06/08/2025
🇧🇩 অস্থির সময়ে চাই আদর্শিক দৃঢ়তা
🕋 মাসিক আত তাহরীক, সম্পাদকীয়, আগস্ট ২০২৫
🔰🖋️ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
🖋️Prof. Dr. Muhammad Asadullah Al-Ghalib
◼Monthly At-Tahreek◼At-Tahreek TV
◼ হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-Hadeeth Foundation Bangladesh
🔰🖋️ দেশ বর্তমান সময় এক অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পটপরির্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জুলাই’২৪ অভ্যুত্থানের এক বছর পরও সেই কাংখিত নতুন বাংলাদেশ দৃশ্যমান হয়নি। নয়া বন্দোবস্তের বহু শোরগোল শোনা গেলেও পুরোনো বন্দোবস্তের পথেই দেশ এগিয়ে চলেছে। চিরাচরিত নির্বাচন-নির্বাচন আওয়াজের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন। যে গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী মানবতা হরণকারী, অশান্তি সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা হিসাবে সুপ্রমাণিত, সেই গণতন্ত্রের বিষ গলধঃকরণ করার প্রস্ত্ততিই নিচ্ছেন ইসলামী দলগুলির নেতৃবৃন্দ। ক্ষমতার পথে আদর্শ যেন একেবারেই মূল্যহীন। ছলে-বলে-কৌশলে যেকোন মূল্যে সোনার হরিণটা পাবার দুর্নিবার লোভ প্রতিনিয়ত হরণ করছে আমাদের নৈতিক দৃঢ়তা ও আদর্শিক জবাবদিহিতা। মরীচিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে আর নীতি-নৈতিকতার ছাড় দিতে দিতে সবকিছু হারিয়ে আমরা শিকার হচ্ছি চুড়ান্ত আদর্শিক দেউলিয়াত্বের।
🔰🖋️ অথচ আদর্শের উপর অবিচল থাকা একজন মুমিনের অপরিহার্য দায়িত্ব। দূর্যোগ যতই ঘনীভূত হেŠক, পরিস্থিতি যতই প্রতিকুল হেŠক, সঙ্গী-সাথী যতই কম হৌক না কেন, আদর্শের উপর টিকে থাকাটাই বিজয়ের সোপান। টোকা-শ্যাওলার মত স্রোতে ভেসে যাওয়াটা মুমিনের কাজ নয়। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তুমি (মুহাম্মাদ) এবং তোমার সাথী হয়ে যারা তওবা করেছে, সকলে অবিচল থাক যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছ এবং সীমালংঘন করো না। নিশ্চয় তোমরা যা করছ তিনি সবকিছু দেখেন’ (হূদ ১১/১১২)। এই আদর্শিক দৃঢ়তাই রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামকে বিজয়ী করেছিল। এটি মুমিনের কেবল ব্যক্তিগত গুণ নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি। এই অবিচলতার একটি সাধারণ সূত্র হ’ল যাবতীয় প্রতিকূলতা, প্রলোভন বা হুমকির মুখেও মূলনীতি ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা। যা মুমিনের নৈতিক সাহস, আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধের চেতনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এই আদর্শিক দৃঢ়তা কেবল একটি বিশ্বাস মাত্র নয়, বরং এটি একটি বৈপ্লবিক শক্তি যা মানুষকে সত্যের পথে অজেয় করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের দিকে সংগঠিত করে। আর এই আদর্শিক দৃঢ়তাই মানুষের মধ্যে একসময় গণসচেতনতা গড়ে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনে। যেমন মাক্কী জীবনে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে রাসূল (ছাঃ)-এর ঈমানী দৃঢ়তা ও নিরন্তর দাওয়াত মানুষের মধ্যে আমুল পরিবর্তন সূচিত করে। যা পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিজয়ের ভিত্তি ছিল। অতএব একমাত্র ঈমানী দৃঢ়তাই বিজয়ের শর্ত, জনগণের ভিড় নয়। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)।
🔰🖋️ প্রশ্ন হ’ল, দ্বীন তবে কীভাবে কায়েম হবে, ক্ষমতা মসনদে আরোহণের মাধ্যমে না জনগণের হৃদয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে? প্রথম পন্থাটি হ’ল বর্তমানে কথিত ইসলামী রাজনীতির দাবীদারদের। আর দ্বিতীয়টি হ’ল নবীগণের তরীকার অনুসারী মুমিনদের। নবীগণের তরীকায় একজন মানুষ তাওহীদের পথে ফিরে এলে, ইসলামকে মনেপ্রাণে কবুল করলে তার পুরো জীবনটাই পরিবর্তিত হয়ে যায়। সে ব্যবসা করলে সূদ-ঘুষ-মওজুদদারী থেকে বিরত হয়। পারিবারিক জীবনে সে হয় একজন আল্লাহভীরু ও সুন্দর চরিত্রের মানুষ। রাজনীতি করলে সে আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনার চেষ্টা করে। এজন্য ইসলামী রাজনীতির নামে আলাদা কোন পরিভাষা চালু করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হ’ল মানুষকে ইসলামের বিশুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ রূপটা বুঝানো। অধিকাংশ মানুষ ইসলাম সম্পর্কে যথার্থ ধারণা রাখে না। তাওহীদ ও শিরকের পার্থক্য বুঝে না। ইসলামী নেতাদের কর্তব্য ছিল সবার আগে মানুষকে ইসলামী চেতনাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা। চেতনাহীন ও আদর্শহীন মুসলিম-অমুসলিম এক দল লোকের ভোট নিয়ে ইসলামী আইন চালু করতে গেলে ঐসব ভোটারদের খুশী করতে গিয়েই ইসলাম কায়েম হবে না। তাই ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে জনগণের ঈমানবৃদ্ধির চেষ্টা করা আবশ্যক। তবেই ‘শ্রেষ্ঠ উম্মত’ হিসাবে মুসলমানরা তাদের হৃত মর্যাদা ফিরে পাবে। আর শ্রেষ্ঠ উম্মতের বৈশিষ্ট্য হ’ল ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা। আর মা‘রূফ ও মুনকার তথা ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ড হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। যার বুঝ হ’তে হবে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী। পরবর্তী যুগের কোন চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী তথাকথিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও পীর-মাশায়েখদের বুঝ অনুযায়ী নয়।
