ্ট দূর করে। আখিরাতে এই দান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও উত্তম প্রতিদান নিশ্চিত করে।
রোজা: রোজা শুধু উপবাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধি ও সহানুভূতির শিক্ষা দেয়। রোজার মাধ্যমে মানুষ সংযম ও ধৈর্যের গুণ অর্জন করে, যা দুনিয়ার জীবনে তাকে আরও দৃঢ় করে এবং আখিরাতে বিশেষ প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
২. আচরণের মাধ্যমে হাসানা
আমাদের দৈনন্দিন আচরণে হাসানা লুকিয়ে আছে। ভালো ব্যবহার, সত্যবাদিতা, সততা ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত।
সৎ কথা বলা: মিথ্যা ও প্রতারণা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এর বিপরীতে, সত্যবাদিতা সমাজে আস্থা ও সম্মান তৈরি করে, যা দুনিয়ার জীবনে একটি মূল্যবান সম্পদ। পরকালে সত্যবাদীরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে।
মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার: নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো।" মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলা, প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া, দুর্বলকে সাহায্য করা — এই ছোট ছোট কাজগুলো দুনিয়াতে ভালোবাসা ও সম্মান এনে দেয় এবং আখিরাতে নেকির পাল্লা ভারী করে।
ওয়াদা রক্ষা করা: ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একজন বিশ্বাসী মানুষের বড় গুণ। এটি দুনিয়ার জীবনে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায় এবং আখিরাতে তাকে আল্লাহর কাছে প্রিয় করে তোলে।
৩. জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে হাসানা
জ্ঞান অর্জন ও তা কাজে লাগানো উভয়ই হাসানা।
উপকারী জ্ঞান অর্জন: ইসলাম জ্ঞান অর্জনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। দুনিয়ার জ্ঞান (যেমন বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রযুক্তি) মানুষকে আরও উন্নত জীবন দেয়। অন্যদিকে, ধর্মীয় জ্ঞান (কুরআন, হাদিস) আখিরাতের পথে আলোর দিশা দেখায়।
হালাল রুজি: সৎভাবে উপার্জন করা একটি বড় ইবাদত। যে ব্যক্তি নিজের পরিশ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, তার রুজি পবিত্র হয় এবং এর মাধ্যমে সে দুনিয়াতে যেমন সম্মান লাভ করে, তেমনি আখিরাতে এর জন্য পুরস্কার পায়।
জনকল্যাণমূলক কাজ: রাস্তা পরিষ্কার করা, গাছ লাগানো, মানুষের সুবিধার জন্য কূপ খনন করা—এসব কাজ দুনিয়াতে সাধারণ মানুষের উপকারে আসে এবং এর জন্য চিরন্তন পুরস্কার রয়েছে।
এই সব কাজের মূল লক্ষ্য হলো, আমরা যেন আল্লাহর নির্দেশিত পথে এমন জীবনযাপন করি যা আমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনে। তাই, একজন মুসলিমের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি চিন্তাভাবনা, এবং প্রতিটি প্রচেষ্টা হাসানা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়া উচিত।