18/05/2025
স্বপ্নে পেয়েছিলেন আদেশ। পীরের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন নিশ্চিত হতে। পীর দিলেন এক মুষ্টি মাটি। বললেন, বাংলার উদ্দেশ্যে রওনা হও, যেখানকার মাটির সাথে এ মাটির স্বাদ, গন্ধ, রং মিলে যাবে, সেখানেই স্থায়ী হবে। এর আগে নয়।
সফরের শুরুটা করেছিলেন জন্মভূমি ইয়ামেন হয়ে। লোকেরা বাদশাহির তখতে বসাতে চেয়েছিলেন সেখানে। কিন্তু তিনি থাকলেন না। বাদশাহির চেয়ে দরবেশিকে বেশি গুরুত্ব দিলেন। গুরুত্ব দিলেন নবীর মিশনকে। দুনিয়া থেকে শিরকত-জুলমত দূর করতে তাঁর মিশন যে বঙ্গদেশে। সিংহাসন অবশ্য তিনি একা ছাড়েননি; ছেড়েছেন যাঁর বসার কথা ছিল সে নিজেও। যুবরাজ শেখ আলী। জালালি সুরতে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে রওনা দেন তাঁর পিছে পিছে।
ইয়ামেন ছেড়ে তাবরিজ, সিরাজ, ইসপাহান, বাগদাদ, কান্দাহারসহ আরো কত জনপদ ঘুরলেন তার ইয়ত্তা নেই। ঘুরতে ঘুরতে এলেন মুলতান। ততদিনে তাঁর সাথে জুটেছেন অনেকে। পথিক যুক্ত হয় পথে পথে। খোদার পথ চিনতে পেরে বাড়ির পথ ভুলে পিছে পিছে চলা শুরু করে। মুসা আ. যেভাবে খিজির (আ.)-কে বলেছেন, “সত্যপথের যে বিশেষ জ্ঞান আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন, তার সন্ধান পেতে আমি কি আপনার পেছন পেছন আসতে পারি?”
তাঁর অনুসারীরা তার পিছে পিছে চলতে চলতে বর্তমান মুলতানের উঁচ শরিফে এসে পৌঁছেন। যেখানে বাহাউদ্দীন জাকারিয়া রহ. এঁর দরবার। সিলসিলা এক, দাদাপীর শেখ জালালুদ্দিন সুরখ্ বোখারির সাথেও উঁচের সম্পর্ক থাকাতে সেখানে থাকলেন কিছুদিন। অতঃপর এলেন দিল্লি। নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে চমকে দিলেন তুলায় মোড়ানো জ্বলন্ত কয়লার বাক্স পাঠিয়ে। তুলা যেখানে কয়লার আগুনে জ্বলার বদলে জ্বলজ্বল করছিল!
চলে এলেন বাংলায়। বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের পাণ্ডুয়ার থাকলেন কিছুদিন। এরপর স্থান নেন সোনারগাঁয়। কিন্তু সে মাটির সাথে তখনো কোনো মাটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অতএব যাত্রা করতে হবে অন্যত্রে।
একদিন হঠাৎ তাঁর সান্নিধ্যে সিকান্দার গাজি আর নাসির উদ্দিন সিপাহসালারের আগমন।
—কোন হেতু?
—যুদ্ধের জন্য রওনা দিচ্ছি হুজুর, দোয়া চাই৷ শ্রীহট্টে গৌর গোবিন্দের জুলুমে আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে। সামান্য গরু কুরবানির দোষে বুরহান উদ্দিনের নবজাতককে টুকরো টুকরো করেছে। হাত কেটে দিয়েছে তাঁর।
—এত বড়ো আস্পর্ধা? সংগ্রাম যদি জালিমের বিরুদ্ধে হয় তবে আমিও যাব তোমাদের সাথে!
অতঃপর গন্তব্য সিলেট। তিনি বাংলায় এসেছিলেন দ্বীনের স্বার্থে। মানুষকে আল্লাহ-নবী চেনাতে। আঁধারে থাকা মানুষদের দিলে তাওহিদ-রিসালাতের বাতি জ্বালাতে। কিন্তু যখন জালিমের প্রশ্ন এলো, সৈনিকদের সাথে যুদ্ধে রওনা দিলেন।
জালিম প্রতিহত হলো। শাহজালালের কামালিয়ত আর দুই সেনাপতির বীরত্বে যুদ্ধে বিজয় এলো। সিলেটের মানুষ এসে জড়ো হলো শাহজালালের চারপাশে। তাদের নিয়ে তিনি বসলেন জিকিরে। মসনদ ছাড়লেন সিকান্দার গাজির হাতে। আরও একবার বাদশাহির সুযোগ ছেড়ে দিলেন স্বেচ্ছায়। তবে সিলেটের মানুষের দিলের বাদশাহ হতে থাকলেন দিনদিন। গোবিন্দের কাছে নিপীড়িত, নির্যাতিত হিন্দু-বৌদ্ধ সমানে ইসলাম কবুল করতে থাকলেন।
তাঁর খলিফারা আশ্রয় নিতে থাকলেন বিভিন্ন জনপদে। সিলেট পেরিয়ে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ সর্বত্র। বর্তমান ভারতের কাছাড়, আসাম, ত্রিপুরা, করিমগঞ্জ, সিলিগুড়ি, কুচবিহার, কলকাতাও বাদ যায়নি।
কেউ বলেছেন জন্ম ১২০০ সালের দিকে, কারো মতে ১২৭১। কারো মতে জন্মস্থান কুনিয়া, কারো মতে ইয়ামেনের তাইজ। ইবনে বতুতা ১৫০ বছর বাঁচার দাবি করলেও প্রসিদ্ধ মতে ৭৬ বছরের জিন্দেগি। ৭৬ কিংবা ১৫০ সংখ্যা দিয়ে বিচার করা কঠিন, কারণ তিনি এই অল্প সময়ে যা করে গেছেন তা অনেকে হাজার বছর চেষ্টা করেও পারে না।
মাতৃভূমি ছেড়েছেন, আত্মীয়স্বজন ছেড়েছেন, নারীপ্রেম জায়গা দেননি অন্তরে, ছিলেন অবিবাহিত। সবটা বিসর্জন দিয়েছেন এই বাঙালি জাতির জন্য। এই বাংলার মানুষকে দ্বীন ইসলাম দান করতে কখনো তরবারি হাতে, কখনো পাহাড় বেয়ে, কখনো জিকিরের মাঝে রাতদিন এক করে দিয়ে খেটে গেছেন অবিরাম। এক পয়সার কোনো বিনিময় চাননি, সময়ের সেরা সুন্দরীদের বিয়ে করানোর প্রস্তাব করেছিলেন অনেকে, পাত্তা দেননি। সিলেটের মানুষেরা রাজসিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন, তিনি সিকান্দার গাজির হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
তাঁর যে অপার দান, অপরিসীম ত্যাগ তার কৃতজ্ঞতা কীভাবে আদায় করবে বাঙালি?
আজ হজরতের উরস শরিফ। ফুয়ুজে আম বর্ষণ হোক। এ দেশ থেকে অশান্তি দূর হোক। তাঁর মতো সবার জালিমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাওফিক হোক।
©
দারুল হাবিব ইয়াদিয়া খানকাহ শরিফ - রাজশাহী