🔰🖋️ এভাবে ব্যক্তির মধ্যে ইসলাম কায়েম হ’লে রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েম হবে। তখন যদি ক্ষমতায় অন্য কেউ থাকে, তবুও তারা মুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকারকে সম্মান করবে এবং তাদের প্রতি মনোযোগী হবে। এমনকি নাজাশীর মত নিজেরাই ইসলাম কবুল করবে। ইসলামের এই মানবদরদী তরীকা ছেড়ে উগ্র ক্ষমতার লড়াইয়ে বিশৃংখল জীবনপাত করা কোন ইসলামী পথ নয়। নবীগণের পথও নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামের ভবিষ্যৎ নবীদের তরীকায় নিহিত। পশ্চিমাদের দেখানো কোন তরীকায় নয়। আমরা মানুষকে সেপথেই আহবান জানাই।
🔰🖋️ যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ইসলামের জাগতিক স্বার্থে বাতিলের সাথে সাময়িক আপোষ করা যায়, তবে আমরা নযর দেব বিগত ৬০ বছরে মিসর, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো, মৌরিতানিয়া, তিউনিসিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও সম্প্রতি মালদ্বীপের গণতন্ত্রের দিকে। এসব দেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা একচেটিয়া। এমনকি মিসর, আলজেরিয়া ও পাকিস্তানসহ কতিপয় দেশে কিছু আহলেহাদীছ ও সালাফী সংগঠনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তারপরও কোন দেশেই কি রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের কোন চিত্র ফুটে উঠেছে? বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরো প্রতিকূলে যাচ্ছে।
🔰🖋️ মরক্কোতে ২০০২ সালের নির্বাচনে ৩২৫টি আসনের মধ্যে ৪২টি আসন পেয়েছিল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আদালত) নামক ইসলামিক পার্টি। কিন্তু দেখা গেছে যে, তারা ইসলামী রাষ্ট্র গঠন বা ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের দাবী না তুলে তুরস্কের মডেলে কেবল গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছে। তুরস্কে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রধান রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান ১৪ই মার্চ ২০০৩ থেকে অদ্যাবধি ক্ষমতাসীন থাকলেও তাদেরও একই দুরবস্থা। মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মূরসী (৩০শে জুন ২০১২-৩রা জুলাই ২০১৩ খৃ.) এক বছরের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আদালতের কাঠগড়ায় মৃত্যুবরণের মাধ্যমে মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করেছেন। ক্ষমতায় গিয়েও তিনি ইসলামের কিছুই করতে পারেননি। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও কোন রাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের দাবী করতে দেখা যায়নি। এ সব সংগঠনের নিয়ত হয়তবা সৎ হলেও এবং জনগণ তাদের পক্ষে থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সিস্টেমের ছাঁচে পড়ে তারা তাদের দাবী থেকে পিছু হটে গিয়েছেন।
🔰🖋️মূলতঃ গণতন্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর কোন দেশেই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নযীর পাওয়া যাবে না। এজন্য মিসরে ৯৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ মানুষ ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের পক্ষে থাকলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার প্রতিফলন কখনই সম্ভব নয়।
🔰🖋️ সুতরাং প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা নয়, বরং ইমারত ও শূরা ভিত্তিক ইসলামী খেলাফতের রাষ্ট্রব্যবস্থাই কাম্য। সে পথেই আমরা সকল ইসলামী দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানাই। আমরা সকল ঈমানদার ভাই-বোনকে কুফরী তন্ত্র-মন্ত্রের পথ থেকে ফিরে এসে নবীদের তরীকায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহবান জানাই। যার শুরুটা হবে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইসলামের বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার মাধ্যমে। যার বিজয় সূচিত হবে আদর্শিক মযবুতির মাধ্যমে। মিসরীয় বিদ্বান ক্বাযী হাসান আল-হুযায়বী (১৮৯১-১৯৭৩ খৃ.) যথার্থই বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর, তোমাদের জনপদে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে’। অতএব আসুন এই আদর্শিক অস্থিরতার সময়ে আমরা দ্বীনের পথে দৃঢ় থাকি। ফেৎনাপূর্ণ পথ ও মত থেকে নিজেদের হেফাযত করি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পথে নয়, বরং মানুষকে আদর্শের পথে আহবান করি। রাসূল (ছাঃ) ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে কালেমার দাওয়াত দেননি। বরং সেই দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিরাই পরবর্তীকালে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে বসেন। আর এভাবেই দ্বীন কায়েম হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ যাকে খুশী তাকে ক্ষমতা দান করে থাকেন (আলে ইমরান ৩/২৬)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন (স.স.)।
🔰🖋️ বি. দ্র. এই লেখার মধ্যেই আমরা সংবাদ পেয়েছি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে ২১শে জুলাই সোমবার বেলা ১-টা ১৬ মিনিটে সেনাবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমানের আকস্মিক দুর্ঘটনায় কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছে। আমরা তাদের মাগফিরাত ও শহীদী মৃত্যু কামনা করছি। তাদের শোকাহত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে আহতদের আশু রোগমুক্তি কামনা করছি। আল্লাহুম্মা আমীন!