22/10/2025
বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দিন দিন ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ অপরাধই শাস্তিহীন থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনি সাহায্য চান না, আর যারা চান তাদের অর্ধেকের বেশিই প্রয়োজনীয় সহায়তা পান না। মাত্র ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী প্রাপ্ত সহায়তায় সন্তুষ্ট হয়েছেন — যা আমাদের সাইবার অপরাধ মোকাবিলার অক্ষমতার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাইবার অপরাধের শিকারদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অনেকেই সামাজিক লজ্জা, জটিল আইনি প্রক্রিয়া, বা পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে অভিযোগ করতে চান না। বিশেষ করে নারী ভুক্তভোগীরা আরও বেশি দ্বিধায় ভোগেন, কারণ আমাদের বিচারব্যবস্থা এখনো নারীবান্ধব নয়। এর ফলে অনেক অপরাধী আইনের ফাঁক গলে পালিয়ে যায়, যা আরও অপরাধকে উৎসাহিত করে।
অন্যদিকে, আইন ও ট্রাইব্যুনাল থাকলেও বাস্তবে শাস্তির হার অত্যন্ত কম। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনালে গত আট বছরে ২৫৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১২৪টি মামলায় আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন এবং ১১৪টি মামলায় খালাস পেয়েছেন। অর্থাৎ, মাত্র ২১টি মামলায় দোষ প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার অভাব, আইনি দক্ষতার ঘাটতি এবং অনেক সময় অবহেলার কারণে এসব মামলা প্রমাণে ব্যর্থতা দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শাস্তিহীনতার পেছনে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সাইবার অপরাধ প্রমাণ করা সাধারণ অপরাধের চেয়ে অনেক বেশি জটিল, কারণ এখানে **শারীরিক প্রমাণের পরিবর্তে ডিজিটাল ডেটা** ব্যবহার হয়, যা সহজেই মুছে ফেলা যায়। অপরাধীরা লগ ফাইল মুছে দেয়, এনক্রিপশন ব্যবহার করে, বা “self-destructing malware” দিয়ে প্রমাণ ধ্বংস করে ফেলে। তাছাড়া তারা **VPN, proxy server বা dark web** ব্যবহার করে নিজের পরিচয় ও অবস্থান গোপন রাখে, ফলে তদন্তকারীদের জন্য তাদের খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
এর পাশাপাশি, **আন্তর্জাতিক সীমানা ও বিচারিক জটিলতা**ও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সাইবার অপরাধী বিদেশে বসে বাংলাদেশের নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে, অথচ এক দেশের পুলিশ অন্য দেশে গিয়ে অপরাধী ধরতে পারে না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব, ধীরগতি ও আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলে।
আইনি কাঠামো দুর্বলতা এবং **প্রশিক্ষণ ও সম্পদের অভাব**ও সমস্যা বাড়াচ্ছে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরের পর্যাপ্ত ডিজিটাল ফরেনসিক জ্ঞান বা আধুনিক সরঞ্জাম নেই, ফলে মামলার প্রমাণ উপস্থাপন বা ডিজিটাল প্রমাণের “চেইন অব এভিডেন্স” ঠিকভাবে দেখাতে ব্যর্থ হন। এতে আদালতে মামলার দুর্বলতা তৈরি হয় এবং অনেক আসামি খালাস পেয়ে যায়।
অন্যদিকে, **মামলার জট, বিচার বিলম্ব ও সম্পদের অভাব**ও সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় বড় বাধা। ক্রমবর্ধমান মামলার চাপ সামাল দিতে গিয়ে তদন্তে বিলম্ব হয়, ভুক্তভোগীরা নিরুৎসাহিত হন, এবং অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের সাইবার অপরাধ দমন ব্যবস্থায় আইনগত ও প্রযুক্তিগত দুই দিকেই ঘাটতি রয়েছে। এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে সরকারের উচিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দক্ষতা বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা। একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার, যাতে তারা ভয় বা লজ্জা না পেয়ে অভিযোগ করতে উৎসাহিত হন।
সাইবার অপরাধ এখন আর শুধু ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ নয়, এর প্রভাব বাস্তব জীবনে ভয়াবহভাবে পড়ছে। তাই এখনই সময় — সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনগণকে একসাথে কাজ করতে হবে, যেন কোনো সাইবার অপরাধী শাস্তি ছাড়া না থাকে এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পান।